নজরুল ইসলাম।
‘আর কত কাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/ স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল।’
এ ভাবেই শুরু হয়েছিল লেখা। নাম— ‘আনন্দময়ীর আগমনে।’ কবির নাম? বলার অপেক্ষা রাখে না। নজরুল ইসলাম। এই কবিতা লেখার অপরাধে নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড হয়েছিল। নজরুলের এই কারা-জীবন মুর্শিদাবাদের মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নজরুলের কারা জীবনের শেষ কয়েক মাস কেটেছিল মুর্শিদাবাদের বহরমপুর জেলে।
‘আনন্দময়ীর আগমনে’র প্রকাশিত হয়েছিল ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ এ। নিজের ‘ধুমকেতু’ পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল কবিতাটা। ‘ধুমকেতু’ তখন শুধু একটা পত্রিকা নয়, একটা ঝড়। বিপ্লবীদের মধ্যে প্রবল প্রভাব এ পত্রিকার। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লেখা জ্বালাময়ী এই কবিতা বিপ্লবীদের প্রাণিত করল দারুণভাবে। কিন্তু বিদেশি শাসক ভাল চোখে দেখল না ব্যাপারটা। এমনিতে ‘ধুমকেতু’র উপর তাদের নজর ছিলই। এ বারে ঘৃতাহুতি হল। ৮ নভেম্বর পুলিশ এল ‘ধুমকেতু’র অফিসে। ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা এবং এগারো বছরের বালিকা লীলা মিত্রের ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ নামের ছোট্ট প্রবন্ধটির জন্য পুলিশ ‘ধুমকেতু’র ওই তারিখের সমস্ত সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করল। নজরুলকেও ধরতে এসেছিল তারা। কিন্তু নজরুল তখন কলকাতার বাইরে। নজরুলকে পুলিশ ২৩ নভেম্বর ১৯২২ তারিখে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করল। নিয়ে এল কলকাতায়। নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা হল শুধু তাঁর কবিতাটার জন্যই।
প্রেসিডেন্সি জেলে বিচারাধীন বন্দি হিসাবে কিছু দিন থাকার পর, ১৬ জানুয়ারি ১৯২৩, নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ হল। পরদিন, ১৭ জানুয়ারি সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হিসাবে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। এরপর হুগলি জেল হয়ে নজরুলকে বহরমপুর জেলে আনা হল ওই বছরের ১৮ জুন।
হুগলি জেলে নজরুল প্রথমে বিশেষ শ্রেণীর কয়েদির মর্যাদা পাননি, যদিও রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে তা তাঁর প্রাপ্য ছিল। হুগলি জেলে নজরুলের ৩৯ দিনের অনশন আলোড়ন তুলেছিল সারা বাংলায়। এই অনশনের পর নজরুলকে বিশেষ শ্রেণির কয়েদি হিসাবে গন্য করার নির্দেশ আসে। কিন্তু সে নির্দেশ কার্যকর করা হয়নি।
সে দিক দিয়ে বহরমপুর জেল ছিল অনেকটাই অন্যরকম। এখানে তিনি বিশেষ শ্রেণীর কয়েদি হিসাবেই আসেন। যদিও নজরুল এখানেও সাধারণ কয়েদিদের মতোই পোশাক পরতেন। এই জেলের পরিবেশ নজরুলকে খুশি করেছিল। জেলে থাকাকালীন মুজফফর আহমদকে গোপনে লেখা একটা চিঠিতে রয়েছে, বহরমপুর জেলে তাঁর ভাল থাকার কথা। সে সময় বহরমপুর জেলের সুপার ছিলেন বসন্ত ভৌমিক। বসন্তবাবু ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রফুল্লকুমার সরকারের ভগ্নিপতি। নজরুলের লেখাপত্রের খোঁজ তিনি ভালই জানতেন। নজরুলের প্রতি তাঁর মনে যথেষ্ট সহানুভূতি ছিল। তিনি নজরুলকে একটা হারমোনিয়াম জোগাড় করে দিলেন। আর কবিকে কে পায়? চলল গান। জেলের ভিতরের বন্দিরা শুধু নয়, বাইরেও লোকেরা দাঁড়িয়ে নজরুলের গান শুনতে লাগল। হুগলি জেল থেকে নজরুলকে আনার কারণ ছিল, সেখানে বন্দিদের উপর নজরুলের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। বহরমপুরে এসে বাড়ল বই কমল না।
এ দিকে গানের সঙ্গে কবিতা লেখাও চলছে। তাঁর সব লেখাই গোপনে চলে যাচ্ছে বাইরে। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক নজরুলের ছোট বড় যে কোনও কবিতার জন্য দশ টাকা দিয়ে তাঁকে উৎসাহিত করতে লাগলেন। উল্লেখ্য, সে সময় একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউই কবিতার জন্য টাকা পেতেন না। এরই মধ্যে আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে ওই ১৩২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বের হল নজরুলের ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের ১৯টি কবিতা জেলে বসেই নজরুল লেখেন। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা বহরমপুর জেলে বসে লেখা। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ওয়ার্ডারদের সাহায্যে কবিতাগুলো বাইরে আনেন। ‘দোলনচাঁপা’র প্রুফ দেখা, ভূমিকা লেখার (‘দুটি কথা’ শিরোনামে) কাজও করেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়।
বহরমপুর জেলে বসে নজরুলের সবচেয়ে বড় সাহিত্যি কীর্তি সহবন্দী পূর্ণ দাসের অনুরোধে একটি নাটক লেখা। পূর্ণ দাস বাইরে গিয়ে একটি চারণদল গঠন করবেন, সেই চারণ দলের অভিনয়ের উদ্দেশ্যে তিনি নজরুলকে একটা নাটক লিখে দেবার অনুরোধ করেন। এই নাটক লেখার কথা নজরুল বলেন মুজফফর আহমদকে, চিঠিতে। অন্যান্য রচনার মত এ রচনাও জেলের বাইরে পাচার হয়। কিন্তু তার পর এর আর হদিশ মেলে না। নাটক হারিয়ে গেলেও এই নাটকের একখানা গান কিন্তু রক্ষা পায়। সে গান এখন বিখ্যাত। ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছে জুয়া।’
তবে বহরমপুর জেলের জীবন একেবারে নিষ্কন্টক ছিল না। প্রিজন অ্যাক্ট ভাঙার অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে এখানেই আবার একটা মামলা হল। ওই বছরেরই ১০ ডিসেম্বর তাঁকে হাজির করা হল বহরমপুরের সাব ডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেট এন কে সেনের আদালতে। এ দিন বহরমপুর কবির পাশে দাঁড়িয়ে অনন্য নজির স্থাপন করল। ব্রজভূষন গুপ্তের নেতৃত্বে শহরের হিন্দু মুসলমান উকিলেরা কবির হয়ে লড়াই করলেন। পুলিশের অনুরোধে ১৪ ডিসেম্বর পরবর্তী মোকদ্দমার দিন পড়ল। কিন্তু সে মোকদ্দমা ১০ তারিখের কথা মনে করেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক সরকার আর চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইল না। ১৫ ডিসেম্বর মুক্তি পেলেন নজরুল। নজরুল মেয়াদ শেষ হবার আগে মুক্তি পেয়েছিলেন, এমন ভাববার কিন্তু কোনও কারণ নেই। মুজফফর আহমদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, জেল আইন অনুসারে সে সময় মাসে তিন দিন করে রেমিশন পাওয়া যেত। সেই হিসাবে দশ মাসে তিনি ত্রিশ দিন রেমিশন পেয়ে ঠিক সময়েই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। মুক্তির দিন কৃষ্ণনাথ কলেজের ছেলেরা মিছিল করে নজরুলকে নিয়ে গেলেন সায়েন্স মেসে। পরে নজরুল এসে উঠলেন নলিনাক্ষ সান্যালের বাড়িতে। এখানে সেসময় কয়েকটা দিন তিনি থেকেও গেলেন। নজরুলের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। যে ক’দিন তিনি এখানে ছিলেন বহরমপুরের যুব সম্প্রদায় নজরুলের গান দিয়ে শহর মুখর করে তুলেছিল।
নজরুলের কারাজীবনে পূর্ণ দাস, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ যাঁরা তাঁর সহবন্দি ছিলেন বহরমপুর জেলে, সকলের কাছেই জেলজীবন নজরুলের গানের স্পর্শে, প্রাণের উচ্ছলতায় অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। আর বহরমপুরের মানুষ কবির কারাবাস কালে তাঁর পাশে থাকতে পেরে, কারাবসানে তাঁকে সম্বর্ধিত করতে পেরে হয়েছিল ধন্য। সেদিনের সেই ঘটনা এই মফসসল শহরে আজও, প্রায় শতবর্ষ পরেও কিন্তু রয়ে গেছে এক টুকরো গর্বের ইতিহাস হয়ে।
শিক্ষক
তথ্যঋণ:
‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’/মুজফফর আহমদ
‘নজরুল -চরিত মানস’/
ডক্টর সুশীলকুমার গুপ্ত
‘কাজী নজরুল ইসলাম’/
নিতাই বসু
‘নজরুল ও ধুমকেতু’/
সারোয়ার জাহান (প্রবন্ধ,’দেশ’ সাহিত্য সংখ্যা,১৩৯৭)
‘জেলে গাইছেন নজরুল,বাইরে শুনছে বহরমপুর’/
শক্তিনাথ ঝা (প্রবন্ধ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy