বস্টনের রাস্তা সুনসান। —নিজস্ব চিত্র।
প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু আজ যেটার সাক্ষী হয়ে থাকছি, তার চেয়ে কম কিছু নয়। আদ্যোপান্ত কলকাতায় মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়াশোনা করার পর পিএইচডি করি মলিকিউলার বায়োলজিতে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
এরপর ২০১৮ সালে বস্টনে আসা পোস্ট ডক্টরেট করতে। বিষয় সেই একই প্রায়। ব্লাড ক্যানসারের উপর প্রধানত গবেষণা। আমার হাজব্যান্ডেরও গবেষণা প্রায় একই বিষয়ে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বস্টনকে বলা হয় ইউনিভার্সিটির শহর এবং সিলিকন ভ্যালি অফ বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ। এসে দেখলাম সত্যিই তাই। অগুণতি বায়োটেক কোম্পানি, হার্ভার্ড, এমআইটি ছাড়াও এই শহর জুড়ে রয়েছে ৩৫টি বিভিন্ন ইনস্টিটিউট।
বস্টন আমেরিকার অন্যতম পুরনো শহর। এই দেশের প্রথম রেল বা ট্রাম লাইন যেদিন তৈরি হয়েছিল, সেটাই বস্টন শহরের বুক চিরে আমাদের বাড়ি জ্যামাইকা প্লেন-এর দিকে আসে। ফাঁকা শান্ত সবুজের পরিবেশ। ১০০ বছরের পুরনো ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের ইটের তৈরি বাড়ি, রাস্তায় খোদাই করা ট্রামলাইন, এশীয় দেশের মানুষের চেনা অচেনা মুখ। শহর জুড়ে শতেক পুরনো ইতিহাসের অংশ আধুনিকতার আড়ম্বরে ঢাকা শহরটাকেও এক ফালি প্রাণ দান করে যায়। যেন মনে হয় কলকাতায় বসে আছি।
আরও পড়ুন: সাহায্য পাচ্ছি না, বলল কেন্দ্রীয় দল, বৈঠকে বসলেন মুখ্যসচিব
টাফটস ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করার সুবাদে আমার কর্মস্থল একেবারে বস্টন শহরের অন্যতম ব্যস্ত রাস্তায়, এখানকার মানুষের দৈনন্দিন কাজের শেষে সপ্তাহান্তের ছবিটাই তাই আমার ভীষণ পরিচিত। কর্মস্থল থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথেই জনবহুল ডাউনটাউন, চায়না টাউন সমেত বিস্তৃত রেস্তরাঁ পাড়া, যা শুক্রবার কাজ সেরে বেরোলেই দেখা যায় সবকটাই প্রায় ভর্তি। উপরন্তু বাইরে অপেক্ষমাণ লোকজন। শীতপ্রধান শহর হলেও এখানকার মানুষ নিয়ম করে বাইরে বেরোয়। সারা বছরই তাই শহর জুড়ে আলোর রোশনাই, পথে ড্রামবাদকের তালে তালে নাচ গান, টুকরো কথা, বন্ধুবান্ধব, ঝলমলে পোশাক, দোকান বাজার মিলিয়ে বস্টনকে একটা আস্ত মেলা মনে হয়।
সেই রকম একটা জাঁকজমকপূর্ণ শহর আজ প্রায় মৃত্যুপুরী। করোনা নামক মারণ ভাইরাসের কথা প্রথম শুনি হাজব্যান্ডের মুখে গত ফেব্রুয়ারিতে। যখন একটি বহুজাতিক বায়োটেক কোম্পানির কনফারেন্স হয় বস্টনে। সেখানে প্রায় ১৭৫ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে অনেকেরই করোনা ধরা পড়ে এবং এই সূত্রেই বস্টনে কোভিড ১৯-এর আগমন। খবরটা প্রথম শুনে এর গুরুত্বটা ঠিক বুঝতে পারিনি। ক্রমে তার সত্যতা নিশ্চিত হয়ে যায় গত দু’ মাসে। সমস্ত অফিসে, ল্যাবে ঘোষণা জারি হতে থাকে কাজকর্ম কমিয়ে দেওয়া হোক। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরনোর নিষেধাজ্ঞা। একেকটা দিন যায় আর খবর আসে বিশ্বের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ দেশের আশঙ্কাময় অবস্থার কথা। ঘরে বসে শুনতে পাই ইউরোপের অবস্থা, বিশেষ করে ইতালি, স্পেন, লন্ডন কতটা ক্ষতিগ্রস্ত। কোনওভাবে আমাদের দু’জনের দুটো সার্জিক্যাল মাস্ক জুটে যায় আর ল্যাব থেকে কিছুটা ৭০ শতাংশ অ্যালকোহল, যা কিনা এই ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা কম করবে। তাই সংগ্রহ করে আজ একমাস প্রায় বাড়িতেই আছি। স্বল্প খাচ্ছি, অফলাইন রিসার্চের কাজ করছি আর আশা করছি সুদিনের।
মার্চের শুরুর দিকে আমেরিকায় আরও অনেক করোনা কেসের কথা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, যে রাজ্যগুলো বস্টন-এর খুব কাছেই সেখানে মৃত্যুর হার এতটাই বাড়তে থাকে যে আমাদের কাজকর্ম বন্ধ করে বাড়িতে থাকতেই নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৩ মার্চ থেকে গৃহবন্দি আমি আর আমার হাজব্যান্ড। মাঝে মাঝে বেরোই। সমস্ত সুরক্ষা নিয়ে বাজার করতে যাই। প্রথম অবস্থায় এমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার হতে না হতেই সুবিশাল পাইকারি বাজারে সমস্ত টিসু পেপার, স্যানিটাইজার তো উধাও হলই, এমনকি মাংস, ডিমের তাকটাও বেমালুম সাফ। যাই হোক, পরের পর্যায়ে আবার ফ্যামিলি প্রতি একটি করে ডিমের বাক্স পাওয়া গেল।
সেদিন একটা কাজে গিয়েছিলাম আমার ল্যাবে। রাস্তা দিয়ে ফেরার পথে সেই চেনা রেস্তরাঁ গুলোতে আজ দেখা যায় শুধু ফাঁকা টেবিল। তার উপরে উল্টানো চেয়ারগুলো সারিবদ্ধ ভাবে রাখা। রাস্তাঘাট জনশূন্য, সন্ধে ৮টায় নগরীর অভিজাত এলাকায় চোখ রাখলে মনে হয় রাত ২টো বাজে। সব চেয়ে ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল নিজের নিয়ম মতো লাল থেকে সবুজ, সবুজ থেকে লাল হয়ে চলে।
শুধু মানুষ পারাপার হওয়ার জন্য সাদা আলো জ্বলে উঠলে আজকাল দু’জনের বেশি লোকেকে রাস্তা পেরোতে দেখা যায় না। ট্রেনে আর বাসে ব্যারিকেড করে রাখা হয়েছে চালকের সুরক্ষার্থে। লেখা আছে, ‘‘চালকের কাছের সিটে কেউ বসবেন না, পিছনের দরজা দিয়ে ওঠানামা করবেন।’’ পাছে সেই মারণ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন একে অপরের থেকে ফিট কয়েক দূরত্বে বসে, কেউ হাসে না, হাসলেও মাস্কের ভিতর দিয়ে কিছুই দেখা যায় না। কাজ সেরে কতক্ষণে বাড়ি ফিরবে সবারই সেই চিন্তা। ফিরে নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তোলা, হাতে সাবান দিয়ে সেকেন্ড কুড়ি ঘষা, অ্যালকোহল দিয়ে মোবাইল ফোন, চাবি মোছা, বাইরে পরিহিত জিনিসগুলোকে অন্য কোথাও ঝুলিয়ে রাখা অন্তত একদিনের জন্য। এসব এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জানি না কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে সবাই।
আমরা যারা কলকাতায় মা-বাবাকে রেখে আমেরিকায় আছি কর্মসূত্রে, তাঁরা চাইলেও জানি দেশে ফিরতে পারবো না আরও কয়েকমাস অন্তত। তাঁদের কাছের মানুষরা হয়তো সেই সময়ে টিভির পর্দায় চোখ রেখে মৃতের সংখ্যা গুনছে আর দুশ্চিন্তা করছে। আজ গুগলে সব চেয়ে চেনা শব্দ সামাজিক দূরত্ব বা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং। সেটাই একান্ত কাম্য। কারণ প্রকৃতি মাতা তার ক্ষমতা দেখাচ্ছেন। প্রায়ই মনে হচ্ছে শুনতে পাচ্ছি তার স্বগতোক্তি, ‘‘অনেক তো হল মানবজাতি, অনেক অত্যাচার করেছো আমার উপর। আজ আমার ওজন স্তর ক্ষীণ, আজ রাগে দুঃখে উত্তাপে আমার মেরু অঞ্চল বিগলিত। তোমার অশেষ ভাল থাকার মাসুল দিচ্ছি আমি। এ বার তোমার চেয়েও শক্তিশালী জাতি পাঠিয়ে দিলাম। দেখ কেমন লাগে।’’
আরও পড়ুন: টানা তিন দিন হাঁটা, খিদে-তেষ্টায় বালিকার মৃত্যু গ্রামে পৌঁছনোর মুখেই
বৈজ্ঞানিক হিসেবে আশা করব এর নিষ্পত্তি হোক শিগগিরিই। যাঁরা প্রাণ দিলেন এই মারণ রোগের কারণে, তাঁদের পরিবারের প্রতি আমাদের গভীর সমবেদনা এবং সারা বিশ্বে যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন করোনা রুখতে, তাঁদের জন্যই আন্তরিক অভিনন্দন।
শ্রীময়ী মুখোপাধ্যায়
( অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy