এ বারের প্রায়-সফল ধর্মঘট একটা প্রশ্ন রেখে গেল। অ্যাজেন্ডাগুলির প্রতি নৈতিক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার ধর্মঘটের বিরোধী ছিল। তাই সরকারি অফিসে বাধ্যতামূলক হাজিরার সার্কুলার দেওয়া হয়েছিল। অথচ, অপরিমেয় রাষ্ট্রশক্তির ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার জন্য ধর্মঘট-ডাকা দলগুলির সঙ্গে পথে নামা প্রয়োজন ছিল এ বার। কী আর নতুন ক্ষতি হত এক দিনের বন্ধে? বরং রাষ্ট্রের জনবিরোধী ভূমিকার একটা সপাট জবাব দেওয়া যেত।
এই অতিমারি আবহেও ধর্মঘট মধ্যবিত্ত মানসিকতায় উৎসবস্বরূপ। রাজ্য সরকার ধর্মঘট সমর্থন করেনি বলে শহর-মফস্সলে বাজার বসেছে। ক্রেতা যথারীতি বাজারে হাজির হয়েছেন। তার মানে, এখনও সর্বনাশের ইঙ্গিত আশঙ্কার বাতাবরণ তৈরি করেনি। অথচ, চর্চা হয়েছে নিয়মিত। টিভিতে ধর্মঘটের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার আসর বসেছে। “অন্য নানা বিষয় নিয়ে লড়াই করাই বড় হয়ে দাঁড়ায় আর তার ফলে সাধারণ মানুষের স্বার্থটাই মার খায়”— অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় অতি জরুরি প্রশ্নটা উস্কে দিয়েছেন তাঁর নিবন্ধে (‘ভাত, কাপড়, রোজগার’, ২৭-১১), ধন্যবাদ তাঁকে।
সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি, সু্যোগসন্ধানীদের দাঙ্গা বাধানোর ছক, দল বদলের খেলায় আর্থিক লেনদেন— ভোট যত কাছে আসবে, এ সব তত বাড়বে। অথচ, কোনও দিন শ্রমজীবী মানুষকে এক ছাতার তলায় আনা যাবে না। কারণ, তাঁরাই তো তুরুপের তাস, যাঁদের প্রয়োজন ভোটের সময়। কোন নেতা দলিত মানুষটির পর্ণকুটিরে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন করেছিলেন, সে সব ভাঁওতা এখন দলিতও অনুধাবন করতে পারেন। কিন্তু, নেতা-নেত্রীর কথাকে মান্যতা দিতে এই নাটকে তাঁরা কুশীলব হন। কাগজে ছবি ওঠে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রশ্নগুলিকে সরিয়ে রেখে এখন দলবদলের কৌতুকনাট্য চলছে রাজ্যে। ‘সার্বিক সার্থক হয়েছে ধর্মঘট’— সেই আনন্দে নৃত্য করার পরিবর্তে এখন সর্বনাশা রাজনীতির বিরুদ্ধে জোরদার সচেতনতা জাগানোর আন্দোলন প্রয়োজন। এই কঠিন সময়ে স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের ঠেকাতে প্রয়োজনে আর একটা ধর্মঘট হোক।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচি
কলকাতা-১২৫
ভোগান্তি
২৬ নভেম্বর বাম ও কংগ্রেস ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ডাকা ধর্মঘটের কারণে সিএসআইআর নেট পরীক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। আমার পরিচিত এক ছাত্রের সল্টলেক সেক্টর ফাইভ টিসিএস-এ সিট পড়ে। সকাল সাড়ে সাতটায় সেখানে পৌঁছতে হত। ভোর ৪:৫০-এর ট্রেন ধরে তার পর বাসে করে। কিন্তু ধর্মঘটের সমর্থকেরা কলাগাছ কেটে রেললাইনে ফেলে রাখায় ট্রেন বন্ধ। তার উপর রাস্তায় বাস বন্ধ থাকায় আরও সমস্যা। লক্ষাধিক পরীক্ষার্থীকে এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। দায় কে নেবে?
আবির সরকার
কলকাতা-১৪৪
ধর্মঘটের লাভ
কেউ কেউ বলেন, এক দিন বন্ধ করে লাভ কিছু হয় না। গরিবের এক দিনের আয় নষ্ট হয়। দেশ অর্থনীতিতে এক দিন পিছিয়ে যায়। সত্যি কথা। কিন্তু এক দিন বিরতি দিয়ে একশো দিন এগোনো গেলে সেটাই দেশের লাভ। লাভ এখানেও হয়েছে। এটুকু বোঝানো গিয়েছে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদ করতে জনসাধারণ সক্ষম। এখানে ধর্মঘট কে ডেকেছে, সেটা গৌণ। সব সরকারের ইচ্ছে থাকে, স্বৈরতন্ত্রের কৃষ্ণগহ্বরে দেশকে নিয়ে যাওয়া। উপরন্তু, এই কেন্দ্রীয় সরকারের একটি ভয়ঙ্কর দিক হল ধর্মীয় মেরুকরণ ও আত্মম্ভরিতা। তাই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদদের সুপারিশ অগ্রাহ্য করতে দ্বিধা করে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্মঘটে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছেন। সেই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি। কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে সবার প্রতিবাদই কাম্য। কোল ইন্ডিয়া, রেল ইত্যাদি বিক্রি, ৩০০ জনের কম শ্রমিকের সংস্থায় ইচ্ছেমতো ছাঁটাই, ৮ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা কাজ করানোর মতো শ্রমবিরোধী নীতি, কৃষক স্বার্থবিরোধী কৃষিনীতি, এগুলো মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। রাজ্য সরকার যদি রাস্তায় পুলিশ না নামিয়ে নিষ্ক্রিয় থাকত, তা হলে সরকারের নীতি স্পষ্ট হত, ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হতে পারত। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতাও আরও প্রকট হত।
তপন কুমার দাস
কলকাতা-১২২
চেতনায় শান?
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ‘ভাত, কাপড়, রোজগার’ নিবন্ধে শব্দের মায়াজাল সৃষ্টি করে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে হালকা করার চেষ্টা করেছেন। ধর্মঘটকে সংগ্রামের ‘শেষ হাতিয়ার’ স্বীকার করতে না চেয়ে, একটু ঘুরিয়ে ধর্মঘটকে চেতনায় শান দেওয়ার প্রকরণ বলার একটা চেষ্টা করে, ধর্মঘটের গুরুত্ব খানিকটা কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিগত কয়েক মাসে দেশে প্রায় ১৪ কোটি মানুষ বেকার হয়েছেন, অন্নাভাব তীব্র হচ্ছে, সরকারের কাছে অনুরোধ করে, মিটিং-মিছিল করেও কিছু হচ্ছে না। সরকার সংসদ বন্ধ রেখে আলোচনা ছাড়াই রেল, বিমা, কয়লাখনি থেকে আরম্ভ করে কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিচ্ছে। এই অবস্থায় দেশের শ্রমিক সংগঠন সরকারের এই সমস্ত জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে, নিজেদের রুটিরুজির দাবিতে, বেকারদের কাজের দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছিল। তাকে ‘পেটের জ্বালা মেটানোর সংগ্রাম’ না বলে, ‘দেশের সম্পদকে রক্ষার জন্য লড়াই’ না বলে, কী করে ‘চেতনায় শান’ দেওয়াকে এই ধর্মঘটের উদ্দেশ্য বলা যায়? খাবারের অভাবে মানুষ মরে গেলে কে কার চেতনায় শান দিতে ধর্মঘট ডাকবে?
আবার, দাবি পূরণ না হলেই ধর্মঘটকে কী করে বিফল বলা যায়? কর্মসূচির সাফল্য তো নির্ভর করে মানুষের অংশগ্রহণ কতটা হল, ধর্মঘটের দাবি মানুষের মনে কতটা দাগ কাটল, ব্যাপ্তি কতটা, এ সবের উপরে। দাবি পূরণ হলে উত্তম। তবে তা নির্ভর করে যাঁরা সরকার পরিচালনা করছেন, তাঁদের নীতি ও মর্জির উপরে। মানুষ সংগঠিত ভাবে তাঁদের দাবি রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। কাজ না হলে তাঁরা শাসককেই পাল্টে দেবেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারকে মানুষ ফেলে দিয়েছিলেন, দরকার মনে করলে মোদী সরকারকেও ফেলে দেবেন। তবে এ কথা লেখক ঠিক বলেছেন যে, দুই বিপরীত শিবিরের সাম্প্রদায়িকতা একে অপরের শক্তি জোগাবে। যার ফলে নির্বাচনে মানুষের মূল সমস্যাগুলি হারানোর সম্ভাবনা অবশ্যই থাকে।
সনাতন পাল
বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর
কোনটা কর্মনাশা
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে ধর্মঘটের শত গুণ বেশি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে মালিকের লক আউটের জন্য। ২০১৩ সালে রাজ্যের তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী বাজেট অধিবেশনে বলেছিলেন, এক বছরে শ্রম দিবস নষ্ট হয়েছে ৫৫,৮৬,১৭০টি। এর মধ্যে মালিকরা কারখানায় লক আউট ঘোষণা করায় নষ্ট হয়েছে ৫৫,৭৬,৫৭৪টি এবং ধর্মঘট করায় নষ্ট হয়েছে মাত্র ৯,৫৯২টি। অথচ, আন্দোলন-বিক্ষোভকে শিল্পের পরিপন্থী বলে প্রচার করা হয়। প্রতিবাদ-আন্দোলন মিছিল-মিটিংয়ে হবে, না আবেদন-নিবেদন হবে, না বন্ধ-অবরোধে হবে, সেটা কি সরকার বা মালিক ঠিক করে দেবে?
নিখিল কবিরাজ
হাওড়া
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy