Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Raja Rammohan Roy

সম্পাদক সমীপেষু: সময়ের ব্যবধান

বিধবাদের জন্য অর্থ সাহায্যেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই সমাজকে ব্যভিচার, ভ্রূণহত্যা ও বেশ্যাবৃত্তির মতো পাপ থেকে বাঁচানোর জন্য বিদ্যাসাগরের কাজে কোনও খুঁত ছিল বলে মনে করি না।

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:৪২
Share: Save:

অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘তাঁদের কুর্নিশ করি’ (১০-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে এই সময়ের বদলে যাওয়া সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে দেখেছেন রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাজকে। তিনি লিখেছেন— “রামমোহনের কাছে বিধবাদের জন্য মৃত্যুর বিকল্প ছিল কামনাবাসনাবর্জিত মৃতবৎ এক জীবন।” সত্যিই কি তাই? এমন একটি কথা দিয়েই কি সতীদাহ প্রথার বিলোপসাধনের মতো মহৎ একটি কাজকে আখ্যায়িত করা যায়? বোধ হয় না। কারণ, সেই সময় এবং এই সময়ের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। যদি রামমোহন রায় বিধবাদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা রোধ করার জন্য শাস্ত্র উদ্ধৃত করে দেখান— ‘ব্রহ্মচর্য পালনেই বৈধব্যের সার্থকতা’, তবে দোষ কোথায়? নারী কি কেবল একটি কামনার থলি? ব্রহ্মচর্য পালনের মধ্যে তো খারাপ কিছুই নেই। তাই আজকের দিনে দাঁড়িয়ে রাজা রামমোহন রায়ের সেই সতীদাহ প্রথার বিলোপসাধন কার্যকে এ ভাবে বিচার করা হলে তা হবে ইতিহাসের অপলাপ মাত্র।

লেখিকা তাঁর প্রবন্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “বিধবাদের অস্তিত্বের পরনির্ভরতা যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, দ্বিতীয় বার বিয়ে হলেও যে তারা আবার বৈধব্য এবং অস্তিত্বের নিদারুণ সঙ্কটে নিমজ্জিত হতে পারে, তা তাঁর ভাবনায় বোধ হয় তেমন গুরুত্ব পায়নি।” এ বক্তব্যকেও সমর্থন করা চলে না। কারণ আধুনিক মননশীল দৃষ্টি এবং অনুভূতিপ্রবণ এক বিরাট হৃদয় দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র উপলব্ধি করেছিলেন বিধবাদের বৈধব্য যন্ত্রণাকে। তিনি তাঁদের পুনর্বিবাহের কথা বলেই ক্ষান্ত থাকেননি, বিধবাদের জন্য অর্থ সাহায্যেরও ব্যবস্থা করেছিলেন। তাই সমাজকে ব্যভিচার, ভ্রূণহত্যা ও বেশ্যাবৃত্তির মতো পাপ থেকে বাঁচানোর জন্য তাঁর কাজে কোনও খুঁত ছিল বলে মনে করি না।

তবে প্রবন্ধে স্বর্ণকুমারী দেবী এবং অবলা বসু (ছবি)-র জীবনের নানান দিক সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর গল্প-উপন্যাসের বিধবা চরিত্রদের কথা হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থিত করেছেন পাঠকের সামনে। ১৮৯৬ সালে স্বর্ণকুমারী ‘সখী সমিতি’ স্থাপন করে অসহায় বিধবাদের শিক্ষিত করে স্বনির্ভর করে তুলতে চেয়েছিলেন। আবার অবলা বসু ১৯১৯ সালে স্থাপন করেন ‘নারী শিক্ষা সমিতি’। বিধবারাই সেখানে পড়াবেন বলে ঠিক হয়। তাঁদের শিক্ষয়িত্রী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিদ্যাসাগর বাণী ভবন’। নামটির মধ্যেই পাওয়া যায়, অবলা বসু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে কতটা শ্রদ্ধা করতেন, সে প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু এই প্রবন্ধে তার উল্লেখ মাত্রও পাওয়া গেল না।

প্রদ্যুৎ সিংহ, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

অবিকল্প

‘যদি শিখতে চাইতাম’ (৬-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে কয়েকটি বাক্যাংশ তুলে ধরতে চাই। যেমন, ‘এক সমৃদ্ধ জীবনধারার প্রাণরস’, ‘আদিবাসী জীবনধারা থেকে শিক্ষা নেওয়াই শ্রেয়’, “আদিবাসী জীবনধারা একটি শব্দে ‘গণতন্ত্র’”, ‘চিন্তার ভুবনে তারা প্রান্তিক’। আমার বক্তব্য, আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে কোনও প্রবন্ধ বা প্রবন্ধ সঙ্কলন শিবহীন যজ্ঞে পর্যবসিত হয়, যদি ব্রিটিশ নৃতাত্ত্বিক এবং লেখক ভেরিয়ার এলউইনকে প্রাধান্য দিয়ে স্মরণ করা না হয়। প্রবন্ধে উল্লিখিত অনুষ্টুপ পত্রিকার ‘আদিবাসী ভারত বিশেষ সংখ্যা’ পড়ে দেখেছি, ৪৮৪ পাতার সঙ্কলনে একমাত্র জি এন দেবীর লেখায় এলউইনের (পুরো নাম ভেরিয়ার এলউইন পর্যন্ত উল্লিখিত নেই) উল্লেখ আছে ৫৬-৫৮ পাতায়। উল্লেখ আছে, ভেরিয়ার এলউইন আদিবাসীদের মধ্যে দীর্ঘ তিন দশক কাটিয়েছেন, এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর ভালবাসা অতুলনীয়। উল্লিখিত পত্রিকাতে কুমার রাণা পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী, ভারতের আদিবাসী মানুষের ৩০.৬ শতাংশ ছত্তীসগঢ়ে বাস করেন, এবং এই রাজ্যের ৭৮.২২ লক্ষ আদিবাসীর মধ্যে ৪২.৯৮ লক্ষ গোন্ড বা সমগোত্রীয় প্রজাতির মানুষ। ভেরিয়ার এই আদিবাসীদের বিভিন্ন প্রজাতিদের মধ্যে বাইগা, আগারিয়া, মুরিয়া, মারিয়া, গোন্ডদের উপর পৃথক ভাবে বিশাল গ্রন্থ রচনা করেছেন। এতে নৃতাত্ত্বিক তথ্য-সহ সংস্কৃতি, লোককাহিনি, গান ইত্যাদি বিশদে বর্ণিত আছে। আদিবাসীদের নিয়ে তিনি উপন্যাস, ফুলমত অব দ্য হিলস (১৯৩৭) লিখেছিলেন।

প্রবন্ধকার সঙ্কলন থেকে কয়েক জন গবেষক এবং অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। কিন্তু, এঁরা কেউ ভেরিয়ারের গোত্রে পড়েন না। ‘শিখতে’ যদি হয় তা হলে হয় আদিবাসী সমাজের সঙ্গে মিশতে হবে, অথবা মৌলিক লেখা পড়তে হবে। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও লেখক রামচন্দ্র গুহ ভেরিয়ারকে ‘স্যাভেজিং দ্য সিভিলাইজ়ড: ভেরিয়ার এলউইন, হিজ় ট্রাইবালস অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ লিখেছেন। সাহিত্য অকাদেমির উদ্যোগে ভেরিয়ারের আত্মজীবনী মহাশ্বেতা দেবী বাংলায় অনুবাদ করেছেন।

আদিবাসীদের মধ্যে (বস্তার ব্যতীত নাগাল্যান্ড এবং নেফা অঞ্চলে) নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করার জন্য ভেরিয়ার পরিবার, দেশ, ধর্ম ত্যাগ করেন। তিনি ভারতের নাগরিক হন। প্রায় সারা জীবন ভারতে কাটিয়ে ১৯৬৪ সালে মারা যান।

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৬

সামাজিক ব্যাধি

কিছু দিন আগে একটি সংবাদ প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল যে, কলকাতা হাই কোর্টের এক মাননীয় বিচারপতি ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানির সময় মন্তব্য করেছিলেন, “প্রোমোটিং এখন এক সামাজিক ব্যাধির আকার নিয়েছে।” সাধারণ মানুষের মনের কথাই ওই উক্তির মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়েছিল। শহর-শহরতলি, এমনকি গ্রাম-গঞ্জেও প্রোমোটারদের বিষাক্ত থাবা আজ প্রসারিত। তাঁদের অনেকেই নানা রকম ছল-চাতুরির দ্বারা ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। তার বেশির ভাগই আদালতের দরজায় পৌঁছয় না।

এই প্রসঙ্গে শৈবাল কর লিখিত ‘পাঠ্যক্রমে সমাধানের পথ?’ (২-৯) প্রবন্ধটির সঙ্গে সহমত পোষণ করি। প্রোমোটারদের এই বাড়বাড়ন্ত যে পুরসভা, পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতার সুযোগেই ঘটছে, তা গোপন খবর নয়। কোনও প্রোমোটারের বিরুদ্ধে কিছু জানাতে গেলে নেতা-আধিকারিকরা স্পষ্টতই বিরক্তি প্রকাশ করেন। যেখানে নেতা-মন্ত্রীদের বাড়িতে কোটি কোটি টাকা ও গয়না উদ্ধার হচ্ছে, সেখানে ও সব তো নিতান্তই ‘ছোটখাটো দুর্নীতি’! কিন্তু, বিষবৃক্ষের চারা অঙ্কুরেই বিনাশ না করলে তা এক দিন মহীরুহের আকার ধারণ করে। বাস্তবে হয়েছেও তা-ই।

প্রসঙ্গত একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। একটি আবাসনের প্রোমোটার নির্মাণ শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পরেও ‘কমপ্লিশন সার্টিফিকেট’ পাননি। তা সত্ত্বেও তিনি আরও নতুন কাজ করে যাচ্ছেন। মিউনিসিপ্যালিটি আবাসিকদের ‘মিউটেশন’ ও করপ্রদানের সমস্যা জেনেও নির্বিকার। বরং কর্তৃপক্ষ আবাসিকদেরই টাকা দিয়ে ‘কমপ্লিশন সার্টিফিকেট’ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। আর, এরই ফাঁকে কিছু স্বার্থান্বেষী আবাসিক প্রোমোটারের সঙ্গে যোগসাজশ করে কিছু অবৈধ নির্মাণ করে এবং প্রকৃত ফ্ল্যাট-মালিকদের আইনি-অধিকারে হস্তক্ষেপ করেও প্রভাব খাটিয়ে দিব্যি পার পেয়ে যাচ্ছেন। মজার কথা হল, প্রত্যেকেই মুখে কাজটি বেআইনি বললেও, কোনও ব্যবস্থা করতে অপারগ। কারণ, সর্ষের মধ্যেই ভূত! প্রশাসনকে জানালে তাঁরা পোস্ট-অফিসের কাজ করেই দায়মুক্ত হচ্ছেন। ও দিকে রাজনৈতিক নেতারা সবাই দিনরাত দুর্নীতি-মুক্তি ও স্বচ্ছতার কথা বলেন। কিন্তু, ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য এত ব্যস্ত থাকেন যে, সাধারণ মানুষের কথা শোনা ও তাঁদের সমস্যার দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই। সবই রাজনীতির অঙ্কে বিচার হয়।

এই ভোট-সর্বস্ব রাজনীতি যে মানুষের উপকারের জন্য নয়, নেতা-মন্ত্রীদের নিজেদের সার্বিক সমৃদ্ধির জন্য, আজ তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। এর থেকে মুক্তির উপায় কী?

সবিতা মুখোপাধ্যায়, মধ্যমগ্রাম, উত্তর ২৪ পরগনা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE