Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
lockdown

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে রাখতে নিজেদের অপ্রকৃতস্থ মনে হচ্ছে

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি। এবার আসি আমাদের করোনা আক্রান্ত এই দেশের জীবন যাপন এর গল্পে। থুড়ি গল্প না, কঠোর বাস্তব।

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২০ ১৮:২৬
Share: Save:

আমার বিবাহ পরবর্তী কালের বসত দেশ আমেরিকা। এখন যে খানে থাকি সেই শহরটার নাম ব্লুমিংটন। শিকাগো থেকে ঘন্টা দুয়েক এর পথ। রাজ্যের নাম ইলিনয়। পুরো আমেরিকা জুড়ে এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ এর জয়ঢাক বাজছে। এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই রাজ্যেও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই শব্দে আনন্দ না বরং তৈরি করেছে মহামারির মৃত্যু মিছিল।

আজ ১২ ই এপ্রিল তারিখে দাঁড়িয়ে লেখাটা লিখছি। আজকের তারিখে গোটা দেশ জুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লক্ষ ৩৩ হাজার মতন। আর মৃত্যুর মিছিলে সামিল প্রায় ২১ হাজার। এই রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা এই মুহূর্তে ১৯ হাজার পেরিয়ে গেছে। মৃত্যু প্রায় ৭০০ এর কাছাকাছি। শিকাগো অন্তর্ভুক্ত কুক কাউন্টি তে আক্রান্তের সংখ্যা বেশ বেশি। আমাদের কাউন্টির নাম ম্যাকলিন। এখানে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ জন। মৃত ২। এ তো গেল পরিসংখ্যান গত তথ্য।

এবার আসি আমাদের করোনা আক্রান্ত এই দেশের জীবন যাপন এর গল্পে। থুড়ি গল্প না, কঠোর বাস্তব।

আমি গত বছর ডিসেম্বর শেষে নিজের বাড়ি গেছিলাম। যাবার পথ ছিল লস অ্যাঞ্জেলস থেকে হংকং, হংকং থেকে কলকাতা। ফিরেওছি ওই একই পথে। কলকাতা থেকে হংকং , হংকং থেকে লস এঞ্জেলেস। ফিরেছিলাম জানুয়ারী এর ২০ তারিখ। লস অ্যাঞ্জেলসে ইমিগ্রেশন এর লাইনে এসে দাঁড়ালাম। এসে যা দেখলাম তা হল সে লাইন লুডোর সাপখেলার মতন এ দিক ও দিক পেঁচিয়ে এগচ্ছে। কোথায় তার শেষ জানা নেই। এবং সে লাইন এর মুখগুলির ৮০ শতাংশই হল তারা, যাদের কে আমরা গোদা ভাষায় চিনা বলি। সে হোক তাতে অসুবিধে নেই। কিন্তু ৮০ শতাংশ ওই জনসংখ্যার ৯০ ভাগ এর মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস। একটু অবাক হয়েছিলাম। বেটার হাফ কে জিজ্ঞাসা করায় আমার কৌতূহলে কিছুটা জল ঢেলে সে জানায় ওরা বোধ হয় বেশি স্বাস্থ্য সচেতন। যে মুহূর্তে আমরা এই আলোচনা করছি সেই মুহূর্তে হয়তো ঈশ্বর নিজের জায়গা থেকে মুচকি হেসে বলেছিলো এই তো সবে শুরু।

আগে থাকতাম আরিজোনা তে। দেশ থেকে ফিরেই রাজ্য বদলে হল ইলিনয়। প্রথম কোভিড-১৯ নামক আগুন এর তাপ গায়ে লাগে এই ইলিনয়তেই। নতুন জায়গায় আসা ইস্তক চাকরি খুঁজতে খুঁজতে মার্চ এর ৬ তারিখে নতুন কোম্পানি তে যোগ দিলাম।অফিস এর প্রথমদিনে অফিস ঢুকেই ওপর মহলে সৌজন্যমূলক আলাপচারিতা সারতে গিয়ে দেখি আমার মার্কিন বস নমস্কার করে আলাপচারিতা শুরু করে। চোখ খুলে পড়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই আমার খাবি খাই অবস্থা সামাল দিয়ে তিনি বলেন, “কোভিড-১৯-এর জন্য আমরা এখন হ্যান্ডশেক করছি না। মনে হল, তোমার নিজস্ব সংস্কৃতিতে তোমায় স্বাগত জানালে, তুমি খুশিই হবে।”

নিজের কাজের ডেস্কে বসে দেখি সেখানে এক বেশ বড় সাইজের হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়া। দরজা খুলতে বন্ধ করতে সবাই কনুই দিয়ে ডিসেবিলিটি ফেসিলিটি বোতাম টিপছে। হাতল নৈব নৈব চ।

এর পরের বড় ধাক্কা আসে মার্চ এর ১৩ তারিখ। এই শহরটা গড়ে উঠেছে স্টেট ফার্ম নামক একটি মার্কিন বিমা কোম্পানির ওপর ভিত করে। এটা আমেরিকার সবথেকে বড় প্রপার্টি এন্ড ক্যাসুয়ালটি বিমা সংস্থা। আমার বেটার হাফ এর ক্লায়েন্টও এই কোম্পানি। এবার ১৩ তারিখে এই কোম্পানি নিজেদের অফিস সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করে বাড়ি থেকে কাজের নিয়ম চালু করে।

দিনটা ছিল শুক্রবার। রাস্তায় লোকজনের আতঙ্কের ছাপ চোখে পড়ে সে দিনই। করোনার আতঙ্ক। রাস্তা জুড়ে গাড়ির ঢল। রসদ যোগানের পথে বেরিয়ে পড়েছে সবাই। ঠিক যেন হলিউড এর এপোক্যালিপ্টিক সিনেমার চিত্রনাট্য। সে দিন অফিস ফেরত ১৫ মিনিটের রাস্তা পেরতে লাগল ৪৫ মিনিট। আমার অফিস বন্ধ হতে লাগল আরও এক সপ্তাহ। কারণ গভর্নর জি বি প্রিৎজকার লকড ডাউন ঘোষণা করতে অতিরিক্ত ৭ দিন সময় নিয়েছিল।

প্রাথমিক লকড ডাউন শুরু হল ৭ এপ্রিল পর্যন্ত। এখন যেটা বেড়ে ৩০ এপ্রিল। লকডাউন হবার কারণে লাইব্রেরি থেকে নেওয়া বই ফেরত দেওয়ার মেয়াদ পেরিয়ে যাবে তাই ড্রাইভ থ্রু বুক ড্রপ করতে গিয়ে দেখি সেখানেও পুলিশি প্রহরা। বাজারে রসদ যোগানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে দেখি লোকজন ‘প্যানিক শপিং’ করছে। কার্ট ভর্তি হয়তো হাজার ডলারের জিনিসে। পাল্লা দিয়ে যেটা সবার আগে শেষ হয়েছে সেটা হলো হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর টয়লেট পেপার।

কিন্তু একটা রক্ষে আমি ভারতীয় তাই টয়লেট পেপার ছাড়াও কাটিয়ে দিতে পারব জানি। সুপার মার্কেটে ঢোকার মুখে ৬ ফুট দূরত্বে দাগ কাটা। সেই দাগ মেনে ঢোকার লাইন। শপিং কার্ট রাখার জায়গায় একজন কে নিয়োজিত করা, যে সব সময় কার্ট গুলো কে স্যানিটিজে করছে।

ভারতীয় স্টোর গুলো হোম ডেলিভারি শুরু করেছে। কিন্তু ৫০ ডলারের বেশি কেনা কাটা হলে তবেই। নয়ত টেলিফোনে অর্ডার দিয়ে পার্কিংয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওদেরকে ফোন করলে ওরা গাড়ির ট্রাঙ্ক এ এসে জিনিসপত্র রেখে যায়। এ তো গেল প্রাথমিক পরিস্থিতি।

সময় যত এগতে থাকে পরিস্থিতির গাম্ভীর্য মনের ভিতরে ভয়ের শিহরণ জাগায়।

আমার কাজের পরিসর কালেকশন ফিনান্স ভিত্তিক। রোজ দিন অনেক লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়। কথা বলতে গিয়ে বুঝতে পারি ইকোনমির একটা বড়ো অংশ কর্মহীন হয়ে বসে আছে।

ফুড ব্যাঙ্ক গুলোর সামনে গাড়ির লম্বা লাইন যার শেষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। খাবারের জোগানে টান পড়ছে। কারণ নিরাপত্তা হীনতায় ভুগতে থাকা মানুষ এর দানশীল মনোভাব বেশ জোরে ধাক্কা খেয়েছে। অনেক রাজ্যই অফিসিয়ালি কালেকশন অপারেশন বন্ধ রেখেছে। এই সময় বাড়ি ভাড়া না দিতে পারলে বাড়ি ছাড়া বাধ্যতামূলক নয়। এত সবের মধ্যেও লোকের ধম্মে কম্মে কিন্তু খামতি নেই।

শিকাগো তে প্রতি বছর খুব বড়ো করে সেন্ট প্যাট্রিক’স ডে’ উদযাপিত হয়। এ বছর সেটা বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এটা ইস্টারের সপ্তাহ। মন ভরে সেলিব্রেশন এর জোগাড় চলছে। এগুলো দেখে একটা কথাই মনে হল। সমস্ত পৃথিবীটাই ধর্মকর্মের পরাকাষ্ঠা। আর যে গোলার্ধেই থাক না কেন মানুষের প্রাথমিক আচরণ গুলো অভিন্ন ই হয়।

স্বাস্থ্য কর্মীরা পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই একরকম ভাবেই ভুগছে। এখানেও মাস্ক গ্লাভস এসবের ঘাটতি। ডাক্তার নার্স স্বাস্থকর্মীরা একই মাস্ক গ্লাভস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করছে। খতিয়ান গুণছে প্রাণ খুইয়ে। নিউ ইয়র্ক এর মেডিকেল স্কুলগুলোতে ফাইনাল ইয়ার কে ‘আর্লি গ্র্যাজুয়েশন’ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে মেডিকেল ওয়ার্কফোর্সে যোগ দিতে পারে।

এ তো হল সার্বিক পরিস্থিতি। সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং বজায় রাখতে রাখতে মাঝে মাঝে নিজেদেরকে অপ্রকৃতস্থ মনে হয়।

আপাতত জিনিসপত্রের যোগান আছে। আমেরিকা- মেক্সিকোর বর্ডার শুধু জরুরি ভিত্তিক কারণে খোলা এই মুহূর্তে। যদি সে টুকুও বন্ধ হয়ে যায় তাহলে দেশীয় রসদে টান পড়ার একটা সমূহ সম্ভাবনা। যখনই ফোনে বাড়িতে বা বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে কথা হচ্ছে একটাই প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। প্রসঙ্গেও এখন একঘেয়েমি গত অরুচি দেখা দিয়েছে। বাড়িতে আমি আর আমার বেটার হাফ ছাড়া জীবন্ত সঙ্গী বলতে তিন খানা গাছ। ফাঁকা সময়ে পালা করে তাদের সেবা চলছে। আর দিনের সিংহভাগটাই বাড়িটা বাড়ি থাকেনা।কর্মক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। তাই আজকাল প্রফেশনাল আর পার্সোনাল লাইফ এর অন্তর খুঁজে পাওয়াও একটু দুষ্কর। ওজন ঝরাবো বলে জিম শুরু করেছিলাম। সেই জিম পর্ব ও এখন ইতিহাসের পাতায়।

বাড়িতে বয়োজ্যেষ্ঠদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “তোমরা তো আমাদের আগে পৃথিবীতে এসেছ। পৃথিবীকে অনেক বেশি চেনো। দেখেছো কি আগে কখনো এরকম?” সবাই একযোগে এক ই উত্তর দেয়,“না”।

এবার কবে বাড়ি ফিরতে পারবো জানি না। সবটাই অনিশ্চয়তা। দেশে আমাদের বয়স্ক বাবা মা- রা আছেন। প্রতি মুহূর্তে চিন্তা হয়। আমার নিজের দিদি পুনেতে আছে। একজন তো মশকরা করে বাবাকে বলেই ফেলেছেন যে আপনার দুই মেয়ে দুই হট স্পট এ বসে। এই চিন্তায় হয়তো বাবার কপালের ভাঁজ একটু বেড়েছে। কিন্তু এখন এই চিন্তার ভাঁজ প্রত্যেক ঘরের গল্প। আপনি সুস্থ থাকতে চান কিনা সেটা অনেকটা আপনার নিজের ওপর। আপনাকে দরজার পিছনে আটকে রেখে কারও কিছু ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি নেই। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়ার। কারণ বেঁচে থাকার লড়াই এটা। আপনাদেরও তাই বলব। এই বিপদকে সাময়িক করার দায়িত্ব আপনার ওপরেই। এবং তার প্রাথমিক পদক্ষেপ হলো কিছুদিনের গৃহবন্দী জীবন। সংকটের এই কালো মেঘের ওপারেই এক আকাশ নীল আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।

অনন্যা তিওয়ারি

ব্লুমিংটন, ইলিনয়

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Lockdown coronavirus america Bloomington
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy