স্বাভাবিক পুনরাবৃত্তির ধর্ম হইল, তাহা চূড়ান্ত অস্বাভাবিক ঘটনাকেও ক্রমে স্বাভাবিক করিয়া তোলে। বিধ্বংসী আগুনে কলিকাতার কোনও বস্তির মানুষ সর্বস্ব হারাইবেন; আজীবনের সঞ্চয় হারাইয়া কোনও প্রৌঢ়া শূন্য দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিবেন; পুড়িয়া যাওয়া ঘর হইতে কোনও ছাত্রী প্রাণপণে তাহার বইখাতা উদ্ধার করিতে থাকিবে; কোনও গৃহবধূ তাঁহার ভস্মীভূত সংসারের সম্মুখে কান্নায় ভাঙিয়া পড়িবেন— এই দৃশ্যগুলি এখন এমনই স্বাভাবিক যে, সেগুলি সংবাদমাধ্যমের চিত্রগ্রাহকের ক্ষণিক মনোযোগের অধিক আর কিছুই দাবি করে না। মহানগর জানে, আগুন লাগিয়াই থাকে। বাগবাজারের বস্তির আগুনও সেই স্বাভাবিকতারই আর একটি অধ্যায়মাত্র। আগুন কেন লাগে, সেই প্রশ্নের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় না। তদন্তের ফলাফল কী হইল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাহা জনগণের অগোচর থাকে। পরিবর্তে যাহা শোনা যায়, তাহা পরস্পরবিরোধী কিছু অভিযোগ। কেহ বলেন, বস্তিবাসীদের অসতর্কতা, এবং আইন না মানিবার প্রবণতাই এই বিপদ ডাকিয়া আনে; কেহ অভিযোগ তোলেন প্রোমোটার-চক্রের দিকে; কেহ দায়ী করেন সরকারকে। কিন্তু, কোন ক্ষেত্রে ঠিক কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটিতেছে, তাহা সচরাচর প্রকাশ পায় না। ফলে, সাবধানতা অবলম্বনের পরিসরটিও তৈরি হয় না। ‘স্বাভাবিক’ নিয়মেই অগ্নিকাণ্ড ঘটিতে থাকে।
তাহার সঙ্গে, কোথাও আগুন লাগিলে সংবাদমাধ্যমের কর্মী, পুলিশ ও দমকলকর্মীদের উপর স্থানীয়রা চড়াও হইবেন; ক্যামেরা ভাঙা হইবে, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর হইবে; দমকলকে কাজে বাধা দেওয়া হইবে— ইহাও পশ্চিমবঙ্গে ‘স্বাভাবিক’। আগুনে সর্বস্ব পুড়িয়া যাইতে দেখিলে মাথার ঠিক থাকে না, যাহাকে সম্মুখে পাওয়া যায় তাহাকেই দোষী ঠাহরাইতে ইচ্ছা করে— এই কথাগুলি সত্য; কিন্তু তাহাতে নাগরিক-কর্তব্য হইতে নিষ্কৃতি মিলে না। নাগরিককে বুঝিতে হইবে, তাঁহাদের ক্ষতির জন্য এই কর্মীরা দায়ী নহেন; বরং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এই দমকলকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিকরা তাঁহাদেরই স্বার্থরক্ষা করিয়া চলিতেছেন। তাঁহাদের কর্তব্যে বাধা দেওয়া অন্যায়, আইনত দণ্ডনীয়। মানুষকে এই কথাটি বুঝাইবার দায়িত্ব প্রশাসনের। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করিয়া কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা বিধেয়। অবশ্য, কথাটি শুধু অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রেই নহে, সর্বত্র প্রযোজ্য। কোনও দুর্ঘটনা ঘটিলেই পুলিশ বা সাংবাদিকদের নিগ্রহ করা রাজ্যের দস্তুর হইয়াছে। পুলিশের আত্মরক্ষার তবু উপায় আছে, সাংবাদিকদের নাই। তাঁহাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাজ্য প্রশাসনকেই লইতে হইবে। এক দিকে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অন্য দিকে শাস্তির ভয়, এই জোড়া অস্ত্র ব্যবহার না করিলে চলিবে না।
প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরই একটি প্রশ্ন উঠে, এবং আগুন নিভিবার পর সেই প্রশ্নটিও ক্রমে চাপা পড়িয়া যায়— শহরের প্রাণকেন্দ্রে এমন বস্তি থাকিবে কেন? বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের কথা বিভিন্ন আমলে আলোচিত হইয়াছে। তাঁহাদের জন্য বিকল্প বাসস্থান নির্মিত হইয়াছে। কিন্তু, শেষ অবধি তাঁহাদের পুনর্বাসন ও বস্তি উচ্ছেদের কাজটি হইয়া উঠে নাই। বারংবার তাহা রাজনীতির স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছে— অভিযোগ, সেই খেলায় বস্তিবাসী নিছক বোড়ে হিসাবেই ব্যবহৃত হইয়া থাকেন। সমস্যাটির সমাধানে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার গুরুত্ব বাড়াইয়া বলিবার উপায় নাই। শহরের উপর, এবং সুস্থ জীবনের উপর বস্তিবাসীর অধিকারের প্রশ্নটিকে অস্বীকার না করিয়া, আবার বস্তিমুক্ত নাগরিক পরিসরের গুরুত্বের কথাটি মাথায় রাখিয়া একটি বহুজনগ্রাহ্য সমাধানসূত্রে উপনীত হওয়া প্রয়োজন। পুড়িয়া যাওয়া বস্তির স্থলেই ফের ঘর বানাইয়া দেওয়া সেই সমাধান কি না, নাগরিক পরিসরে সেই তর্ক হওয়া প্রয়োজন। নচেৎ, এই অস্বাভাবিকের স্বাভাবিকতা অব্যাহত থাকিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy