দ্বৈত-মানদণ্ড: সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামী ও প্রহসন-শিল্পী কুণাল কামরা
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরদীপ সিংহ পুরী রাতারাতি খ্যাতনামা হয়েছেন। দেশের তাবৎ বিমান কোম্পানির উদ্দেশে তাঁর বার্তা ধ্বনিত হয়েছে: কুণাল কামরার মতো গোলযোগসৃষ্টিকারীদের প্রতি ‘জ়িরো টলারেন্স’ দেখাতেই হবে— হাজার হোক, এ হল ‘নিরাপত্তা’র প্রশ্ন। শাসকের আসন থেকে বিতরিত এই মহৎ ও উদার বাণী অবশ্যই বিফলে যায়নি। বেসরকারি বিমান কোম্পানিরা লাইন দিয়ে ইন্ডিগো উড়ানের বিতর্ক-মথিত যাত্রী কুণালের প্লেনে পা রাখা আপাতত নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। সত্যিই তো, ও রকম প্রশ্ন করে করে সহযাত্রীকে ‘হ্যারাস’ করা কেউ শুনেছে কখনও। এ কি মানা যায়।
সত্যিই, পাবলিক স্পেস বা জনপরিসরে অন্যকে এই ভাবে ঝামেলায় ফেলা কোনও সভ্য দেশের দস্তুর হতে পারে না। কুণালের কিছু বলার থাকলে তিনি অন্য ভাবে বলতে পারতেন। একটা কথোপকথনের চেষ্টা করতে পারতেন। এমন ‘হ্যারাসমেন্ট’ করে নিজেই তার ভিডিয়ো রেকর্ডিং ছড়িয়ে দেওয়া, এটাই তো এই সময়ের সবচেয়ে অশালীন অসুখ। কত রকমের ব্যক্তিগত সঙ্কট ও সামাজিক দুঃসময় তৈরি হচ্ছে এই সব নবার্জিত নির্যাতন পদ্ধতিতে, সে তো আমরা হামেশাই দেখছি। আজ কুণাল কামরা যে ভাবে অর্ণব গোস্বামীকে হ্যারাস করছেন, কাল হয়তো দিলীপ ঘোষের সাঙ্গোপাঙ্গেরা অরুন্ধতী রায়কে সেই ভাবে হ্যারাস করবেন! এর ফলে যে কোনও ভদ্রলোক যে কোনও মতামত জানাতেই আশঙ্কিত বোধ করবেন। ভাববেন, থাক বাবা, কোথায় কারা ওত পেতে বসে আছে ধরার জন্য, নিশ্চুপ থাকাই ভাল। এ কি কোনও সুস্থ সমাজের হালচাল?
সে দিনের বিমানচালক বলেছেন, কুণাল ঠিক ‘অ্যাবিউজ়’ করেননি। তাঁরা সতর্ক করার সঙ্গে সঙ্গে কুণাল নাকি দুঃখপ্রকাশ করে নিজের আসনে ফিরে গিয়েছিলেন। ভাল। এর জন্য নিশ্চয়ই কুণালের শাস্তিটা বেশি বড় মাপের হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ‘অ্যাবিউজ়’ না করলেও ‘ন্যুইসান্স’ তো তৈরি করেছিলেন তিনি, সেটাও কোনও ভাল কাজ হতে পারে না। সমর্থন করার মতো কিছু তো নয়ই।
ভদ্র সমাজে এ নিয়ে জ়িরো টলারেন্স-ই একমাত্র ভদ্র প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এখানেই আসল কথা। ভদ্র সমাজ? ভারতবর্ষ— নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের শাসনাধীন ভারতবর্ষে সেই ভদ্র সমাজ কি আজ ইতিহাস হয়ে যায়নি? বাস্তবিক, এ যেন এক অন্য দেশ। এক অন্য সময়। কয়েক বছরের টানা পরিশ্রমে আমাদের চার পাশটা এমন ভাবেই পাল্টে দিয়েছেন শাসকেরা, যেখানে ‘‘অ্যাবিউজ় কোরো না’’ কথাটা শুনলে দুঃখে আর হাসিও পায় না, চোখে জল আসে। আজ মহাত্মা গাঁধীর মৃত্যুদিনে আততায়ী এসে নিরস্ত্র জনতার দিকে গুলি ছোড়ে, পুলিশ চুপচাপ নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে, আততায়ীকে নতুন নাথুরাম গডসে নাম দিয়ে মানুষ উল্লাস করে। মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর— হরদীপ সিংহ পুরীর সহকর্মী— বার্তা দেন প্রতিবাদী মাত্রকেই গুলি মারো। সর্ববৃহৎ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, গুলি মেরে বিক্ষোভকারীদের শিক্ষা দাও! পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শীর্ষ নেতা দিলীপ ঘোষ বলে দেন, প্রতিবাদী মেয়েদের যে ‘আরও অনেক কিছু’ করা হচ্ছে না এই তাদের ভাগ্য। এমন একটা দেশে কেউ অভদ্রতা করলে এক মুহূর্ত সহ্য কোরো না, ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলো— এই নীতিবাক্য শুনলে কেমন লাগতে পারে আমাদের?
গভীর দুঃখের গহনে দাঁড়িয়ে তাই প্রশ্ন, অ্যাবিউজ়ও কি এক রকমের? দেশ থেকে বার করে দাও, রাস্তায় বসে মরুক তবু ওদের কথা শুনো না— এগুলোকে কী বলব? অশালীনতা, অভদ্রতা হিসেবে গণ্য হবে এ সব, না কি স্বাভাবিকতা হিসেবেই?
সবচেয়ে বড় কথা, কোনটা উচিত কাজ কোনটা অনুচিত, এই সব প্রশ্ন কে আজ তুলবে, কী ভাবেই বা তুলবে, সেটাই তো আমরা আর জানি না! প্রতিবাদ করলেই গ্রেফতার, বলপ্রয়োগ, গুলি খাওয়ার নিদান। দিল্লির ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্ন তুলতে গিয়েই মার খেয়েছে। কী ঘটছে চার দিকে, বন্ধ অচল কাশ্মীরের মানুষজন কী রকম আছেন, শাহিন বাগের রাস্তায় একনাগাড়ে বসে থাকা মানুষগুলো কী চাইছেন, এই সব প্রাত্যহিকতার কথা জিজ্ঞেস করাও আজ বন্ধ, জিজ্ঞেস করলে সাংবাদিকেরাও নিগৃহীত হচ্ছেন। সরকারি আইন বিষয়ে প্রশ্ন তুললে পুলিশ প্রতিবাদীকে তুলে নিয়ে গিয়ে অকথ্য অত্যাচার করছে, আইনের বিরুদ্ধে মিছিলে গেলে শাস্তিস্বরূপ তাঁদের বাড়ি ভাঙচুর করে, প্রাণের ভয় দেখানো হচ্ছে। কার প্রতি জ়িরো টলারেন্স?
বাস্তবিক, সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা বলে দেয়, কেবল নিজের কাজটুকু করতে গিয়ে তাঁরা যে পরিমাণ ‘হ্যারাসমেন্ট’ গত কয়েক বছরে সহ্য করেছেন, মার খাওয়ার ভয়ে সশঙ্ক ও চাকরি খোয়ানোর ভয়ে বিনিদ্র দিনরজনী কাটিয়েছেন, জরুরি অবস্থাতেও তেমন ঘটেনি। গোটা বিশ্বে সাংবাদিক নিগ্রহের শীর্ষে এখন এই দেশ।
আর তাই, আজ এক সাংবাদিক তথা ব্যক্তি-নাগরিকের ‘নিরাপত্তা’, ‘স্বাধীনতা’ ও ‘নিজের পরিসর’ নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে এত উদ্বেল হতে দেখে মন সত্যিই ভরে যায়। সেই ভরপুর মনে প্রশ্ন ওঠে, ডিসেম্বর ১১-১২ নাগাদ সিএএ প্রতিবাদ চলাকালীন যে চোদ্দো-পনেরো জন সাংবাদিক মারাত্মক রকমের আক্রান্ত হলেন দেশ জুড়ে, তাঁদের ‘নিরাপত্তা’র কথা কেউ ভেবেছিলেন কি না। তাঁদের নিগ্রহকারীরা তো এখনও রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছেন, নিষিদ্ধ হননি!
আরও একটা কথা। নীতি সব সময়েই বিশুদ্ধ হওয়া উচিত। প্লেনের সহযাত্রীটি কে, তার ওপর নিশ্চয়ই অন্যায়কারীর অন্যায়ের বিচার নির্ভর করে না। কিন্তু সেই সহযাত্রী যদি একই দোষে দোষী, এবং বহুগুণ বেশি দোষী হন, তা হলে অন্তত অন্যায়কারীর শাস্তির সঙ্গে সহযাত্রীর শাস্তিও দাবি করা যায়! প্রশ্ন করা যায়, ত্বরিত ভিত্তিতে ও তড়িৎ গতিতে যাঁকে নিরাপত্তাদানের এত ব্যবস্থা, সেই ভদ্রলোক অন্যদের লাগাতার এমন ভয়ানক আক্রমণ ও মানসিক নির্যাতন করেন কোন অধিকারে— চ্যানেলের পরিসরও তো জন-পরিসরই বটে। অর্ণব গোস্বামীদের কর্তারাও হয়তো মানবেন যে তাঁদের কাজকর্মের ধরনটা ঠিক ‘ন্যুইসান্স’-এ আবদ্ধ থাকে না, ‘অ্যাবিউজ়’-এর গোত্রেই অবনমিত হয়। চিৎকৃত গালাগাল আর অনর্গল মিথ্যার উচ্চারণের নাম যে সাংবাদিকতা, এঁরাই এই দেশকে সে কথা শিখিয়েছেন। শশী তারুর, জিগ্নেশ মেবাণীদের অসহনীয় অসম্মান ভোলা যায় না। তাঁরা সাক্ষাৎকারে রাজি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা সৌজন্যবশত, যে সৌজন্যের পাল্টা ছিটেফোঁটা ভদ্রতাও তাঁরা পাননি সাক্ষাৎপ্রার্থীর কাছ থেকে। এ তো কেবল এক বা কতিপয় সাংবাদিকের একক সাফল্য নয়, আজ এই ‘মডেল’-এর সাংবাদিকতাই হল মূলস্রোত। কোনও মুখোমুখি বৈঠকে লাগাতার অপমান ও অসৌজন্যের বন্যা বইয়ে হাততালি কুড়নোটাই আজ সফল সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
কেবল সংবাদমাধ্যমেই এই আক্রমণ-সংস্কৃতির রেশ সীমাবদ্ধ, ভাবলে ভুল হবে। এই কয়েক বছরের প্রাত্যহিক শ্রবণ-অভ্যাস ভারতীয় সমাজকে রপ্ত করিয়েছে অশিক্ষা অসৌজন্য অপমান আর আক্রমণের সংস্কৃতি, যা দিয়ে যে কোনও ‘অন্য’ ভাবনাকে দুরমুশ করে দেওয়া সম্ভব। আর আছে মিথ্যার চর্চা। জামিয়া মিলিয়া ইউনিভার্সিটির সামনে আবির্ভূত বন্দুকধারীর পরিচয় নিয়েও মিথ্যা প্রচার চলল এই চ্যানেলেই, টানা কয়েক দিন ধরে। নিগ্রহের সঙ্গে অনাচার ও অন্যায় কারবারের ফারাক কতটা, তাও একটা বিবেচনার বিষয় হয়ে উঠছে নিশ্চয়।
আসল কথা, এই নতুন ভারতে সাংবাদিকদের একাংশ যখন প্রবল আশঙ্কায় দিন কাটান, অন্য অংশের জন্য বিছানো থাকে ব্যাপ্ত ও প্রসারিত নিরাপত্তার চাদর। কয়েক মাস আগে অর্ণব গোস্বামী এক মুসলিমকে অনবরত মৌখিক আক্রমণের সামনে ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলানোর চেষ্টা করেন। এনবিএসএ (নিউজ় ব্রডকাস্টিং স্ট্যান্ডার্ডস অ্যাসোসিয়েশন) শো-কজ় করে নোটিস পাঠালে তিনি ও তাঁর চ্যানেল তা গ্রহণ করেননি। মাত্র দুই সপ্তাহে ‘আলাদিনের দৈত্য’ গজিয়ে তোলে একটি প্রতিযোগী সংগঠন এনবিএফ (নিউজ় ব্রডকাস্টার ফেডারেশন)। একই দায়িত্বে, একই ভূমিকায়, পার্থক্য কেবল একটাই। পুরনো অ্যাসোসিয়েশনটির শীর্ষে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, নতুন ফেডারেশনটির শীর্ষে স্বয়ং অর্ণব গোস্বামী!
অর্থাৎ, হরদীপ সিংহ পুরীরা যা সরাসরি বলতে পারছেন না, তাঁদের কাঙ্ক্ষিত ‘টলারেন্স’-এর একটা দিক যদি হয় ‘জ়িরো’, অন্য দিকটা একেবারে হান্ড্রেড পারসেন্ট। কোন দিকটা কার জন্য বরাদ্দ, তা বুঝে নেওয়াই এখন ভারতবাসীর কাজ। সমগ্র দেশের সামনে শাসকের এই প্রচ্ছন্ন নীতিটি আর এক বার প্রকট করে দিলেন কুণাল কামরা। সুতরাং কুণালের অভদ্রতা প্রশ্নাতীত হলেও, তাঁকে একটা বিরাট ধন্যবাদ না জানিয়ে পারা যাচ্ছে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy