প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। নারী অধিকার নিয়ে ঘরে-বাইরে আলোচনা হয়। কিন্তু সামাজিক বৈষম্যের চিত্রটি প্রায় একই থেকে যায়। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, সামগ্রিক ভাবে আজও নারীর সামাজিক অবস্থান অত্যন্ত নীচে। আজও কন্যাভ্রূণ হত্যার ঘটনা, কন্যাসন্তানে পিতামাতার অনীহা, পণপ্রথা, নারী সাক্ষরতার হার, কর্মক্ষেত্রে নারীর যোগদানের হার, বাল্যবিবাহ, গার্হস্থ হিংসা, নারী পাচার প্রভৃতি ঘটে চলেছে। যা বোঝায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ছায়া নারীদের জীবনে আজও কতটা দীর্ঘ। ধরেই নেওয়া হয় যে, মেয়েরা দুর্বল, জটিল চিন্তা ও সমস্যার ক্ষেত্রে পরমুখাপেক্ষী, অনুকম্পার পাত্রী, কখনওই পুরুষের সমকক্ষ হিসাবে গণ্য হওয়ার যোগ্য নয়। মেয়েদের সম্পর্কে প্রচার করা হয় অসংখ্য নেতিবাচক মনোভাব— মেয়েরা নাকি নিজেদের শুধুমাত্র প্রসাধন ও ঘরোয়া বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে ভালবাসে, সংসার প্রতিপালন তাদের একমাত্র কাজ ইত্যাদি। এই কথাগুলো অধিকাংশ মানুষের মনে আজও যেন গেঁথে আছে। বহু ক্ষেত্রেই উচ্চশিক্ষা লাভ এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পরও সংসারের দায়দায়িত্ব এবং একঘেয়েমি থেকে তাদের মুক্তি মেলে না। অথচ, সংসার কতটুকু নিরাপত্তা দেয় মেয়েদের? তথ্য বলছে, গত ৫০ বছরে ভারতে সাড়ে চার কোটি শিশুকন্যা ‘মিসিং’। অর্থাৎ তাদের থাকার কথা, কিন্তু নেই। তার মধ্যে ২০১৩-২০১৭ সালের মধ্যে প্রতি বছর ভারতে ‘হারিয়ে গিয়েছে’ অন্তত ৪ লক্ষ ৬০ হাজার শিশুকন্যা। এর চেয়ে বেদনাদায়ক কী হতে পারে।
বহু দিন ধরে নিষ্পেষিত ও অবহেলিত থাকায় মেয়েদের প্রকৃত আত্মমর্যাদাবোধকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এক ছদ্ম মর্যাদাবোধ। আজও সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ের দায় শুধুমাত্র মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত থাকায় মেয়েদের মধ্যেও এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, এগুলি তাদেরই একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। এমন ধারণাকে নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে হয়। সমাজকে যে দিন এই বৈষম্য থেকে পুরোপুরি মুক্ত করা যাবে, সে দিনই দেশ প্রকৃত উত্তরণের পথে এগিয়ে যাবে।
সুশীলা মালাকার সরদার, বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগনা
মুক্তির পথ
১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি দেয়। তার আগে নারীদের দীর্ঘ আন্দোলন, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস আছে। শিল্পবিপ্লবের ফলে কলকারখানা গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন দেখা দেয়। বহু নারী শ্রমিক সুতোকলে, পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেন। এই শ্রমিকদের অবর্ণনীয় শোষণ-অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। খুব কম মজুরি, ১৭-১৮ ঘণ্টা কাজ, কখনও একটানা ৩০ ঘণ্টা কাজ করার পর মৃত্যুও হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি ও দারিদ্রের শিকার মেয়েদের অপুষ্টিতে ও অধিক পরিশ্রমের ফলে মৃত্যু হয়েছে। নানা দাবি নিয়ে মিছিল করলে সেই মিছিলে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। নারীদের ভোটাধিকারের দাবি, সমানাধিকারের দাবি, সমকাজে সমমজুরির দাবি, এগুলো আজও অপূর্ণ থেকে গিয়েছে। শিক্ষার অধিকার দীর্ঘ সংগ্রামের ফলেই অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে মেয়েরা, যদিও অনেকেই আজও সাক্ষর নয়। আজও মহিলা শ্রমিকরা মজুরিতে বৈষম্যের শিকার, যৌন নির্যাতনের জন্য নিরাপত্তাহীন। হয়তো কিছু মেয়ে রেল, বিমান, গাড়িচালক হয়েছেন। অফিস-আদালত থেকে মহাকাশযাত্রা, সর্বত্র মেয়েদের নাম অবশ্যই শোনা যায়। তবে সেগুলো ব্যতিক্রম মাত্র। বেশির ভাগ নারীকে আজও গার্হস্থ নির্যাতনের শিকার হতে হয়। উঠতে-বসতে, ডাইনে-বামে, এমনকি ঘর থেকে বেরোতেও বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এর থেকে মুক্ত হতে পারার সংগ্রাম গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই নারী দিবস পালন করলে তা যথার্থ হয়।
কৃষ্ণা সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া
সহযোগী
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” কবি কাজী নজরুল ইসলাম নারীর অবদানের কথা এ ভাবেই বলেছেন। পুরুষশাসিত সমাজে নানা ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে নারীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার। তাই অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নামা ছাড়া কোনও গতি থাকে না মেয়েদের। নারীবাদী আন্দোলনে বহু পুরুষও স্বেচ্ছায় শরিক হয়েছেন, নারীর প্রতিবাদী কণ্ঠ সমর্থন করেছেন। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যে আছে অর্ধনারীশ্বরের কল্পনা। এক গভীর সত্য নিহিত রয়েছে এই কল্পনায়। যুদ্ধ বিক্ষোভে দীর্ণ, ধর্মসন্ত্রাসে বিপর্যস্ত, পরিবেশ দূষণের বিষবাষ্পে দূষিত সভ্যতার এই সঙ্কট থেকে যদি মুক্তিলাভ করতে হয়, তবে পুরুষকেও নারীদের আপন সংস্কৃতি কিছুটা আত্মস্থ করতে হবে। সমাজ ও সভ্যতাকে যদি টিকিয়ে রাখতে হয়, তা হলে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধতার মূল্য। যে রাজনীতি ও রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা যুদ্ধকে আশ্রয় করে পালিত ও বর্ধিত, সেখানে পুরুষেরই প্রাধান্য ছিল। কিন্তু বর্তমান সভ্যতার সঙ্কট মোচন করার জন্য প্রয়োজন অর্থনীতি ও সমাজনীতির এক বিকল্প আদর্শকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার সদিচ্ছা, যার কেন্দ্রে থাকবে সহৃদয় সহযোগিতা। আর সেখানে নারীর সবিশেষ ভূমিকার কথা সকলের কাছেই মান্যতা পেয়েছে। তাই সমাজ ও সভ্যতার স্বার্থে নারী ও পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভুলে গিয়ে এক সঙ্গে চলতে হবে।
আব্দুর রউফ মোল্লা, শান্তিপুর, নদিয়া
কন্যার পিতা
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, বিবিধ ক্ষেত্রে মেয়েদের সাফল্যের স্বীকৃতি দান, এবং নারী-পুরুষ সমানাধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ৮ মার্চ দিনটি চিহ্নিত। যদিও প্রায় প্রতি দিনই নারীর অবমাননা ও তাদের প্রতি অবহেলা ও বৈষম্যের সংবাদ প্রকাশ্যে আসে। নিজ অভিজ্ঞতালব্ধ কিছু ঘটনার খণ্ডচিত্র তুলে ধরছি। আমার এক দূরসম্পর্কের বোন কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ার পর তার শ্বশুর সর্বসমক্ষে আক্ষেপ করেন। তাঁর বিপুল সম্পদের উত্তরাধিকার নিয়ে চিন্তা তাঁকে গ্রাস করেছিল। পরবর্তী কালে আমার বোন শারীরিক ভাবে অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাকে বেশ কয়েক বার সন্তানসম্ভবা হতে এক প্রকার বাধ্য করা হয়েছিল। শেষে পুত্রসন্তানের জন্ম দিলে সেই প্রচেষ্টার ইতি ঘটে।
অফিসের অনুজ এক সহকর্মীর জীবন বিমা পলিসিগুলো নথিভুক্ত করে দিতে গিয়ে দেখলাম, তাঁর নিজের এবং স্ত্রী ও পুত্রের নামে একাধিক পলিসি আছে। কিন্তু প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও, মেয়ের নামে কোনও পলিসি নেই। এই আচরণের কোনও সদুত্তর তো তাঁর কাছে ছিলই না, বরং তাঁর নিরুত্তাপ ভাব দেখে মনে হল সেটাই স্বাভাবিক।
পরিশেষে আমার অত্যন্ত পরিচিত একটি মেয়ের কথা বলব। মেয়েটির জন্মসংবাদ শুনে, প্রভূত স্থাবর সম্পত্তির অধিকারী তার বাবা ‘প্রথমেই মেয়ে?’ কথাটি বলে কেঁদে ভাসিয়েছিলেন। মেয়েটি কিশোরী বয়সে তার মাতামহীর কাছ থেকে সেই হৃদয়বিদারক ‘সত্যি’ কথাটি জেনেছিল। সেই মেয়ে ১৮ পার হতেই, ‘দাবিহীন পাত্র’ খুঁজে ‘কন্যাদায়’মুক্ত হয়েছিলেন তার বাবা। কারণ তত দিনে তিনি এক পুত্রসন্তানের পিতৃত্ব লাভ করেছেন।
তথাকথিত শিক্ষিত ও অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, এমনই বহু ক্ষেত্রে মেয়েরা নিজেদের অস্তিত্ব সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। বর্ণিত ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন হিসেবে ধরে নিলেও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যায়। মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের সহানুভূতি প্রদর্শনের পরিবর্তে, তাদের মধ্যে নিহিত সম্ভাবনাগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে, সেগুলোর বিকাশে সহায়তা করতে পারলে সমাজ-সংসার আরও সমৃদ্ধ হত।
অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy