কাননবালার ভাই পুলিনবিহারী। ছবি লেখকের সৌজন্যে
ইতিহাস লেখা হবে কোন উপাদান দিয়ে! স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথমসারির নেত্রী। তিনবার কারাবরণ করেছিলেন। জেলা থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। অথচ এমন নেত্রীর একটা ছবি মেলে না। নথিপত্রের কথা ছেড়েই দেওয়া গেল। স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া এমন বহু মহীয়সী ছিলেন মেদিনীপুরে। তাঁদেরই একজন কাননবালা দাসপট্টনায়ক। বৃহত্তর দাঁতন থানার (সমগ্র মোহনপুর এবং বেলদা থানার কিছু অংশ) সাহসী সংগ্রামী নেত্রী।
কাননবালার জন্ম আঙ্গুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে পলাশিয়া গ্রামে। আনুমানিক ১৯০১ সালে। বাবা শ্রীকান্ত মহাপাত্র। একসময়ে শ্রীকান্ত মহাপাত্র সপরিবারে কাঁথি মহকুমার দেশপ্রাণ ব্লকের বসন্তিয়া গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। বর্ধিষ্ণু এই গ্রামেই কন্যা কাননবালার পড়াশোনা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হওয়া। কাননবালার বিয়ে হয় দাঁতন থানার পোরলদা গ্রামের জমিদার গজেন্দ্র দাসপট্টনায়কের সঙ্গে। তাঁদের পুত্র সুধীর দাসপট্টনায়ক। পুত্র তখন নাবালক। মৃত্যু হয় কাননবালা দেবীর স্বামীর। প্রিয়জনকে হারিয়েও সক্রিয় ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে সামিল হন।
পুলিনবিহারী মহাপাত্র কাননবালার ভাই। তিনিও ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। পুলিনবিহারীর পুত্র সরোজ জানালেন, তাঁর বাবা দাঁতন থানার পোরলদাতে এসে এই দাসপট্টনায়ক জমিদার পরিবারে বিয়ে করে ঘরজামাই থেকে যান। তিনি কাঁথির জাতীয় বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন। ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র মালের ছাত্র। দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল প্রতাপদিঘিতে জনসভা করেছিলেন। সেই সভার আয়োজক ছিলেন পুলিনবিহারী। এই অঞ্চলে স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে পুলিনবিহারীর মৃত্যু হয়।
গাঁধী ১৯৩০ সালে ১০ এপ্রিল ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় নারী সমাজকে আন্দোলনের যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। নারীদের অংশগ্রহণের দিক থেকে মুম্বইয়ের আন্দোলন ছিল সবথেকে সংগঠিত, মাদ্রাজের আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো আর বাংলায় আন্দোলন ছিল সবচেয়ে আক্রমণাত্মক। মেদিনীপুর জেলায় আইন অমান্য আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলা প্রদেশের সচিব এইচ ডব্লিউ এমারসন ১৬ জুলাই মেদিনীপুর জেলার ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে গর্ভনরকে চিঠি লেখেন। তিনি জানান, কংগ্রেসের আন্দোলনে জেলার বহু গ্রাম প্রভাবিত হয়েছে। ফলে গ্রামের জনসাধারণ লবণ আইন ভাঙতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং প্রতিটি ঘরে গড়ে উঠেছে সত্যগ্রহ ক্যাম্প। তাই পুলিশের পক্ষে ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নজর রাখা ছিল অসম্ভব।
লবণ আইন ভঙ্গকে কেন্দ্র করে জেলার বিভিন্ন থানায় ব্যাপক আন্দোলন চলতে থাকে। দাঁতন থানা এলাকায় লবণ জল এবং মাটি পাওয়ার সুবিধা ছিল না। তাই কর্মকর্তারা কর্মীদের পিছাবনি লবণ ক্ষেত্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু বর্ষা চলে আসায় কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী, চৌকিদারি ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলনে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। প্রসন্নকুমার গিরি, চারুচন্দ্র মোহান্তি, প্রবীরকুমার দাস, পতিতপাবন ব্রহ্ম, নগেন্দ্রনাথ দাস প্রমুখ নেতা ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতির জন্য জনসংযোগের কাজে বিশেষ মনোযোগ দেন। সরকারের ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য সভা সমিতির ব্যবস্থা করেন। উল্লেখযোগ্য একটি সভা হয় দাঁতন থানার রানিসরাই হাটে। (বর্তমান বেলদায়)। এখানে প্রতি বৃহস্পতিবার হাট বসে। হাটটি আবার পঞ্চদুর্গা হাট নামে পরিচিত। এই সভার সভানেত্রী ছিলেন দাঁতন থানার প্রধান নারীকর্মী কাননবালা দাসপট্টনায়ক। মহকুমার অন্যতম নেত্রী চারুশীলাদেবীও এই সভায় উদ্দীপক ভাষণ দিয়েছিলেন। ফলে বাসিন্দারা ট্যাক্স না দেওয়ার সিদ্ধান্তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন।
আন্দোলন জোরদার হলে পুলিশের অত্যাচারও সমান ভাবে চলছিল। মেদিনীপুর সদরের মহকুমাশাসক শঙ্কর সেন দাঁতন ডাক বাংলোতে বসেই ট্যাক্স আদায়ের দেখভাল করছিলেন। তাঁর আদেশে পথেঘাটে বাসিন্দাদের উপরে বেত্রাঘাত চলত। বালক, বালিকা, স্ত্রীলোক, কেউই রেহাই পেত না। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৩০ সালে ফেব্রয়ারি মাসে রংসুটিয়া গ্রামে এক বিশাল জনসভা হয়। সভায় অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক ছিলেন সীতানাথ আচার্য, ব্যবস্থাপক যোগেন্দ্রনাথ মহাপাত্র। কাননবালা সভানেত্রী। কিন্তু পুলিশ সভার কাজ পণ্ড করে দেয়। দারোগা জিতেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত বাহিনী নিয়ে সভায় জনতার উপর লাঠি চালাতে থাকে। প্রবল মারে অনেকে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। গ্রেফতার করা হয় কাননবালা দাসপট্টনায়ক, সীতানাথ আচার্য এবং যোগেন্দ্রনাথ মহাপাত্রকে। তাঁদের আনা হয় আড়াই কিলোমিটার দূরে জেনকাপুর গ্রামে। তার পর তাঁদের দাঁতন থানায় চালান করে দেওয়া হয়। বিচারে কাননবালা দেবীর তিন মাস কারাদণ্ড হয়। সীতানাথ ও যোগেন্দ্রনাথেরও একই সাজা হয়।
১৯৩১ সালের ৫ মার্চ জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি গাঁধীজি ও বড়লাট লর্ড আরউইনের মধ্যে দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে কংগ্রেস আন্দোলন স্থগিত রাখে। কিন্তু গাঁধীজি লন্ডন গোলটেবিল বৈঠক থেকে ফেরার পর সমগ্র দেশের সঙ্গে মেদিনীপুর জেলারও পরিস্থিতি পরিবর্তন ঘটে। জেলার কংগ্রেস কর্মীরা পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠেন। নারী ও বালক স্বেচ্ছাসেবকেরা আন্দোলনে যোগ দেয়। ১৯৩২ সালে ৪ জানুয়ারি কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। জেলার শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের অত্যাচার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৩২ সালের ২৬ জানুয়ারি সারা জেলায় মহাসমারোহে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়। কাননবালাও সক্রিয় ভাবে আন্দোলনে সামিল হন। তিনি জনসাধারণকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে প্রভাবিত করেন। ফলে কংগ্রেসের কোনও কাজে তাঁর যোগ দেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু কাননবালারা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নোটিস দিয়ে মালপাড়া গ্রামে (আঙ্গুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন) সভা করেন। সে জন্য কাননবালা এবং অন্যদের গ্রেফতার করা হয়। বিচারের আগে তাঁকে ২১ দিন হাজতে রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে কাননবালা তিন মাস কারাদণ্ডের (১৯/৪/১৯৩২-১৮/৭/১৯৩২ সালে) সাজা পান। তাঁকে জেলা থেকে বহিষ্কারের নোটিসও ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার কাননবালাকে গ্রেফতার করে কারাদণ্ড দিয়েও স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বেশি দিন দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি প্রশাসন। ১৯৩৩ সালে দাঁতন কোর্ট ভবনে পতাকা উত্তোলন করতে গেলে কাননবালা দেবীকে তৃতীয়বার গ্রেফতার করা হয়। আবার তিনি ৩ মাসের কারদণ্ডের (২৭/১/১৯৩৩-২২/৪/১৯৩৩ সালে) সাজা পান।
পরবর্তী পর্যায়ের স্বাধীনতা আন্দোলনে, বিশেষ করে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কাননবালা দেবীকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি। তথ্য প্রমাণ না থাকলেও অনুমান করা যায়, শরীর সায় না দেওয়ায় তিনি আন্দোলন থেকে দূরে থাকেন। কাননবালার সত্তরোর্ধ্ব নাতি সুখেন্দু জানান, পুলিশ যখন তখন তাঁদের বাড়ি ঘিরে ফেলত। বাড়ির জিনিসপত্র নষ্ট করে দিত। জেলে তাঁর ঠাকুমার উপর খুব নির্যাতন করা হত। জেলে বসে কাননবালাকে হাতের কাজও করতে হত। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভাই পুনিলবিহারী মহাপাত্রের ছবি পাওয়া গেলেও কাননবালা দেবীর কোনও ছবি পাওয়া যায়নি।
আইন অমান্য আন্দোলনে কাননবালা দাসপট্টনায়কের সহযোদ্ধাদের ভূমিকাও কম ছিল না। এঁরা হলেন দাঁতন থানার সাউরী গ্রামের মদনমোহন দাস মহাপাত্রের কন্যা সত্যভামা দাস, কেদার গ্রামের রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তীর কন্যা সাবিত্রী দে (বর্তমান বেলদা), সরাইবাগান গ্রামের (সরাইবাজার) ত্রৈলোক্যনাথ পালের কন্যা অম্বিকাবালা দাস, নারায়ণগড় থানার বড়মোহনপুর গ্রামের ত্রৈলোক্যনাথ দের কন্যা সুশীলাবালা দে (বর্তমান বেলদা)। সুশীলাবালা আইন অমান্য আন্দোলনে দ্বিতীয় পর্যায়ে (২৪/৭/১৯৩৩) তিন মাস কারাদণ্ড পেয়েছিলেন। এঁদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় ৯০ বছর পূর্বের ঘটনার কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। ১৯৩০ সালে লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কাননবালা দেবীর সহযোদ্ধাদের বয়স ছিল আনুমানিক ৩০-৪০ বছর।
কাননবালা দেবী তাঁদের স্বপ্নের স্বাধীনতা দেখে গিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
লেখক আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy