Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
তিন দশক পরে লালু-যুগের অবসান হল বিহারের রাজনীতিতে
Lalu Prasad Yadav

এ বার নতুন অক্ষের খেলা

জেলাশাসকের ঠাকুর জাত্যভিমানকে ভাঙতে যেমন তাঁকে দিয়ে খইনি ডলিয়েছেন; তেমনই নিম্নবর্গের মানুষ যখন দখল করেছে উচ্চবর্ণের দখলে থাকা জমি, অথবা সম্পত্তি, তখন প্রশাসনের রাশ টেনে রেখেছিলেন লালু প্রসাদ।

প্রতিনিধি: বহু বছর পরে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের ময়দানে অনুপস্থিত লালু প্রসাদ যাদব। ৩১ অক্টোবর, পটনা। পিটিআই।

প্রতিনিধি: বহু বছর পরে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের ময়দানে অনুপস্থিত লালু প্রসাদ যাদব। ৩১ অক্টোবর, পটনা। পিটিআই।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২০ ০০:৩০
Share: Save:

তিরিশ বছর, আর কয়েক দিন। লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথ আটকানো থেকে বিহার বিধানসভায় জেডিইউ-কে বহু পিছনে ফেলে বিজেপির ক্ষমতাসীন এনডিএ-র প্রধান শরিক হয়ে ওঠা— বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে সময় লাগল এতটাই। বা, এইটুকু। কে কোন পক্ষে দাঁড়িয়ে দেখছেন, সময়ের দৈর্ঘ্য নির্ভর করছে তার উপরই।

অবশ্য, শুধু সময়ের দৈর্ঘ্যই নয়, ইতিহাসও আসলে নির্ভর করে কে দেখছেন, তার উপর। বিহারে বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম পর্ব মিটে যাওয়ার পর প্রচারে ঝাঁপালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। খুব জোর গলায় মনে করিয়ে দিলেন ‘জঙ্গলরাজ’-এর কথা— লালু প্রসাদ যাদবের আমলের বিহারকে নব্বইয়ের দশকে পটনা হাইকোর্টের এক বিচারপতি যে আখ্যা দিয়েছিলেন। কথাটা ভারতীয় রাজনীতির শব্দকোষে ঢুকে পড়েছে বটে, কিন্তু পরিপ্রেক্ষিতহীন ভাবে। দীর্ঘ দিনের উচ্চবর্ণের আধিপত্য ভেঙে— লালু প্রসাদের পৌরোহিত্যে, অবশ্যই— তথাকথিত নিম্নবর্ণের যে অভ্যুত্থান ঘটছিল বিহারের রাজনীতিতে, ‘সামাজিক ন্যায়’-এর রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে, এই ‘আইনহীনতা’ যে তারই প্রকাশ ছিল, এই কথাটা ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে। উচ্চবর্ণের আমলাতন্ত্র, উচ্চবর্ণের পুলিশ, আর উচ্চবর্ণের সামাজিক আধিপত্য— বিহারের এই পরিচিত ছকটাকে ভেঙেছিলেন লালু প্রসাদ। জেলাশাসকের ঠাকুর জাত্যভিমানকে ভাঙতে যেমন তাঁকে দিয়ে খইনি ডলিয়েছেন; তেমনই নিম্নবর্গের মানুষ যখন দখল করেছে উচ্চবর্ণের দখলে থাকা জমি, অথবা সম্পত্তি, তখন প্রশাসনের রাশ টেনে রেখেছিলেন লালু প্রসাদ। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এমন ভূমিকা উচিত কি না, সেই প্রশ্ন অবশ্যই থাকবে— কিন্তু, ‘জঙ্গলরাজ’ কথাটার মধ্যে যে খুব জোরালো পরিচিতির রাজনীতি আছে, এই কথাটাও ভুলে গেলে চলবে না। উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ-ভূমিহার-রাজপুত-কায়স্থদের চোখে যা ‘জঙ্গলরাজ’, শুধু যাদব নয়, এমনকি মুশহর, দুসাদদের কাছেও কিন্তু তা ছিল আত্মপ্রজ্ঞাপনের প্রথম প্রহর।

এই কথাটা বৃহত্তর ভারতীয় রাজনীতি ভুললেও বিহার যে ভোলেনি, নরেন্দ্র মোদী বিলক্ষণ জানেন। ‘জঙ্গলরাজ’-এর কথা মনে করিয়ে দিলে উচ্চবর্ণের যে মনে পড়ে যাবে নিম্নবর্গের আধিপত্য বিস্তারের— অথবা, উচ্চবর্ণের ঐতিহাসিক আধিপত্য ভাঙার— দিনগুলোর কথা, ‘ছোটলোক’-এর হাতে সমাজের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার কথা, সেই হিসেব কষতে ভুল করেননি মোদী। তিনি যত বার জঙ্গলরাজের কথা বলেছেন, তত বারই আসলে বলেছেন, উচ্চবর্ণের নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য বিজেপি বই গতি নেই। খেয়াল করার মতো, যে সুশান্ত সিংহ রাজপুতকে বিহারের নির্বাচনের প্রাক্‌পর্বে বিজেপি সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কথা ভেবেছিল, জাতি-পরিচয়ে তিনি উচ্চবর্ণের রাজপুত। তাঁকেই ‘বিহারি সত্তা’র সঙ্গে এক করে দেখার মধ্যেও উচ্চবর্ণের রাজনীতি প্রকট। এই নির্বাচনে বিজেপি হাত খুলে উচ্চবর্ণের তাস খেলেছে। লেখার গোড়ায় যে বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার কথা লিখেছিলাম, তার আসল মাহাত্ম্য এখানেই— এত দিন বিহারে এই রাজনীতি করা সহজ ছিল না।

১৯৯০-এর দশকের গোড়া থেকে ভারতীয় রাজনীতি বইতে থাকে তিনটে ধারায়— মণ্ডল বনাম কমণ্ডলু, হিন্দুত্ববাদ আর বাজার। নিম্নবর্ণের আত্মপ্রজ্ঞাপন বনাম ব্রাহ্মণ্যবাদের রাজনীতি, হিন্দু আধিপত্যের রাজনীতি আর বাজার অর্থনীতির রাজনীতি। রাজনীতির প্রশ্ন আবর্তিত হয়েছে এই তিনটি অক্ষ ধরেই— পক্ষে, অথবা বিপক্ষে। বিহারের রাজনীতি বয়েছে মণ্ডল-এর খাতে। লালু প্রসাদ যাদব তো বটেই, ১৯৯৪ সাল থেকে তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে রাজনীতি করা নীতীশ কুমার, অথবা পরিচিতির রাজনীতির মোড়কে ক্ষমতা-সন্ধানী রামবিলাস পাসোয়ান— প্রত্যেকের রাজনীতিই কোনও না কোনও ভাবে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নকে কেন্দ্রে রেখেছে। লালু প্রসাদের আমলে যাদবদের বেখাপ্পা আধিপত্যের বিরুদ্ধে নীতীশ মহাদলিত রাজনীতি আমদানি করেছেন, লালুর ‘উন্নয়নকেন্দ্রিকতা-বিরোধী’ রাজনীতির পাশে নিজেকে ক্রমে বাজার অর্থনীতির পন্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন— কিন্তু, তাঁর উন্নয়নের ভরা কটালের সময়ও বিহারের রাজনীতির কেন্দ্র থেকে মণ্ডলকে বিচ্যুত করা যায়নি। অন্য দিকে, নীতীশ জোট করেছেন বিজেপির সঙ্গে— কিন্তু, বিজেপির ব্রাহ্মণ্যবাদী চরিত্র নিয়ে তাঁর অস্বস্তি যায়নি কোনও দিন। বিহারের রাজনীতিতে গত তিন দশকে এই ব্রাহ্মণ্যবাদ পালে হাওয়া পায়নি তেমন।

রাজ্য রাজনীতির এই সুরটি বেঁধে দেওয়ার কৃতিত্ব লালুর। ‘ইজ্জত’-মুখী সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিনি অবহেলা করেছেন বিহারের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে; তাঁর আমলে যাদবরা যতখানি লাভবান হয়েছে, অন্যান্য নিম্নবর্গের মানুষ তার ধারেকাছেও সুবিধা পাননি; এন্তার দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন এবং সেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু, এই লালু প্রসাদ যাদবই ভারতের সেই মুষ্টিমেয় আঞ্চলিক নেতাদের এক জন, যিনি বিজেপির হাত ধরেননি। বিজেপি উচ্চবর্ণের দল বলে, বিজেপি হিন্দুত্ববাদী বলে। লালু প্রসাদের যাদব-মুসলমান রাজনীতির সঙ্গে বিজেপির বিরোধ প্রত্যক্ষ। এবং, রাজ্য রাজনীতিতে যে যেখানেই থাকুন, বিজেপির প্রতি অস্বস্তি থেকেছে। নীতীশ কুমার নরেন্দ্র মোদীকে বিহারের প্রচারে আসতে দেননি, জানিয়েছেন তাঁর কাছে ‘মোদী’ মানে সুশীল মোদী— রাজ্য বিজেপির মুখ। রাজ্য রাজনীতি তাঁকে বিজেপির জন্মের আগে থেকেই চিনত, জয়প্রকাশ নারায়ণের সহযোদ্ধা হিসেবে।

২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচন বিহারে বিজেপির কাছে তাৎপর্যপূর্ণ— ভোটের ফলাফলের জন্য নয়— এই প্রথম বার বিহারে ‘বিজেপি’ হয়ে উঠতে পারার জন্য। দ্বিতীয় দফার প্রচারপর্ব থেকেই হাল ধরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর প্রচারে যেমন উচ্চবর্ণের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার অনতিপ্রচ্ছন্ন ডাক ছিল, তেমনই ছিল রাখঢাকহীন হিন্দুত্ব। সবচেয়ে বেশি ছিল বিহারের রাজনৈতিক চরিত্র থেকে ক্রমে দূরে সরে গিয়ে প্রচারপর্বকে বিজেপির সর্বভারতীয় সুরে বেঁধে নেওয়া। এই প্রথম বিজেপি বুঝল ও বোঝাল, বিহারের জন্য ভিন্ন ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন নেই— রাজনীতির মাপে দল এখন রাজ্যের চেয়ে বড়।

এটা আসলে বিহারের রাজনীতির সন্ধিক্ষণ। লালু প্রসাদ যাদবের সামাজিক ন্যায়ের রাজনীতির দিন ফুরিয়েছে। ভোটে স্পষ্ট, সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে নীতীশ কুমারের মধ্যপন্থারও। এবং, এই সন্ধিক্ষণে তৈরি হয়েছে দুটো সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী রাজনৈতিক সম্ভাবনা। প্রথমটির কারিগর তেজস্বী যাদব। বামপন্থী দলগুলির সঙ্গে— বিশেষত সিপিআই(এমএল)-লিবারেশনের সঙ্গে— জোট বেঁধে তেজস্বী যে রাজনীতি তৈরি করার চেষ্টা করছেন, তার অক্ষ জাতি-পরিচিতি নয়, শ্রেণি-পরিচিতি। গত তিন দশকে ভারতে শ্রেণি-পরিচিতির রাজনীতি কার্যত দেখা যায়নি বললে ভুল ধরার উপায় নেই— কেরল বা পশ্চিমবঙ্গের বাম শাসন সত্ত্বেও নয়।

দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি ধর্মীয়-পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির। যে রাজনীতি বিজেপি করছে। আসাদুদ্দিন ওয়েইসিকে ‘ভোট কাটুয়া’ বলায় অনেকে হিসেব কষে দেখাচ্ছেন, যে কুড়িটি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল ওয়েইসির এমআইএম, তার মধ্যে যে ক’টিতে এনডিএ জয়ী হয়েছে, সেখানে একটি বাদে বাকি আসনে এমআইএম-এর সব ভোট পেলেও জিততে পারতেন না মহাগঠবন্ধনের প্রার্থীরা। ফলে, ওয়েইসির দৌলতে বিজেপির সুবিধা হয়েছে, বলা যাবে না। প্রশ্ন হল, ভোটের অঙ্ক কি শুধু ভোটে হয়? এমআইএম প্রার্থী দেওয়া মানেই মুসলমানদের জন্য নিজস্ব দল— এমন একটা বিশ্বাস হিন্দুদের মধ্যে তৈরি হয়ে যাওয়া কি অস্বাভাবিক? ফলে, জাতিগত পরিচিতির অক্ষে এত দিন যাঁরা বিজেপির উচ্চবর্ণের অবস্থানের বিপ্রতীপে ছিলেন, ধর্মীয় পরিচিতির অক্ষে তাঁরাই হিন্দু হিসেবে বিজেপির ছায়ায় আশ্রয় খুঁজবেন না, তেমন কথা জোর দিয়ে বলা মুশকিল। বিজেপিও ঠিক এটাই চায়।

রাজনৈতিক ভাবে জটিলতম রাজ্যগুলোর মধ্যে একটা হল বিহার। তার সমীকরণ কখন কী ভাবে পাল্টায়, আঁচ করা মুশকিল। তবে, তিরিশ বছরের লালু-যুগ শেষ করে বিহারের রাজনীতি পা রাখছে নতুন পর্বে, তা নিয়ে সম্ভবত সংশয় নেই। তেজস্বী যাদবরা পারবেন তাঁদের মতো করে এই নতুন পর্বের পরিচিতি তৈরি করতে, তিন দশক আগে লালু প্রসাদ যাদব যে ভাবে পেরেছিলেন?

অন্য বিষয়গুলি:

Lalu Prasad Yadav Bihar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy