কল্যাণেশ্বরী মন্দির। —নিজস্ব চিত্র
বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পুরনো মন্দির, মসজিদ, গির্জার মতো পুরাসম্পদ। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি নিয়ে রয়েছে নানা লোকশ্রুতি ও কিংবদন্তি। এমনই একটি স্থান পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল এলাকার কল্যাণেশ্বরী মন্দির। এই মন্দিরকে কেন্দ্র গড়ে বর্তমানে গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র। আসানসোল বা পশ্চিম বর্ধমান তো বটেই গোটা পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে এই এলাকা বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। কারণ, প্রাচীন ইতিহাস আর কিংবদন্তির এমন সহাবস্থান চট করে পাওয়া যায় না। বরাকরের কাছে এই মন্দিরের অদূরেই তৈরি হয়েছে মাইথন ব্যারাজ। রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা আসেন নদী, ব্যারেজ ও মন্দিরের সম্মিলনে গড়ে ওঠা এই পর্যটন স্থলে। অনেকের রুজিরুটি এই পর্যটনস্থলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
ঠিক কবে কল্যাণেশ্বরী মন্দির তৈরি হল সে সম্পর্কে কোনও পাথুরে প্রমাণ আজও মেলেনি। অনেকে মনে করেন, কাশিপুরের রাজা এই মন্দির স্থাপন করেছিলেন। জনশ্রুতি, কাশীপুরের এক রাজা বিবাহের যৌতুক হিসেবে দেবী কল্যাণেশ্বরীকে পান। দেবী কল্যাণেশ্বরীর বিগ্রহ ও রাজবধূকে পাল্কিতে করে নিয়ে আসা হয়েছিল। তার পরে সবনপুর এলাকায় দেবীর মন্দির তৈরি করা হয়। সবনপুর এলাকায় একটি মন্দিরের চিহ্ন এখনও রয়েছে। লোকশ্রুতি অনুসারে, প্রথমে সেখানেই বিরাজমান ছিলেন দেবী কল্যাণেশ্বরী। এই মন্দির পুরনো কল্যাণেশ্বরী মন্দির নামে পরিচিত। কথিত রয়েছে প্রাচীন আমলে এই গ্রামের নাম ছিল স্বপ্নপুর। পরে তাই লোকমুখে সবনপুর-এ রূপান্তরিত হয়। বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘স্থানটির বিশেষত্ব প্রাচীনত্ব দুই-ই আছে। হয়ত এক সময় এখানে তান্ত্রিকদের একটা বড় ঘাঁটি ছিল।’
লোকমুখে প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, সবনপুরের চারপাশে ছিল গ্রাম। সেখানে নাকি সারাদিন ধান থেকে চাল ও চিড়ে তৈরি করা হত। ঢেকির আওয়াজে দেবী কল্যাণেশ্বরী বিরক্ত হয়ে কাশিপুর রাজাকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেন, তাঁকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাজা নিকটবর্তী একটি জঙ্গলে দেবীর মন্দির স্থানান্তরিত করেন। পরে এই জঙ্গলকে ঘিরে সিদ্ধপীঠ গড়ে ওঠে। এই মন্দিরটিই আজ কল্যাণেশ্বরী মন্দির নামে পরিচিত। আজও এখানে এক ছোট গুহার মধ্যে দেবীকে রাখা হয়। আর বাইরে রাখা হয়েছে অষ্টধাতুর দক্ষিণাকালী মূর্তি। এই কালীমূর্তিই মা কল্যাণেশ্বরী রূপে পূজিত হন।
বর্তমানে দেবীর মন্দিরে পঞ্চাশ জন সেবাইত রয়েছেন। দেবীর নিত্যপুজোর দায়িত্ব তাঁদেরই কাঁধে। এই এলাকায় মন্দির তৈরির পরেও একটি কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও দেবীর নিত্যপুজোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক বার নাকি এক শাঁখারি সারা দিন চারিদিকে ঘোরার পরেও শাঁখা বিক্রি করতে না পেরে দেবীর মন্দিরের সামনে এসে দুঃখপ্রকাশ করছিলেন। জনশ্রুতি, তাঁর দুঃখ দেখে দেবী বালিকা রূপে তার কাছে এসে দুই হাতে শাঁখা পরে নেন। তিনি ওই শাঁখারিকে জানান, সবনপুর গ্রামে তাঁর বাবার কাছে গিয়ে শাঁখার পয়সা নিয়ে নিতে। এই কথা শুনে দেবীর বলে দেওয়া সবনপুর গ্রামনিবাসী ওই ব্যক্তির কাছে গিয়ে পৌঁছন শাঁখারি। তাঁর কাছে সব ঘটনা শুনে সেই ভদ্রলোক চমকে যান। তিনি বলেন, “আমার তো কোনও কন্যা সন্তান নেই। তা হলে আমার নাম করে কে শাঁখা পরল?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি শাঁখারির সঙ্গে মন্দিরের দিকে রওনা হন। মন্দিরের সামনে গিয়ে ওই ব্যক্তি বলে ওঠেন, “কোথায় আমার মেয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি না।” শাঁখারি বলে ওঠেন, “কোথায় গেলে মা তুমি। একবার দেখা দাও।”
প্রচলিত কাহিনি অনুসারে, তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে দেবী কল্যাণেশ্বরী কন্যারূপে পাথরের চূড়ায় পিছন ঘুরে বসে শাঁখা পরা হাত দু’টি তুলে দেখিয়ে দেন। সেবাইতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে দেবী কল্যাণেশ্বরীর মন্দিরে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে দু থেকে আড়াই হাজার ভক্ত পুজো দিতে আসেন। বছরের অন্য মাসগুলিতে শনিবার ও মঙ্গলবার প্রায় পাঁচশোর কাছাকাছি ভক্তের সমাগম হয়। ফি-বছর দুর্গাপুজোর সময়ে নবমীর দিনে ধুমধামের সঙ্গে দেবীর পুজো হয়। কিন্তু করোনার সময়ে? কল্যাণেশ্বরী মন্দিরের অন্যতম সেবাইত মিঠু মুখোপাধ্যায় জানান, মন্দির খোলাই ছিল। নিত্য পুজোও হয়েছে। ভক্তেরা এখন যদি আসেন, তা হলে তাঁদের ‘মাস্ক’, দস্তানা পরে আসতে হবে। মন্দিরের ভিতরে এমনিতেই তিন-চার জনের বেশি দাঁড়াতে পারেন না। ফলে, সামাজিক দূরত্ববিধি স্বাভাবিক ভাবেই রক্ষিত হয়। প্রতিদিনই মন্দির চত্বর সাফ করা হয়। জীবাণুনাশকও ছড়ানো হয়।
কল্যাণেশ্বরী মন্দিরের পাশ দিয়েই গিয়েছে বরাকর নদ। এই নদের উপরেই তৈরি হয়েছে মাইথন ব্যারাজ। গড়ে উঠেছে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন। ১৯৫৭ সালে এই ব্যারেজে তৈরির পরিকল্পনা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এটি ছিল স্বাধীন ভারতের অন্যতম বড় উদ্যোগ। এর পরে এই অঞ্চলে আরও কয়েকটি ছোট-বড় কলকারখানা গড়ে ওঠে। মন্দির ও জলাধারকে কাজে লাগিয়ে পর্টনকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়।
এলাকাবাসী জানান, গত কয়েক দশকে এখানে গড়ে তোলা হয়েছে সবুজ দ্বীপ, সুলেমান পার্ক, আনন্দ দ্বীপ, গোল্ডেন জুবলি পার্ক, হিরণ পার্ক, ভান্ডার পাহাড় শিব মন্দির প্রভৃতি স্থান। এখানে রয়েছে নৌবিহারের ব্যবস্থাও। এলাকাবাসীরা জানান, ফি বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে অনেক দূর দূরান্ত থেকে এখানে আসেন পর্যটকেরা।
কিন্তু এর মাঝেও দেখা দিচ্ছে সমস্যা। এলাকাবাসীর দাবি, এর মধ্যেও মানুষের ব্যবহার করা থার্মোকলের থালা, বাটি, গ্লাস ও পলিথিনের জেরে ড্যামের জল দূষিত হচ্ছে। অবিলম্বে এই সমস্যা না মেটাতে পারলে তা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে জানান পরিবেশপ্রেমীরা। তাঁদের দাবি, এই ড্যামের জল থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও পানীয় জলও পাওয়া যায় হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের তরফে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy