কাজী নজরুল ইসলাম।
রাঢ়ের মাটিতে অজয় নদের মোটামুটি এ-পাড় ও-পাড়ে এমন দু’জন মানুষ রয়েছেন, যাঁদের নাম প্রায় এক সঙ্গে উচ্চারিত হয়— রবীন্দ্র-নজরুল। এই দু’জন মানুষ বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে এক বাঁধনে বেঁধেছেন, বিভক্ত দেশের সব সীমারেখা মুছে দিয়ে। বলা চলে বাঙালির সংস্কৃতিকে অবিচ্ছেদ্য করে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম।
এই পরিবেশে কিছুটা কুণ্ঠা সত্ত্বেও স্বীকার করে নিতে হয় আমাদের নজরুল চর্চার খামতির কথা। বাংলাদেশের কিছু উদ্যোগ সাধুবাদ জানানোর মতো হলেও এখন অনেক কাজ বাকি রয়েছে। সে কাজ নজরুল সাহিত্য অর্থাৎ নজরুলের লেখা সাহিত্য নির্ভর ‘সেকেন্ডারি ডেটা’ বিশ্লেষণ মূলক গবেষণা প্রবন্ধ রচনার কাজ নয়। সে কাজ হল নজরুলের দর্শনের উৎসে পৌঁছনোর। অন্তত আজকের পৃথিবীতে যখন মানুষ সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হতে হতে ক্রমশ ছোট হতে বসেছে, শেষ হতে বসেছে সম্প্রীতি, সমানুভাবের মতো শব্দমালা, তখন বোধহয় নতুন করে কাজী নজরুল প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন আমাদের চর্চায়, আমাদের মননে এবং সর্বোপরি যাপনে। চুরুলিয়া ঘেঁষে আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বর্তমান রাজ্য সরকারের অন্যতম উদ্যোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ‘নজরুল সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ়’।
সেন্টারের নামকরণের গুরুত্ব লক্ষ করার মতো। সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণা বা অধ্যয়নের একটি বিশেষ স্থান উঠতে চায় এই সেন্টার। যার কেন্দ্রভাবনা অবশ্যই নজরুলের মানবভাবনা দ্বারা সঞ্চালিত ও পুষ্ট। যে জাতিগত বা সাংস্কৃতির বহুত্বের কথা নজরুল বলেছেন তাকে কী ভাবে আজকের পৃথিবীর কাছে ব্যবহার করা সম্ভব তা খতিয়ে দেখতে চায় এই সেন্টার। নজরুলের জীবন এবং সৃষ্টি যে মেহনতি মানুষের অর্থাৎ শ্রমিক, কৃষক ও অবহেলিত মানুষের অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের কথা বলে, অসাম্প্রদায়িক মানবতার বাতাবরণ তৈরির কথা বলে, তাকে নতুন করে আজকের পৃথিবীতে গ্রাহ্য করে তোলা বড় বেশি প্রয়োজন।
সেন্টার তাই কাজের ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিতে চায় নজরুলের অনুবাদে। দেশিয় ও বিদেশি ভাষায় অনুবাদের কাজ শুরুর অপেক্ষায়। ইংরেজি ও নেপালি ভাষায় অনুবাদের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। হিন্দি, উর্দু, সিন্ধি ছাড়া অন্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদের কাজও শুরু হবে। নজরুলের মানবতার দর্শনে ভাষা ও সংস্কৃতির বহুত্বের দিকগুলি নিয়ে ইতিমধ্যেই কাজ চলছে। প্রকাশনার অপেক্ষায় নজরুলের নির্বাচিত কবিতার সটীক সংস্করণ। সারা পৃথিবীর যে সব দেশে ইতিমধ্যেই নজরুলের সাহিত্য অনূদিত হয়েছে কিংবা আলোচিত হয়েছে সে সব সংগ্রহ করা এবং আরও বেশি করে নজরুল পাঠ চালু করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় এই সেন্টার। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় অবস্থিত ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়’এর সঙ্গে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে গবেষণা ও প্রকাশনার কাজ যুগ্মভাবে করার বিষয়ে। নজরুলের চিন্তা, চেতনা ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে নিয়মিত আন্তর্জাতিক কনফারেন্স আয়োজন করে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়।
নজরুল সঙ্গীত, শিক্ষা এবং মূল গ্রামোফোন রেকর্ড করা বিষয়কে সম্প্রচার ও সম্প্রসারণের কাজ সেন্টার করতে চায় গুরুত্ব সহকারে। ইতিমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে নজরুলগীতির স্নাতক স্তরের পাঠ্যক্রম। বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা নথিভুক্ত হয়েছেন এই পাঠ্যক্রমে। নজরুলের গানের পাঠ্যক্রমকে সম্পূর্ণ করতে আরবি, ফারসি ভাষা শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে এই সেন্টারের। নজরুলগীতি ও সমসাময়িক রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গীতভাবনার তুলনা ও তাঁর বিশেষত্ব নিয়েও গবেষণার কাজ শুরু হয়েছে ইতিমধ্যেই। নিয়মিত নজরুল চর্চার অঙ্গ হিসেবে আলোচনাসভা, কর্মশালা, বিশেষ বক্তৃতামালার আয়োজন করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট নজরুল বিশেষজ্ঞ গবেষক, শিল্পী, অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। শুধু বক্তৃতা নয়, আলোচনার জন্য একটি খোলামেলা মঞ্চ তৈরি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এই কেন্দ্র। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বিশিষ্ট নজরুল গবেষকেরা সেন্টারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন। আমেরিকার নজরুল গবেষকেরাও রয়েছেন সেন্টারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে। আমেরিকার নজরুল গবেষক রাচেল ম্যাকডারমট, ফুলব্রাইট প্রফেসর স্কলারশিপ প্রাপ্ত অধ্যাপক লিজেল স্কোয়াব আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন। হায়দরাবাদের ‘এপলু’-র বিশিষ্ট অধ্যাপক ও ভাষাবিজ্ঞানী ঈপ্সিতা চন্দ আলোচনা করেছেন আজকের পৃথিবীতে জাতিগত ও সংস্কৃতিগত বহুত্ব এবং নজরুলের ভূমিকা তথা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। কাজী নজরুল ইসলামের নানা কৃতির কথা মাথায় রেখে নজরুলের অভিনীত নাটক ও ব্যবহৃত গানে তাঁর সুরারোপের বিচিত্র এষণা নিয়ে কাজ এগিয়েছে বেশ খানিকটা। আদি গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ডিজিটাইজেশনের কাজ করার কাজে এগিয়ে আসতে চায় এই সেন্টার। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কবিতীর্থ চুরুলিয়ার নজরুল অ্যাকাডেমির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় তথা সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ় এক যোগে প্রতি বছর নজরুল জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে মে-তে আয়োজন করে সপ্তাহব্যাপী নজরুল মেলা। নজরুলচর্চা শহরকেন্দ্রিক মানুষকে চুরুলিয়ামুখী করে তোলে এক সময়। চুরুলিয়াকে কেন্দ্র করে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য সাধারণ মানুষের যোগদানকে নিশ্চিত করার পরিকল্পনাও রয়েছে অদূর ভবিষ্যতে। এর সঙ্গে নজরুলের সাহিত্যকর্মের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে তার অথিন্টিকেশন ও কপিরাইট সংরক্ষণের কাজ, একটি আধুনিক সংগ্রহশালা তৈরি যেখানে আধুনিক ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা যাবে এবং কমিউনিটি রেডিয়োর পরিকল্পনাও রয়েছে।
লেখক নজরুল সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ়ের ডিরেক্টর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy