মেয়েদের বিয়ের বয়স ২১ বছর করা যায় কি না, দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (‘মেয়ের বিয়ে কি একুশে’, ১৭-৮)। আইন কার্যকর হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন কতটা ঘটবে? একাদশ-দ্বাদশ, এমনকি দশম শ্রেণির কিছু ছাত্রীকেও শাঁখা-সিঁদুর পরে বিদ্যালয়ে আসতে দেখছি। অথচ, সচেতনতামূলক প্রচার সর্বত্র রয়েছে। বিদ্যালয় থেকে বলা হয়, কখনও শিশুসুরক্ষা কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মীরা এসে বলে যান। চাইল্ড লাইনের টোল ফ্রি নম্বর দেওয়া হয়। তার কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তাঁদের ফোন করা হলেই স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সেখানে যান, অভিভাবকদের বোঝান ও বিয়ে বন্ধ করেন। স্থানীয় পুলিশ, বিডিও খুবই সাহায্য করেন। বিয়ে আটকানো হলে অভিভাবকের মুখ থেকে একই রকম বক্তব্য শুনতে পাই, ‘‘ভাল পাত্র পাওয়ায় এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি।’’ এমনও দেখেছি, মেয়ের বিয়ের খবর চাইল্ড লাইনের কাছে গিয়েছে জানতে পেরে অভিভাবক বাড়ির সকলকে নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। সেখানে থেকে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
মূল সমস্যা হল, সমাজব্যবস্থা। এখনও অনেকেই চান সুস্থ থাকতে থাকতে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে। তাই পাত্রের সন্ধান পেলে নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিয়ে দিতে চান। বিয়ের বয়স আরও তিন বছর বেড়ে গেলে এই আইনভঙ্গের ব্যাপারটা আরও বাড়বে সন্দেহ নেই।
মানস রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
বোলপুর, বীরভূম
অপরাধ নয়
মেয়েদের বিয়ের বয়স ২১ বছর করার প্রস্তাব যতটা আকস্মিক, ততটাই অনভিপ্রেত। এমনিতেই ভারতে ১৮ বছরের নীচে মেয়েদের বিয়ে ৪৬% থেকে কমে ২৭%-এ এসে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতে এই নিম্নমুখী প্রবণতা বজায় থাকবে, সেই সম্ভাবনাই বেশি। এটা সম্ভব হয়েছে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি ও সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে উপার্জনের সুযোগ গ্রহণ করতে পারার জন্য। এই প্রেক্ষিতে হঠাৎ মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়াতে যাওয়ার আইনি উদ্যোগ কেন, বোঝা গেল না।
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা বলছে, ১৪ বছর হয়ে গেলে মেয়েদের স্কুল ছেড়ে দেওয়ার কারণগুলি হল, পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, শিক্ষা মহার্ঘ হয়ে ওঠা এবং বাড়িতে গৃহস্থালির কাজের দায়িত্ব কাঁধে চাপা। কেবল ৮% মেয়ে বলেছে, স্কুল ছাড়ার কারণ হল, বিয়ে। এ থেকে পরিষ্কার যে, মেয়েরা যাতে শিক্ষার প্রতি আরও আগ্রহ বোধ করে, যাতে তারা কম খরচে বা বিনা খরচে শিক্ষা পেতে পারে এবং শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবার থেকেই উৎসাহ পায়, তার উপর জোর দিতে হবে। সমাজকর্মীদের অভিজ্ঞতা বলে যে, শিক্ষা এবং শিক্ষার পর উপার্জনের সুযোগ থাকলে মেয়েদের বিয়ের বয়স আপনা থেকেই বেড়ে যায়। তাদের জন্য গ্রামীণ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার পরিকাঠামো বাড়াতে হবে। সে হস্টেল সংখ্যা বাড়ানোই হোক, বা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কোর্স বাড়ানো।
আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা বলছে যে, মেয়েদের বিয়ের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৈশোরের নবলব্ধ যৌনতার বোধ ও তার প্রকাশভঙ্গি। বয়ঃসন্ধিতে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে স্বাভাবিক যৌন আকর্ষণ থাকবে, এটা সবাই জানলেও, অনেকেরই মানতে কষ্ট হয়। তাই কিশোর-কিশোরীদের যৌনতার উপর প্রাপ্তবয়স্কদের সদা সজাগ প্রহরা। একটি মেয়ে ও একটি ছেলের বন্ধুত্ব প্রকাশ্যে এলেই বাড়ি ও পাড়ার বড়দের মধ্যে ভয়ানক আশঙ্কার সৃষ্টি হয়, যার ধাক্কায় মেয়েটির স্কুলে যাওয়া, বাইরে বেরনো, মোবাইলে কথা বলা— সব বন্ধ তো হয়েই যায়, উল্টে মা-বাবা পারিবারিক বদনামের ভয়ে অন্য
পাত্র মনোনীত করে তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এই পরিস্থিতিতে মেয়েটি নিজের পছন্দের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে বহু ক্ষেত্রে মেয়ের মা-বাবা আইনের শরণাপন্ন হন। পুলিশ মেয়েটিকে ‘উদ্ধার’ করে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কোনও হোমে রেখে দেয়। ছেলেটির উপর প্রয়োগ হয় নাবালিকা নির্যাতন-বিরোধী ‘পকসো’ আইন, যার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। কোনও রকম যৌন নির্যাতন না করে থাকলেও ছেলেটি গ্রেফতার হয়, মামলা চলতে থাকে। শুধুমাত্র বয়সোচিত অন্তরঙ্গতার কারণে দুই কিশোর-কিশোরী ‘অপরাধী’ বলে শনাক্ত হয়ে যায়।
সারা ভারতে মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স এখন ১৯। মেয়েদের বিয়ের বয়স ২১-এ বেঁধে দিলে ভারতের কিশোর-কিশোরীদের যে কী হারে অপরাধী বানিয়ে ফেলা হবে, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। ভুক্তভোগীরা অধিকাংশই সমাজের প্রান্তিক ও পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়ের থেকেই যে হবে, সে-ও নিশ্চিত।
সবচেয়ে আশ্চর্যের, কিশোর-কিশোরীদের জীবনে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকার আইনে বদল করতে চায় তাদের কোনও মতামত ছাড়াই। নাগরিকদের বিভিন্ন মঞ্চে কিশোর-কিশোরীরা বিয়ের বয়স বাড়ানোর ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছে। তাদের প্রশ্ন, দেশের শিশু শ্রম আইনে বেশ কিছু ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীদের কাজ করার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তারা ১৮ বছর বয়সে ভোটও দিতে পারছে। অথচ, বিয়ে করতে পারবে না। এর কোনও বোধগম্য কারণ আছে কি?
দীপ পুরকায়স্থ
অধিকর্তা, প্রাজক উন্নয়ন সংস্থা
কঠোরতা চাই
‘বিবাহযোগ্যা’ (সম্পাদকীয়, ২৪-৮) প্রসঙ্গে জানাই, আমাদের বিদ্যালয়টি গ্ৰামের মধ্যে সহ-শিক্ষামূলক উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ছাত্র-ছাত্রীরা প্রধানত গ্ৰামের কৃষক, খেতমজুর, কারিগর, শ্রমিক, ভ্যানরিকশা চালক প্রভৃতি পরিবারের। এখানে ১৩-১৪ বছর হলেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আছে। বিদ্যালয়ে যাতে কোনও খবর না পৌঁছয়, তার জন্য বাইরে কোনও আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে অতি গোপনে বিয়ে দেওয়ার চল শুরু হয়েছে। ইদানীং বাবা-মা যতটা না নাবালিকাদের বিয়ে দিচ্ছেন, তার থেকেও বেশি ঘটছে অল্প বয়সেই পালিয়ে গিয়ে বিয়ের ঘটনা।
এই নাবালিকা এবং তাদের বাবা-মা’কে নিবৃত্ত করার জন্য অবশ্যই আইনের কঠোরতা চাই। শুধুমাত্র শিক্ষা ও স্বনির্ভরতার সুযোগই এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২১ বৎসরের পূর্বে মেয়েদের বিবাহ নয়— বলে যে প্রস্তাব রেখেছেন, তা প্রান্তিক সমাজের মেয়েদের ক্ষেত্রে খুবই সময়োপযোগী।
সন্দীপ সিংহ
জামাইবাটি উচ্চ বিদ্যালয়, হুগলি
কত তাচ্ছিল্য
‘সাম্যের দিশা’ (সম্পাদকীয়, ১৯-৮) নিবন্ধ যথার্থই বলেছে, একই পিতামাতার কন্যা ও পুত্র সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকার পাবে— এটাই স্বাভাবিক। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে, যে কোনও পরিস্থিতিতেই কন্যা পৈতৃক ভূসম্পত্তিতে পুত্রের সমান অধিকার পাবেন। কিন্তু মেয়েদের বঞ্চিত করার জন্য সমাজ নানা ফিকির খুঁজবে না তো? অনেক বাবা-মা মৃত্যুর আগে পুত্রের নামে দানপত্র করে যান। বিবাহিত কন্যাও অনেক সময় পিতৃগৃহে সমাদর পাওয়ার আশায় তাঁদের অংশ ভাইদের দান করে দেন। অথচ, মেয়েরা সম্পত্তির অধিকার পেলে শ্বশুরবাড়িতে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, জোর বাড়ে। বিশেষত নিম্নবিত্ত কৃষিজীবী পরিবারের মেয়ে জমির অধিকার পেলে তাঁর বাঁচার পথটা সুগম হয়।
এই প্রসঙ্গে একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার শিক্ষক পিতা বাড়ির বড় ছেলের লেখাপড়ায় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। মা বললে একটু-আধটু হয়তো আমাকে দেখিয়ে দিতেন। ঠাকুমা সন্দেশ কিনে দাদা ও ছোট ভাইকে খাওয়াতেন। আমাকে বাইরে দূর করে দরজা বন্ধ করে দিতেন। যৌথ পরিবারে আমার ঠাকুমার প্রবল দাপট ছিল। তার কারণ, তিনি ধনী পিতার একমাত্র সন্তান ও সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ছিলেন। নিজে মেয়ে হয়েও মেয়েদের ছোট করার দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর পাল্টায়নি।
শিখা সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫১
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy