কাশ্মীরের জওয়ানরা এত দিন জানিতেন, উপত্যকার জনসাধারণ মোটেই তাঁহাদের প্রতি সদয় নন। ফলে রবিবার কাশ্মীরে জঙ্গি আক্রমণে নিহত সিআরপিএফ জওয়ান মহম্মদ ইয়াসিন তেলির শেষকৃত্য উপলক্ষে কয়েক শত মানুষকে অপ্রত্যাশিত ভাবে জড়ো হইতে দেখিয়া জওয়ানরা নিজেরাই অত্যন্ত বিস্মিত। দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলায় শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে এত মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভিড় কেহ আশাও করে নাই। সম্প্রতি কালে মানুষ ভিড় করিয়া শেষকৃত্যে আসিতেন জঙ্গি নেতারা নিহত হইলে। প্রবাদপ্রতিম জঙ্গি তরুণ নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর সময়ে তো উপত্যকা প্রায় ভাঙিয়া পড়িয়াছিল। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া এই ভিড় ক্রমশ বর্ধমান, মানুষ বুঝাইয়া দিতেছিলেন যে জঙ্গিদের প্রতি তাঁহাদের স্নেহ ও দুর্বলতা কতখানি গভীর। জঙ্গিদের প্রতি এই স্নেহসিঞ্চিত সমর্থনের পিছনে অবশ্যই জওয়ানদের প্রতি বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণারও একটা বড় ভূমিকা ছিল। যে স্বতঃস্ফূর্ততায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পাথর ছুড়িয়া পুলিশ ও জওয়ানদের নিয়ত আক্রান্ত করিয়া রাখে, জঙ্গি নেতাদের শেষকৃত্যে হাজার মানুষের ভিড়ও ঠিক একই বার্তা সেনা ও সরকারের প্রতি প্রেরণ করে। ইহার মধ্যে হঠাৎ দেখা গেল উলটা ঘটনা। কেবল তেলির ক্ষেত্রে নহে, আরও কয়েক জন নিহত পুলিশ বা সেনা অফিসারের প্রতি জন-সহানুভূতির আন্তরিক প্রকাশ। স্বভাবতই প্রশ্নের মেলা বসিয়া গেল: ইহা কি নেহাতই আপতিক, বিচ্ছিন্ন ঘটনা? না কি উপত্যকার মানুষের মন বদলাইতেছে? অন্তত তাহার কিয়দংশের মধ্যে কোনও ভিন্ন ভাবনা দানা বাঁধিতেছে? ইত্যাদি।
কাশ্মীরি সমাজের সহিত সেনাবাহিনীর তীব্র তিক্ত শত্রুতা অনেকগুলি দশকের উত্তরাধিকার। বছরের পর বছর জঙ্গি-সেনা সংঘর্ষে সাধারণ কাশ্মীরি নাগরিকের প্রাণ ওষ্ঠাগত। এলোপাথারি ধরপাকড়, গ্রেফতার, বন্দিদের উপর নৃশংস অত্যাচার, নারী নির্যাতন, মাত্রাছাড়া ভাবে চলিয়াছে। তিন দশকে কত মানুষ নিখোঁজ হইয়াছেন, ইয়ত্তা নাই। বহু অনুরোধ উপরোধ, আন্দোলন সত্ত্বেও সেই নিখোঁজ মানুষের স্বজনরা কোনও তদন্ত বা প্রতিকার পান নাই। সেনা-অত্যাচারের দিক দিয়া কাশ্মীর এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের মধ্যেই বেশ উচ্চ স্থানের অধিকারী। গত তিন বৎসরে এই প্রবণতা আরও হুহু করিয়া বাড়িয়াছে। বুরহান ওয়ানির হত্যার পর উপত্যকা চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল ও বিদ্রোহী হইয়া উঠিলে সামরিক অত্যাচারও নির্বিচার হইয়াছে, সেনা-আক্রমণের সামনে নাগরিক ও জঙ্গি ভেদাভেদ মুছিয়া গিয়াছে। পাল্লা দিয়া তীব্র হইয়াছে জঙ্গিদের প্রতি সাধারণ্যের সহানুভূতি। জঙ্গিরা যে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন লড়িতেছে, তাহা অপেক্ষাও যেন মানুষের কাছে বড় হইয়া উঠিয়াছে এই ভাবটি যে, কাশ্মীরি সমাজের প্রতিনিধি হিসাবেই জঙ্গিরা সেনার বিরুদ্ধে লড়িতেছেন।
এই প্রেক্ষিত হইতে দেখিলে, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি সত্যই গুরুত্বপূর্ণ। পর পর কয়েকটি ঘটনায় তরুণ সেনা অফিসাররা যে ভাবে আকস্মিক ভাবে, সন্ধ্যার পার্টিতে, কিংবা নিশ্চুপ দুপুরে মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িয়াছেন, হয়তো তাহাতেই জঙ্গিদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি এই মুহূর্তে কমতির দিকে। নিহত সেনা অফিসার উমর ফয়েজ কিংবা পুলিশ অফিসার ফিরোজ আহমদ দারের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত দুঃখপ্রকাশ করিতে আসিয়াছিলেন সাধারণ মানুষ। নিশ্চয়ই তাঁহারা ভাবিতেছিলেন, উমর এবং ফিরোজও উপত্যকারই সন্তান। ইঁহাদের মধ্যবিত্ত পরিবার এই সব মৃত্যুতে দিশাহারা। এখন প্রশ্ন হইল, এই নূতন মনোভাবের মধ্যে জঙ্গি কার্যক্রমের প্রতি বিমুখতাও আছে কি? সময়ই তাহা বলিবে। রাষ্ট্র বহু চেষ্টা করিয়াও কাশ্মীরের মন পায় নাই। এখন জঙ্গিদের এলোপাথাড়ি বাড়াবাড়িতে কাশ্মীরের সেই মন ফিরিতে পারে কি না, দেখা যাক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy