‘ভরাডুবির পরে’ (২৬-৬) সম্পাদকীয়তে সিপিএম-এর লজ্জাজনক পরাজয়ের বিষয়ে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেস-সিপিএম জোটের প্রচারে যথেষ্ট জনসমাগম হলেও, নির্বাচনী ফলে মোটেও তার প্রভাব পড়েনি। ফলে সিপিএম শূন্য এবং কংগ্রেস একটিমাত্র আসন লাভ করেছে। এই বিপর্যয়ের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করতে চাই। এক, সিপিএমের ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেননি। দুই, আইএসএফ-এর সঙ্গে আসন সমঝোতা না হওয়ায় সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটের সমর্থন থেকে সিপিএম বঞ্চিত হয়েছে। তিন, রাজ্য সরকারের বহুমুখী উপঢৌকনের বিরুদ্ধে দলকে লড়াই করতে হয়েছে। চার, মধ্যবিত্তের উপর নির্ভরতা সিপিএম-এর সাংগঠনিক দুর্বলতা। শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী দল শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের আস্থা অর্জনে দুর্বল হলে তা খুবই উদ্বেগের।
দলের নেতৃত্ব বিষয়টিকে নিশ্চয়ই গুরুত্ব দেবেন। অন্যান্য দলের মতো সমাজমাধ্যমে প্রচারের উপর বেশি জোর না দিয়ে, রাস্তায় জনতার পাশে থেকে লড়াই আন্দোলনে জোর দেওয়া দরকার। এ বারের নির্বাচনে এক ঝাঁক তরুণ নেতৃত্বের উঠে আসা পার্টির কাছে যথেষ্ট আশাপ্রদ। তাদের সঠিক পরিচালনার উপর আগামী দিনের সাফল্য নির্ভর করছে।
সারনাথ হাজরা, হাওড়া
কেবল কচকচি
‘ভরাডুবির পরে’ সম্পাদকীয়টি যথাযথ। দলের ভিতরে আত্মবিশ্লেষণ অবশ্যই দরকার। কিন্তু চিন্তার ব্যাপার হল, শুধু এই বারের লোকসভা নির্বাচনেই নয়, যে কোনও বড় নির্বাচনে আসনসংখ্যা বামেদের শূন্যই থাকছে কেন? এ রাজ্যে দ্বিমেরু রাজনীতির চাপে সিপিএম প্রতি বারই চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে। এ বার বাম ভোট যৎসামান্য বাড়লেও, দু’টি আসন ছাড়া সর্বত্র বামেদের জামানত জব্দ হয়েছে। জনগণ তাদের বিশ্বাস করেনি। এক দিকে যেমন বিজেপির বিরুদ্ধে মানুষ তৃণমূলকে চেয়েছে, অন্য দিকে তেমনই এক দল তৃণমূলের দুর্নীতির অবসানে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে।
এক সময় সিপিএমকে ‘সর্বহারাদের পার্টি’ বলা হত, আজ অবশ্য তা আর নেই। লোকসভা নির্বাচনে তারা একটিমাত্র আসন কেরলে পেয়েছে। এখন ‘বাবু কালচার’-এর তকমা তাদের গায়ে। এ কথা সত্যি যে, শহুরে শিক্ষিত সমাজের একটা বড় অংশ এ বার তৃণমূলের অপকীর্তির বিরুদ্ধে ব্রিগেড ভরিয়েছে, মিটিং মিছিল করে ভোটও দিয়েছে। কিন্তু গ্রামের ঘাম-ধুলো মাখা দরিদ্রদের তুলনায় তা কতটুকু? এতে বরং তৃণমূলের সুবিধা হয়েছে বিজেপির থেকে আসন ছিনিয়ে নিতে। লক্ষ্মীর ভান্ডারের অনুদান দ্বিগুণ করায় গ্রামের মেয়েরা একচেটিয়া ভাবে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে। সংখ্যালঘুরাও সিপিএমের দিকে ফিরে তাকায়নি। আসলে, দিন পড়েছে দেওয়া-নেওয়ার। আদর্শ, যুক্তি সব পিছনে পড়ে যাচ্ছে। সিপিএম মানুষকে কথার কচকচি ছাড়া কিছু দিতে পারেনি, আর বোঝাতেও পারেনি কে তাদের বড় শত্রু— তৃণমূল না বিজেপি।
অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
কৃতিত্বের বিভ্রম
সিপিএম-এর তো এখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ দশা। শাসক তৃণমূল দলকে প্রধান প্রতিপক্ষ ভেবে প্রচার করলে ভোটে জেতা যাচ্ছে না, আবার অন্ধ তৃণমূল-বিরোধিতা ছাড়া দলকে ধরে রাখাও এক প্রকার অসম্ভব। মনোভাব তো চাইলেই আর বদলানো যায় না। কেউ বলতে পারেন, শাসক দলের দুর্নীতি এখন চরমে আর মানুষ তাতে বেজায় ক্ষুব্ধ। অতএব শাসকবিরোধী সংগ্রামকে এ সময় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ঠিক, কিন্তু মিছিল-মিটিং-বিক্ষোভ সমাবেশের রুটিন কর্মসূচি কি তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে? দুর্নীতির বিরুদ্ধে বৃহত্তর এবং ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তোলা আবশ্যক, কিন্তু সে কথা ভাবছে কে? এমন দুর্দমনীয় তথা ঝুঁকিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, সিপিএম নেতৃত্বের আজ তা আছে বলে মনে হয় না।
রাজ্যস্তরে বিজেপি দলের বিপদকে চিনতে না পারার ব্যর্থতা যেমন আছে, তেমনই কংগ্রেস-বাম নির্বাচনী জোট গড়ার ক্ষেত্রে অবিচক্ষণতা সিপিএম দলকে নির্বাচনে ধরাশায়ী করেছে। নীতিগত ভুল ছাড়াও অনেক সময়ে বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়ছে নেতৃত্ব। ‘আমরা মানুষের সঙ্গে আছি’— এ কথার অর্থ কী? রুটিরুজির কথা বললেই কি ভোটারের মন জয় করা যায়? ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ যে রুটিরুজির অধিকারের প্রশ্নটিকে আড়াল করে দিতে পেরেছে, বাম নেতারা বোঝেননি।
আত্মতুষ্টির মনোভাবে দলের অসীম ক্ষতি হচ্ছে। যে কোনও কাজে সব সময়ে এক ধরনের কৃতিত্ব অনুভব করার মধ্যে আত্মশ্লাঘা আছে, কিন্তু এ তো এক বিভ্রম মাত্র। বরং এই মনোভাব বাস্তব অবস্থাকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪
দ্বিচারিতা
‘ভরাডুবির পরে’ সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, অন্যান্য রাজ্যে যেখানে ইন্ডিয়া মঞ্চ প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সফল, সেখানে এই রাজ্যে কেন সিপিএম-কংগ্রেস জোট ধরাশায়ী? পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সিপিএম-কংগ্রেসের জোটকে কোন দৃষ্টিতে দেখছে, তার বিচার না করে, শুধু নির্বাচন এলেই নেতাদের মধ্যে জোটের নৃত্য শুরু হয়ে যায়। সেই জোটে না থাকে কোনও নীতি, না থাকে আদর্শ। লক্ষ্য কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা। এই নীতিকে সম্বল করে রাজনীতিতে যে বেশি দিন টিকে থাকা যায় না, সেটা দু’দলের নেতারা আর কবে বুঝবেন? উভয় দল কেরলের জন্য এক নীতি, আর পশ্চিমবঙ্গের জন্য অন্য নীতি নিয়েছে। এই দ্বিচারিতা কেন? ২০১৬ সালের পর থেকে কংগ্রেস-সিপিএম দাবি করে আসছে, মোদী-মমতার গোপন আঁতাঁত রয়েছে, এবং বাংলায় বিজেপির বাড়বাড়ন্তের জন্য মমতা দায়ী। এই অভিযোগ যে মানুষ গ্রহণ করছে না, সেটা তো নির্বাচনে প্রমাণিত। কেরলে বামেদের শাসন থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে বিজেপি আসন পায়, তার সদুত্তর সিপিএম দিতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের মূল শত্রু কে— এই ধোঁয়াশা যত দিন তারা কাটিয়ে উঠতে না পারবে, তত দিন শূন্যের হাত থেকে নিস্তার নেই।
রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
সেই জুজু
সিপিএম তার পুরনো ট্র্যাডিশন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এখনও ভদ্রলোক নেতৃত্বের হাতেই সমস্ত ক্ষমতা ও মর্যাদা কুক্ষিগত হয়ে আছে। দারিদ্র, বেকারত্ব, শাসক দলের বেপরোয়া দুর্নীতি— এই সব জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে সিপিএম ভাবিত নয়। তারা বেশি চিন্তিত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই নিয়ে। যা এ রাজ্যে গরিব মানুষের কাছে বড় সমস্যা নয়। বরং তাঁরা শ্রেণি হিসাবে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে, পরস্পর-সম্পর্কিত। সিপিএম বক্তৃতা করতে এসে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কথা বলে, তার পরে জাতীয় পরিস্থিতির বর্ণনা দেয়। সব শেষে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা বলতে বলতেই মানুষ সভা ছেড়ে চলে যান। কারণ, তাঁরা নেতাদের মুখ থেকে জীবনজীবিকার সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পান না। সিপিএমের ভাষায় কংগ্রেস পুঁজিপতিদের দালাল, জমিদারদের দল। কংগ্রেসই ছিল তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। সেই কংগ্রেস তার শ্রেণি-চরিত্র বদলেছে কি না জানি না, কিন্তু সিপিএম তার চরিত্র বদলেছে। বর্তমানে সেই কংগ্রেসই তাদের দোসর। প্রতিপক্ষ কে হবে? রইল পড়ে সেই সাম্প্রদায়িকতার জুজু। এ রাজ্যে শাসক দলের বিরুদ্ধে লড়াইকে সিপিএম প্রহসনে পরিণত করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই সে হয়ে পড়েছে তৃতীয় বা চতুর্থ শক্তি।
সন্দীপ সিংহ, হরিপাল, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy