‘এক ও অনেক’ (কলকাতার কড়চা, ২১-৯) প্রসঙ্গে কিছু কথা। ১৮৪১ সালে সংস্কৃত কলেজের পাঠ শেষ করার পর ঈশ্বরচন্দ্রকে দু’টি শংসাপত্র প্রদান করা হয়েছিল। প্রথমটি কলেজ কর্তৃপক্ষের ইংরেজি বয়ানে প্রাতিষ্ঠানিক শংসাপত্র। দ্বিতীয়টি ছিল, সংস্কৃত কলেজের সাত জন গুণমুগ্ধ অধ্যাপকের দেওয়া স্বেচ্ছা-শংসাপত্র। এ থেকে মনে হতে পারে, এতগুলি বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করার সুবাদেই তাঁকে বিদ্যাসাগর উপাধি দেওয়া হয়।
কিন্তু তা ঠিক নয়। ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধির উৎস অনুসন্ধানে গবেষক গোপিকামোহন ভট্টাচার্যের কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের ইতিহাস গ্রন্থের ২য় খণ্ড থেকে জানা যাচ্ছে, তখন সংস্কৃত কলেজ থেকে ছাত্ররা বিভিন্ন বিষয়ে যে উপাধি লাভ করতেন, সেগুলি হল— ক) সাধারণ সাহিত্য— বিদ্যারত্ন, বিদ্যালঙ্কার, বিদ্যাসাগর, বিদ্যানিধি ইত্যাদি, খ) ন্যায়, নব্যন্যায়— ন্যায়রত্ন, ন্যায়ালঙ্কার, তর্করত্ন, তর্কালঙ্কার ইত্যাদি, গ) স্মৃতিশাস্ত্র— স্মৃতিরত্ন, স্মৃতিচূড়ামণি, স্মৃতিভূষণ, ইত্যাদি, ঘ) বেদ— বেদরত্ন, বেদকণ্ঠ ইত্যাদি। কৃতী ছাত্ররা ইচ্ছামতো উপাধি বেছে নিতেন। ১৮২৯ সাল থেকে সংস্কৃত কলেজে এই ধরনের উপাধি দেওয়ার রীতি চালু হয়। এই ধারণা করা অসঙ্গত হবে না যে, ১৮৩৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজের সাহিত্য শ্রেণির কৃতী ছাত্র হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি অর্জন করেন।
নন্দগোপাল পাত্র, সটিলাপুর, পূর্ব মেদিনীপুর
এটাই সুযোগ
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দানের কথা শুনতে ও বলতে আমরা গর্ব বোধ করি। কিন্তু তাঁর দানশীলতার কতটুকু আমরা অনুশীলন করি? ঈশ্বরচন্দ্র সমস্ত জীবন দু’হাতে উপার্জন করেছেন এবং দু’হাতে তা দান করে গিয়েছেন। ১৮৬৯ সালে ম্যালেরিয়া বর্ধমান শহরে মহামারির আকার নেয়। চিকিৎসক গঙ্গানারায়ণ মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যাসাগর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেবাকার্যে। তাঁর একক চেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার বর্ধমানে বেশ কয়েক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট সিভিল সার্জনকে বহাল করতে বাধ্য হয়। কুইনিন প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে সূচনাতেই তা নিরসন করেন বিদ্যাসাগর। সঞ্জীবনী পত্রিকা লিখছে, ‘‘বর্ধমানে যখন বড় ম্যালেরিয়া জ্বরের ধূম, তখন আমরা কলিকাতায় বসিয়া শুনিলাম যে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজ ব্যয়ে ডাক্তার ও ঔষধ লইয়া সেখানে গিয়াছেন; এবং হাড়ি, শুড়ি, জেলে, মালা, জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সকলের দ্বারে দ্বারে ফিরিয়া চিকিৎসা করাইতেছেন। তিনি গাড়িতে বসিয়া আছেন, একটা মুসলমানের বালক হয়ত তাঁহার ক্রোড়ে রহিয়াছে। এই জাতিভেদ প্রপীড়িত দেশে এমন উদার বিশ্বজনীন প্রেম আর দেখি নাই।’’
১৮৬৬ সালের মধ্যপর্বে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে ঈশ্বরচন্দ্র নিজের হাতে নিরন্ন মানুষের পাতে খাবার পরিবেশন করেছেন। একই সময়ে নিজের জন্মস্থান বীরসিংহে অন্নসত্র খুলেছেন, সরকারকে বাধ্য করেছেন একাধিক অন্নসত্র খুলতে। সংস্কৃত কলেজের ছাত্রকালে সারা রাত জেগে ওলাওঠা রোগীর সেবার কাহিনি তাঁর বাল্যকালের কাহিনি। কর্মাটাঁড়ে কলেরা-আক্রান্ত মেথর-পত্নীর পাশে সারা দিন হোমিয়োপ্যাথি ওষুধের বাক্স নিয়ে বসে থাকা, ওষুধ ও পথ্য খাইয়ে, রোগিণীর মল-মূত্র পরিষ্কার করে তাঁকে সুস্থ করে তোলার ঘটনা তারই সম্প্রসারিত বয়ান।
তাঁর জীবন, বক্তৃতার ঢক্কানিনাদের থেকে অনেক বেশি প্রায়োগিক, মাঠে নেমে কাজ করার শক্তিতে পরিপূর্ণ। ‘‘তাঁহার দয়ার মধ্য হইতে যে একটি নিঃসঙ্কোচ বলিষ্ঠ মনুষ্যত্ব পরিস্ফুট হইয়া উঠে’’ (রবীন্দ্রনাথ), তার স্বরূপ সন্ধান আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত। এই করোনাকালে তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো ডাক্তার-ওষুধ নিয়ে ছুটে যেতেন গ্রামে-গ্রামান্তরে। কর্মহারা, অন্নহারা মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর এই সুযোগটাই হতে পারে তাঁর দ্বিশতবর্ষ উদ্যাপনের প্রকৃত পথ।
শুভাশিস চক্রবর্তী, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
শুধুই অনুষ্ঠান
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হতে চলেছে এমন এক সময়ে, যখন জাতি-ধর্মের বিচার দাঁত-নখ বার করে আক্রমণে উদ্যত। নারীর অবমাননা, অবমূল্যায়ন, বাল্যবিবাহ সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। বাংলাভাষা এবং বাঙালির আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে সব মহলেই সংশয় দেখা দিয়েছে। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোতে পড়ুয়ার সংখ্যা কমে আসছে। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে বিগত এক বছর ধরে আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পালন করলাম। কিন্তু আমরা কি তাঁর আদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল? না কি শুধুই লোকদেখানো অনুষ্ঠান করে নাম কিনলাম? আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক তিনিই। বাংলাভাষাকে দাঁড়ি-কমা চিহ্ন দ্বারা সুখপাঠ্য করে তোলার প্রথম প্রয়াস তাঁরই। ১৮৫৫ সালে নববর্ষের দিনে প্রথম বর্ণপরিচয় তিনি বাঙালির হাতে তুলে দেন।
পরেশ নাথ কর্মকার, রানাঘাট, নদিয়া
স্নেহময় পিতা
কিঙ্কি চট্টোপাধ্যায়ের নিবন্ধ, ‘শিবমোহিনীকে শিখিয়েছিলেন সংসারের বর্ণপরিচয়’ (রবিবাসরীয়, ২০-৯) পড়ে এক অন্য বিদ্যাসাগরকে জানতে পারলাম। বারো বছরের বিধবা মেয়েটিকে কি অপরিসীম মমতায় আগলে রেখে সংসারের উপযোগী করে নতুন ভাবে সংসার জীবনযাপনে সহায়তা করেছিলেন। এ যেন এক স্নেহময় বাবার কাহিনি, যিনি নিজের মেয়েকে সব বিপদ, দুঃখ-কষ্ট থেকে আগলে রাখেন। মেয়েদের এমন পরম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আর কেউ জন্মাননি। আর মেয়ে শিবমোহিনীও বাবার পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করেছেন।
সর্বানী গুপ্ত, বড়জোড়া, বাঁকুড়া
মধুর হিন্দি
বিশ্বজিৎ রায় হিন্দি ভাষা ব্যবহার প্রসঙ্গে (‘জুলুম, না কি ভাব বিনিময়’, ১৯-৯) বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের সুন্দর দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। সেই প্রসঙ্গেই বলি, শ্রীরামকৃষ্ণ ‘মধুর হিন্দিতে’ কথা বলতে পারতেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-তে এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা জানা যায়, যেখানে হিন্দিভাষী কারও সঙ্গে তিনি কথা বলছেন। ১৮৮৪ সালে তিনি ‘মারোয়াড়ী ভক্তমন্দির’-এ (১২ নং মল্লিক স্ট্রিট, বর্তমান ২৬ নং) অন্নকূট উৎসবে নিমন্ত্রিত হয়ে যান। সেখানে মারোয়াড়ি ভক্ত গৃহপণ্ডিতকে তাঁর সঙ্গে কথা বলাতে নিয়ে আসেন। কথামৃতকার শ্রীম (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত) লিখছেন, ‘‘পণ্ডিতজী হিন্দীতে বরাবর কথা কহিতেছেন। ঠাকুরও তাঁহার সহিত মধুর হিন্দীতে কথা কহিতেছেন।’’ ভক্তি, প্রেম ইত্যাদি বিষয়ে পণ্ডিতজির ব্যাখ্যা শুনে ‘ঠাকুর মাস্টারের দিকে ফিরিয়া এই কথাগুলির অর্থ বলিয়া দিতেছেন’। ভাবখানা এই, যেন শ্রীম হিন্দি বুঝতে পারছেন না, তাই তিনি বুঝিয়ে দিচ্ছেন (তথ্যসূত্র: শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত (অখণ্ড), উদ্বোধন কার্যালয়, ২০০৪, পৃ ৬৭৩)।
রমাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, কলকাতা-২৬
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy