অনুরাধা রায় ‘হেথা নয়... অন্য কোন্খানে’ (১০-৭) শীর্ষক প্রবন্ধে সঠিক ভাবেই বাঙালি তথা ভারতের কমিউনিস্টদের দ্বিধাগ্রস্ততা এবং দিগ্ভ্রান্ত মনোভাব বিশ্লেষণ করেছেন। দিশাহীন রাজনীতি ও সামাজিক বাধ্যবাধকতার চাপে পড়ে বামেদের মতাদর্শগত বিচ্যুতি ঘটেছিল। অন্তর্দ্বন্দ্ব এড়ানো গেল না, বরং পার্টি দু’ভাগ হয়ে গেল।
‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব’ আর ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় ক্ষমতা দখলের ব্যবহারিক দ্বন্দ্বের মধ্যে বেশ কিছু দিন ঘুরপাক খাওয়ার পর সংসদীয় গণতন্ত্রকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে আদর্শের সঙ্গে আপস করা, মার্ক্সীয় তত্ত্বকে এই দেশের উপযোগী করে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ভ্রান্ত পদক্ষেপ, এগুলি আজকের বামপন্থার করুণ অবস্থার কারণ। ভারতের মতো বহু ভাষা, বহু ধর্ম, সমস্যাসঙ্কুল দেশে কোনও তত্ত্বই চোখ বন্ধ করে প্রয়োগ করা যায় না। প্রতি মুহূর্তে, প্রতি পদে তার পর্যালোচনা ও ঘষামাজার প্রয়োজন। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মার্ক্সীয় তত্ত্ব আশির দশক অবধি যেটুকু ডালপালা মেলতে পেরেছিল, নব্বইয়ের দশকে বাজার অর্থনীতির কল্যাণে উদারীকরণের আবহাওয়ায় দিগ্ভ্রান্ত হয়ে প্রায় নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা শুরু করল। পরবর্তী কালে, সর্বহারার মুক্তির উপায় হিসাবে পুঁজিবাদকে আশ্রয় করবার ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হওয়া এবং শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ীদের মুখাপেক্ষী হয়ে আদর্শচ্যুত হওয়াও আমরা দেখতে পেলাম। তার সঙ্গে যোগ হল শিক্ষিত মধ্যবিত্তের উপর নির্ভরতা ছেড়ে ‘প্রোমোটার’-দের উপর নির্ভরশীলতা।
ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মকে উপেক্ষা করে, অবজ্ঞা করে, পরিহার করে সংসদীয় রাজনীতি করা শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব। ধর্মকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সঠিক চিন্তাভাবনার অভাব বামপন্থীদের ‘না ঘর কা না ঘাট কা’ করে তুলেছে। যুক্তির সাহায্য নিয়ে বিরোধিতাও করতে পারেনি, আবার মার্ক্সীয় বাধ্যবাধকতায় সমর্থনও করতে পারেনি। সেকুলারিজ়ম-এর নামে ভারসাম্যের রাজনীতি করেছে, এবং তার পরিণতিতে সংখ্যাগুরু মানুষের কাছে নিজেদের বিরাগভাজন করে তুলেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গরুর মাংস খেয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজা তোলার চেষ্টা করতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু মুষ্টিমেয় মৌলবাদীর অযৌক্তিক দাবির কাছে মাথা নত করে তসলিমা নাসরিনের মতো এক জন সাহসী, যুক্তিবাদী লেখিকাকে নির্বাসিত করা হয়েছিল।
প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন, শুধু নাচ, গান, নাটক দিয়ে তথাকথিত সংস্কৃতি চর্চা কিছু দিনের জন্য মন কাড়তে পারলেও দীর্ঘমেয়াদে তা মানুষের সমস্যার সমাধান করতে পারবে, তা বিশ্বাস করাতে বামপন্থীরা অসমর্থ হয়েছেন। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে ‘আমরা সর্বজ্ঞ’ এই ধারণা থেকে বেরোতে হবে, এবং ভোটমুখী না হয়ে নতুন করে পরিস্থিতি পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও পদক্ষেপ করতে হবে।
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
চাই ঐক্য
অনুরাধা রায় উন্মোচিত করেছেন, কী ভাবে ‘বঙ্গীয় বামপন্থা’ ডুবে যেতে বসেছে। ‘বঙ্গীয়’ বিশেষণের মধ্যে বামপন্থার সঙ্কীর্ণতার প্রতি ব্যঙ্গ স্পষ্ট। কিন্তু এই বাংলায় ষাটের দশকে ছাত্রজীবন থেকে দেখে এসেছি যে, সমাজবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে তাঁদের বিশ্লেষণ সঠিক। ১৯৮৪ এবং ১৯৯২ সালে দেখেছি কী ভাবে বামপন্থী মানুষ দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করেছিলেন। তাকে ‘এথিক্যাল ধর্মনিরপেক্ষতা’ বা ‘ভদ্রলোক ধর্মনিরপেক্ষতা’, যা-ই বলা হোক না কেন, তার মধ্যে ফাঁকি ছিল না। বামপন্থী কর্মীরা রাস্তায় নেমে পুলিশের পাশে থেকে দাঙ্গা প্রতিরোধ করেছিলেন, দেখেছি। ‘ভদ্রলোক’ বলে তাঁদের হেয় করা যাবে না। ধর্মোন্মাদ রাজনীতিকে ‘বর্বর’ বলেছিলেন জ্যোতি বসু, সে কথার সত্যতা আজ দেখা যাচ্ছে ভারতে।
আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখছি পাহাড়-প্রমাণ দুর্নীতি হচ্ছে, কিন্তু ভোটের ফলাফলে তার প্রতিফলন ঘটছে না। তা ছাড়া এ রাজ্যে ভোটের মধ্যে থাকে প্রচণ্ড হিংসা এবং অলঙ্ঘনীয় কারচুপি। এই সব মেনেই নির্বাচনে লড়াই করতে হয়। ভাল কর্মী বামপন্থী দলের সম্পদ, কিন্তু ভোটের ময়দানে এঁরা শুধু দর্শক। এই বাস্তব বামপন্থীরা ধরতে পারছেন না। বদলে-যাওয়া অবস্থার মোকাবিলা কী ভাবে ওঁরা করবেন, জানেন না। ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মেলা, মন্দির, মসজিদের বাড়বাড়ন্তের সামনে বামপন্থীরা বিহ্বল। না পারছেন গ্রহণ করতে, না এড়িয়ে যেতে। দেশ, জাতি আর ধর্ম নিয়ে বড়াই করে মিথ্যে প্রচার চলছে। এ ক্ষেত্রে বামপন্থীদের কিছু বলার নেই। যা-ই বলতে যাবেন, তা বিশ্বাস করানো শক্ত। এখানেই ফ্যাসিবাদের জয়ের মন্ত্র বেজে চলেছে।
‘মুসলমান জনসংখ্যা ভয়ানক বেড়ে যাচ্ছে, তাদের জন্যেই আমরা চাকরি পাই না...’ বলে যারা বার্তা পাঠাচ্ছে তারা তো বামপন্থী নয়। তারা ধর্মদ্বেষী উগ্র জাতীয়তাবাদী, ছদ্মবেশী বামপন্থী হতেও পারে।
সোভিয়েট-সহ পূর্ব ইউরোপের বিপর্যয় মার্ক্সবাদী দর্শনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, তার অভিঘাতে যুবশক্তি সাম্যবাদে বিশ্বাস হারাচ্ছে। চিনের সমাজতন্ত্র ব্যবসার অপর নাম, বাণিজ্যে পুঁজিবাদী দেশকেও তারা পিছনে ফেলে দিয়েছে। ভোগবাদ, বিশ্বায়ন ইত্যাদির প্রলোভনে কে না ভাববে যে, সবার জন্য বিশ্বের উন্নত দেশের দরজা হাট করে খুলে দেওয়া হয়েছে? আসলে কিছু উচ্চশিক্ষিত মানুষ ছাড়া সে সুযোগ কেউ পাচ্ছে না। উন্নত দেশগুলো এখন আর তেমন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারছে না। দেশের চরম সঙ্কটেও আমাদের দেশের সাম্যবাদীরা ঐক্য গড়তে পারছে না। বহু উপদলে বিভক্ত, তত্ত্বের মীমাংসা নিয়ে বিভ্রান্ত মানুষরা এক অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হলে তাঁদের পুনরুজ্জীবন সম্ভব হবে না, এ কথা বলা যায় না। এক দিকে ধর্মীয় জাগরণের ডাক, অন্য দিকে একনায়করাজ কায়েম করে কিছু সুবিধে বিলিয়ে টিকে থাকার দৌরাত্ম্য। আর কবে বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধ হবেন?
তরুণ কুমার, ঘটককলকাতা-৭৫
সংগ্রামে ফেরা
“এক সম্পূর্ণ নতুন আর সত্যিকারের বামপন্থা: মননশীল, সাহসী আর আন্তরিক বামপন্থা” চেয়েছেন অনুরাধা রায়। মার্ক্সের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সম্পর্কে ধারণা থেকে বলতে পারি, বামেদের ভুলে বা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার সুযোগ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলরা বার বার ক্ষমতা দখল করবে, কিন্তু তা প্রতিরোধ করে নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। বঙ্গের পক্বকেশ কমরেডদের কাছে জানতে চাই, উক্ত গ্রন্থটির কোন অধ্যায়ে এমনটা রয়েছে— প্রথমত, হাজার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সমস্ত লড়াই-আন্দোলন সরিয়ে রেখে প্রতি দিন বর্তমান শাসকের মুণ্ডপাত করে যেতে হবে? দ্বিতীয়ত, ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য ভোট এলেই দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে ‘জোট’ তৈরি করে হাস্যকর অবস্থানে পৌঁছতে হবে? তৃতীয়ত, অনেক চাপের পরে নবীন প্রজন্মকে নির্বাচনী মঞ্চে তুলে, তাঁদের স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না-দিয়ে পুরনো বামপন্থার লাটাইটা নিজেদের হাতেই রাখতে হবে? চতুর্থত, নিচুতলার নেতা-কর্মীদের মৌলিক ভাবে ভাবনার জগৎটাকে রুদ্ধ করতে হবে?
অন্তত পাঁচ বছর বঙ্গের ‘সিপিএম’ নামক দলের কর্তারা সংসদীয় রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করুন। শ্রেণি সংগ্রাম, লড়াই-আন্দোলনের কর্মসূচিগুলোকে পথে নামিয়ে মানুষের শ্রদ্ধা এবং আস্থায় নিজেদের ফিরিয়ে আনুন।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy