ছোটবেলায় ‘নবি কাহিনি’ নামে একটি বইয়ে পড়েছিলাম নবিদের জীবন-কথা। সেখানে ছিল নবি হজরত ইব্রাহিমের গল্প। নবি ইব্রাহিম পর পর তিন রাতে স্বপ্নে দেখলেন, সৃষ্টিকর্তা ইব্রাহিমের সবচেয়ে প্রিয় কিছুকে তাঁর প্রতি উৎসর্গ করার নিদান দিচ্ছেন। ইব্রাহিম পড়লেন বিপদে। সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু কী? ধন-দৌলত বিষয় সম্পত্তি? স্ত্রী? আবার স্ত্রী অপেক্ষা প্রিয় তো সন্তান। তা হলে কি সন্তান? ঠিক, সম্ভবত তাঁর পুত্রকেই উৎসর্গ করতে বলছেন উপরওয়ালা।
তিন দিনের দিন রাতে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন হজরত ইব্রাহিম। সকালে পুত্রকে নিয়ে গেলেন দূরের পাহাড়ে। ইসমাইলকে জানালেন, বিগত রাতগুলোর স্বপ্নের কথা। সাগ্রহে সম্মতি দিলেন ইসমাইল। পিতা যন্ত্রণাবিদ্ধ মনকে দৃঢ় করে প্রবৃত্ত হলেন সন্তানকে খোদার প্রতি উৎসর্গ করতে। নিজের চোখ বাঁধলেন নবি, বেঁধে দিলেন পুত্রের চোখও। কোরবানি শেষ হল। কিন্তু কী আশ্চর্য, চোখ মেলে দেখলেন ইব্রাহিম, পুত্র ইসমাইল অক্ষত দেহে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। স্বর্গীয় হাসি তার চোখে মুখে, আর পরিবর্তে জবাই হয়ে ভূমিতলে শায়িত রয়েছে একটি নধর দুম্বা….।
লিও টলস্টয় রচিত ‘How Much Land Does a Man Need?’ গল্পটি মনে আছে? গল্পে পাহোম নামে এক গ্রামীণ কৃষক তার নিজের বর্তমান অবস্থায় খুশি নয়। জমি জিরেত যা আছে তার মালিকানায় তাতে সে মনকষ্টে ভোগে, আসে না আত্মসন্তুষ্টি। সুতরাং আর কিছুটা জমির চাহিদা মনের ভিতর ভিতর কুরে কুরে খায় তাকে, পড়ে দীর্ঘশ্বাস। মনের এই অস্থিরতায় লোভী হয়ে ওঠে পাহোম। ফলে যেখানে স্বল্পমূল্যে অধিক জমির হদিশ মেলে, সেখানেই পাহোম পৌঁছে যায় লোভের তাড়নায়। দিনে দিনে বাড়তে থাকে তার জমির পরিমাণ। বাড়তে থাকে আরও সম্পত্তির লালসা। তার পরে এক দিন এমন অঞ্চলে গিয়ে পড়ে যেখানে রয়েছে প্রচুর পতিত উর্বর জমি। কিন্তু সেখানে কেউ চাষআবাদ করে না।
পাহোম স্থানীয় মোড়লকে উপহার দিয়ে তুষ্ট করে। তাঁকে সে মনের ইচ্ছের কথা জানায়। মোড়ল অত্যন্ত খুশি মনে পাহোমকে জমি বিক্রি করতে সম্মত হয়। পাহোমকে জানানো হয়, যৎসামান্য দামের বিনিময়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়কালে যতখানি জমি পায়ে হেঁটে অতিক্রম করতে পারবে, সবটুকু জমির মালিক হয়ে যাবে সে। তবে শর্ত একটাই, সূর্যোদয়ের সময় যে স্থান থেকে তার যাত্রা শুরু হবে, সূর্যাস্তের পূর্বেই ফিরতে হবে সেই স্থানে।
পাহোম যাত্রা শুরু করে। ধীরে ধীরে পদচালনা বাড়ায়। অনেক অনেক জমি, আরও আরও উর্বর মাটির নেশায় সে ছুটতে থাকে, তার তেষ্টা পায়, পায় ক্ষুধা, তবুও সে ছোটে। ছোটে গনগনে আগুনে সূর্য মাথায় নিয়ে। একমনে ছুটে চলে পাহোম। এক সময় পাহোমের মনে হয়, খালি পায়ে আরও শীঘ্র পৌঁছে যাবে লক্ষ্যে। তার পরে শুরু হয় সময়ের সঙ্গে অসম দৌড়। শেষ পর্যন্ত পাহোম পৌঁছে যায় লক্ষ্যে, বহমান সময় পরাজিত হয় তার কাছে। শেষে এক লাফে শরীর ছুড়ে দিয়ে সে ছুঁয়ে ফেলে তার কাঙ্খিত লক্ষ্য। লোভ হাততালি দিয়ে ওঠে খুশিতে। পাহোম এখন অনেক অনেক জমির মালিক। কিন্তু পাহোম আর ওঠে না। পড়েই থাকে।
তার ভৃত্য কাছে গিয়ে দেখে, তার মালিক মারা গিয়েছে। কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে ভৃত্য সমাধিস্থ করে মনিবের দেহ। ঠিক ‘সাড়ে তিন হাত’ জমি লেগেছিল পাহোমের…..।
উপরের গল্প দু’টি একটি ত্যাগের, আর একটি লোভের। কোরবানি শব্দের মমার্থ উৎসর্গ ও নৈকট্য অর্জন। প্রিয়তম সন্তান হজরত ইসমাইলকে উৎসর্গ করতে উদ্যত হয়ে আত্মত্যাগের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন নবি ইব্রাহিম। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে এই ত্যাগ, সহিষ্ণুতা ও সহশীলতার দেখা মেলা ভার। লোভ, লালসা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা ঘিরে ফেলেছে আমাদের মন ও মননকে। পাশবিক প্রবৃত্তির তাড়নায় আমরা নষ্ট করে ফেলছি আমাদের সুস্থির জীবন প্রবাহকে। আত্মত্যাগের চেয়ে দখল নেওয়ার স্বপ্নে আমরা বিভোর। যা আছে তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে, যা নেই তার পিছনে ছুটে মরছি। পাহোমের মতো আমরাও ছুটে চলি। আরও টাকা, আরও প্রভাব, আরও প্রতিপত্তি, আরও বড় ফ্ল্যাট, আরও দামি গাড়ি— আমাদের চাহিদার শেষ নেই। কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন?
ধর্ম আদতে একটা বিশ্বাসের বিষয়। আর সব ধর্মের ক্ষেত্রে মানবকল্যাণ বোধ দিয়ে শুরু হয় এই বিশ্বাসটা। আপামর সাধারণ মানুষ এই কল্যাণবোধের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই ধর্মকে গ্রহণ করতে প্রবৃত্ত হয় সাধারণত। কিন্তু গৃহীত ধর্মবিশ্বাসটি একটা আচার, প্রথা বা সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে গেলে কল্যাণবোধের জায়গাটা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। কোনও কিছু যখন অভ্যাস ও প্রথায় পরিণত হয় তখন সেটি সবসময় যুক্তি ও বুদ্ধির ধার ধারে না। অর্থাৎ যে কল্যাণবোধ ছিল ধর্মের মূল লক্ষ্য সেই লক্ষ্যটাই হয় বিচ্যুত। কথাটি কমবেশি সব ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রাক ইসলামি যুগ থেকেই চলে আসছে কোরবানি। যার মূল বিষয়টাই হচ্ছে, ত্যাগ। অর্থাৎ প্রয়োজনে কতখানি ত্যাগ স্বীকারে আমি প্রস্তুত, তার পরীক্ষার জন্যই এই উৎসর্গীকরণের প্রচলন। কিন্তু হায়, ধর্মের মর্মে না গিয়ে শুধুই বাইরের খোলসটুকুতে মেতে আছি আমরা ।
হজরত ইব্রাহিম লোকালয়ের বাইরে এক জনমানবহীন পাহাড়ে সর্বাপেক্ষা প্রিয় আত্মজকে নিয়ে গিয়েছিলেন ত্যাগকে মান্যতা দিতে। অন্য দিকে পাহোম লোভ-লালসার কবলে পড়ে হারিয়ে ফেলেছিল তার অমূল্য প্রাণ। আসুন, ইদুজ্জোহার পুণ্য প্রভাতে নিজের অন্তরের পশুরূপী লোভ-লালসাকে কোরবানি দিই। ইসমাইলরূপী জীবনকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখি পাশবিক প্রবৃত্তির করাল কবল থেকে।
শিক্ষক, বেলডাঙা এসআরএফ কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy