সে দিন কালীগঞ্জের বারো জন ঘর ফিরলেন পায়ে হেঁটে। কিংবা উত্তরপ্রদেশের এক জন ১৬০০ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে গিয়ে প্রাণ হারালেন মাঝরাস্তায়। মহামারি আর লকডাউনের সময়ে এই খবরগুলো যেন মিশে গিয়েছে আমাদের কাগজের প্রতি ভাঁজে, স্থান নিয়েছে তিরিশ টাকায় করোলা কেনার আক্ষেপের পরের পাতায়। যখন আমার গ্রামের মানুষ বেচে দিতে চায়ছে সাধ করে বোনা বোরো ধান নগণ্য দামে, ঠিক তখনই সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে যাচ্ছে #মাইগ্রেন্টলাইভম্যাটার্স হ্যাশট্যাগে।
তবু শহুরে মানুষ কি প্রশ্ন করছেন— এই মাইগ্রেন্ট বা পরিযায়ী কারা? হঠাৎ দিল্লির বাসস্টপে কিংবা মুম্বইয়ের ট্রেন স্টেশনে ঝাঁক করা এই মুখগুলো এল কোথা থেকে? এরা কি চিরকালই ছিল আর থাকবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আড়ালে?
তবু গ্রামের মানুষেরা কি ভাবছেন— কেন হঠাৎ তাঁদের পূর্বপুরুষের মতো চাষাবাদ তাঁদের খাবার জোগাতে পারে না আর? কেন চাষির ছেলে চাষি হওয়াটা আর কাম্য নয়? বরং তাঁকে দূর দেশে যেতে হয় কোন ঠিকাদারের কথামতো কাজ করতে? কেন কাউকে ঘরে ফিরিয়ে আনা হয় সুদূর ইটালি থেকে আর কেউ ঘরে যেতে চেয়ে মার খায় রাস্তায়? কেন লাঙল যাঁর, তাঁকেই খাবারের জন্য আত্মহত্যা করতে হয়? কেন হাতুড়ি যাঁর, তাঁর সন্তানকে একটা সাইকেল এনে দিতে বছর পেরিয়ে যায়?
আসলে প্রশ্নগুলো সোজা আর উত্তরটাও জানা। কিন্তু একুশ শতকে প্রশ্ন করতে আমাদের ভয় করে! তবে এই ভয় ইতিহাসে প্রথম নয়, নয় প্রশ্ন নিয়ে সময়কে থমকে দেওয়ার মানুষের অদম্য জিঘাংসাও। তাই যখন ‘রোটি, কাপড়া অউর মকান’-এর চাহিদা দেশের অধিকাংশের কাছে সিনেমার বক্তব্য হয়ে দাঁড়াছে, তখন শুনতে পাচ্ছি ২০২ বছরের এক বুড়োর মন্ত্রোচ্চারণ— ‘দ্য পয়েন্ট হাউএভার ইজ টু চেঞ্জ ইট’।
সেই বুড়ো আর কেউ নন, দার্শনিক কার্ল মার্ক্স। যাঁর নাম এই রাজ্যের সবাই জেনেছি ইতিহাসের স্বাভাবিক পথ ধরে। বিশ শতকের শেষ লগ্নে দাঁড়িয়ে আমাদের মতো বিশ্বায়নের সন্তানেরা শুনেছে— ইতিহাস মৃত, ফুরিয়েছে মার্ক্সের প্রয়োজন। তবে পরীক্ষায় মার্কস না পেলে বাবা-মার কাছে যাঁরা দু’-দশ ঘা খেয়েছেন, তাঁরা বোধ হয় এটা মানবেন না। তেমনই মানছে না মহামারির সময়ে উঠে আসা এই প্রশ্নগুলো। যখন স্বয়ং রাষ্ট্রপুঞ্জর গবেষকেরা স্বীকার করছেন এই মহামারি এবং তার পরের ঘটনাবলী ডেকে আনছে বিশ্বজোড়া এক অভাবনীয় মন্বন্তর আর অর্থনীতির সম্ভাব্য মহাপ্লাবন, তখন বয়োজ্যেষ্ঠদের মনে পড়ে যাচ্ছে— বিয়াল্লিশের সিঁদুরে মেঘ। যখন অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সরকারি ভাণ্ডারে জমা আছে সব মানুষের মুখে তুলে দেওয়ার কয়েক মাসের খাবার, তখন প্রশ্ন জাগছে এই খিদের দায় আসলে কার?
আসলে শ্রেণি আর সাম্য শব্দগুলো আমাদের ছোটবেলার অভিজ্ঞতায় এতটা গুলিয়ে গিয়েছে, যে বুঝে পাই না আজও খিদের কারণ— শ্রেণি বিভাজন। একুশ শতকে এই পৃথিবী অনেক বেশি করে তাঁর, যে বেশি কিনতে পারেন।
আমরা ভুলে গিয়েছি, দেশের সংবিধানে খাদ্যের অধিকার বলে একটা আইন আছে আর তার মুখবন্ধে সমাজতন্ত্র বলে একটা কথা আছে। কথা আছে, সব মানুষের জন্য মাথা উঁচু করে বাঁচার একটা উন্মুক্ত পৃথিবীর। ভুলে গিয়েছি, রাজনীতি মানে নির্বাচন নয়, নয় লঙ্কায় গেলে সবাই রাবণ হয় বলে দুঃখ করার দূরবর্তী দ্বীপ। রাজনীতি হচ্ছে খিদের বিরুদ্ধে, রোগের বিরুদ্ধে, দূষিত পৃথিবীর বিরুদ্ধে আপনার সন্তানের জন্য রুখে দাঁড়ানোর পদ্ধতিমাত্র, ঠিক যেমন ভাবে আমায় আর আপনাকে পূর্বপুরুষেরা দিয়ে গিয়েছেন স্বাধীনতা। কিন্তু এ সব পড়ি না আমরা কোনও বইয়ে, কোনও স্কুলে। শেখানো হয়, ইতিহাস আর রাজনীতি শুধু রাজা-রানি আর মন্ত্রি-সেপাইয়ের জাগির।
তাই আমার পাশের বাড়ির ভাইটাকে কাকু-কাকিমা আর বলেন না— পড়াশোনা করে শিক্ষক হও। বরং বিদেশি ফার্মের বারো ঘণ্টার দিনমজুরি তাঁদের কাছে অনেক বেশি কাম্য। আমার মা-বাবাও আর মানতে দ্বিধা করেন, কলমের জোর পয়সার চেয়ে বেশি। তাই এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের একটাই স্বপ্ন, শুধু উপরে ওঠা। শ্রেণির উপরে, মুদ্রার উপরে। ভেবে দেখলে এর সবটাই শুধু খিদের গল্প। গল্প খিদেকে নিজেদের থেকে যারপরনাই দূরে রাখার। তাই নিজের জমিতে ধান ফলানো নয়, পরের শহরে কাজ করাটা এই সমাজে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক হয়ে ওঠে ঠিকাদারি-মজুতদারি, যদি কাল দাম বেড়ে যায়, সেই অছিলায়। এই খানেই ফিরে আসেন মার্ক্স তাঁর শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্ব নিয়ে। আর মে দিবসের ফাঁকা ফ্ল্যাটে কর্মজর্জরিত আমি খুঁজি সাম্যের মিঠে হাওয়া।
এত ক্ষণে ভাবছেন, সেই অনেক বছর আগে শোনা এই বুড়োর নামে আরেকটা গপ্প পড়ছেন? সত্যি বলতে আমারও এমনটাই মনে পড়ত। নামটা শুনলেই মনে হত— ‘‘আবার?’’ তার পর যখন আঠারো বছরে ছাড়তে হল গ্রাম, বাইশ বছরে দেশ, বুঝলাম খিদে কেমন হয়, কেমন হয় অন্য দেশে থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়া— হঠাৎ বুঝতে পারলাম পরিযায়ী শ্রমিক কী, ঘর কাকে বলে আর মার্ক্স কী বলেছিলেন!
বুঝলাম, মার্ক্স আমার ছোটবেলায় দেখা কোনও মূর্তি নন, একটা লাল বইয়ে বাঁধানো কোনও দার্শনিক নন। বরং মহামারি, মন্নন্তর আর শোষণের বুক দিয়ে এগিয়ে যাওয়া একটা পথ। সে পথের এক পাশে আছে রাজা-রানি, মন্ত্রী-সেপাই ও মড়কের গল্প আর অন্য পাশে মানুষ ও যৌথখামারের ইতিহাস।
তাই এই মহামারির সময়ে যখন পড়ি— তেহট্টের এক পেঁয়াজ চাষির যৌথখামারের স্বপ্ন দেখে নিজের সঞ্চয় তুলে দেওয়ার খবর কিংবা শুনি পুরুলিয়ায় এক ইঞ্জিনিয়ার ভাইয়ের কুষ্ঠ রোগাক্রান্তদের গ্রামে যৌথ রান্নাঘর তৈরির গল্প, তখন মনে হয় এই পণ্য আর অর্থের মায়াজাল ঠেলে আজও এগিয়ে যাওয়া যায় সাম্যের দিকে। উত্তোরিত হওয়া যায় সকলের জন্যে খিদেহীন যৌথখামারের স্বপ্নিল বাস্তবে। আদতেই আমাদের শেখানো ক্ষমতাবান ও বিত্তবানের অগ্রাধিকারের শ্রেণিঘরে ইতিহাসের মৃত্যু হয়নি। বরং ইতিহাসের শেষে দাঁড়িয়ে আছেন মার্ক্স— এক পরিবর্তনের ডাক নিয়ে।
আসলে মার্ক্স নেই কোনও মূর্তিতে, নেই ক্ষমতাবান কোনও একটা দলের শাসনে, নেই বিত্তবানের বিশ্বায়নে। আছেন ঘরে-ঘরে সবার খেতে পাওয়ার স্বপ্ন হয়ে। আছেন এই সভ্যতা যাঁরা নির্মাণ করেন, সেই শ্রমজীবী ভাইদের মাথায় ছাদের অধিকার হাতে। মার্ক্স দাঁড়িয়ে আছেন মাটিতে জন্মে পরিযায়ী না হওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে। আর শেষ অবধি, আমার-আপনার সবার উত্তর প্রজন্মকে একটা খিদেহীন, দূষণহীন, মানুষের জন্য, মানুষের পৃথিবী এনে দেওয়ার স্বপ্ন হয়ে।
তাই আজ তাঁর জন্মদিনে আগত ক্ষুধার বুকে অন্ন নিয়ে, গৃহহীনের সামনে ছাদ নিয়ে আর রোগের বুকে সবার আরোগ্যের অধিকার নিয়ে ফিরে দেখি ১১৩ বছরের যুবকটিকে— কোনও মিথ নয়, বিবর্তনশীল ইতিহাসের ডাক হিসাবে। বুঝে নিই— ‘‘আসলে এই সভ্যতা শুধু এক কৃষকের / বোনা বীজ আর কাস্তের প্রেমের গল্প, / এইখানে সব রাজারাণীর চরিত্রই নবীন।’’
লেখক সুইডেনের চালমার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ও এথিক্সের গবেষক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy