রক্তাক্ত জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ। ফাইল ছবি
কল্পনারও বাইরেই ছিল
লাঠি নিয়ে তেড়ে এল কাপড়ে মুখ ঢাকা এক দল। শুরু হয়ে গেল বেপরোয়া মারধর। স্থান, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)। এই প্রথম নয়, এর আগে একাধিক বার আক্রান্ত হয়েছে জেএনইউ। এ বার হস্টেলে থাকার খরচ বৃদ্ধির প্রতিবাদে আন্দোলন চলছে জেএনইউতে। অভিযোগ, শুধু, জেএনইউ নয়, নয়া নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি প্রতিবাদে বিক্ষোভের সময়ে পুলিশি লাঠিচার্জে জখম হয়েছেন ‘জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়’-এর বেশ কয়েক জন পড়ুয়া। পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রন্থাগারে কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার অভিযোগও উঠেছে। অনেকের দাবি, দমননীতির এক নতুন রূপ দেখতে পাচ্ছি আমরা। তবে ইতিহাস বলে, যে কোনও সঙ্কটে শাসকের সঙ্গে পড়ুয়াদের সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়।
বহু দেশেই দেখা গিয়েছে পড়ুয়ারা পথে নামলেই শাসক ধৈর্য হারিয়েছে। অধিকাংশ জায়গায় পুলিশের সাহায্যে আন্দোলন দমনের অভিযোগ উঠেছে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক আন্দোলন। পরে তাই মুক্তিযুদ্ধের বীজ পুঁতেছিল। ভারতে ছাত্র আন্দোলনের নজিরও বহু পুরনো। ইন্দিরা গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন জেএনইউ-তেই তাঁর সামনেই প্রতিবাদপত্র পাঠ করেছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা বর্তমানে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ জেএনইউ গেলে প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছেন পড়ুয়ারা। সেখানে পড়ুয়াদের প্রতিবাদের অধিকারকে সম্মান জানিয়েছিলেন মনমোহন সিংহ।
কিন্তু এখন সময় ও পরিস্থিতি পাল্টেছে। এখন শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে নানা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে পড়ুয়ারা। কানহাইয়াকুমারের মতো ছাত্র নেতারা আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠছেন। অভিযোগ, তাই বোধহয়, পড়ুয়াদের উপরে এ ধরনের হামলা হচ্ছে। তবে অনেকের অভিযোগ, এই রোগ থেকে মুক্ত নয় এ রাজ্যও। ২০১৪ সালে যাদবপুরে ছাত্র বিক্ষোভ স্তব্ধ করতে একই ভাবে ক্যাম্পাসে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল রাজ্যের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রীর উপরে দিল্লিতে হামলার প্রতিবাদে বের করা মিছিল থেকে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার অভিযোগও উঠেছিল। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির একাধিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বারবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন জেএনইউ-র পড়ুয়ারা। অনেকে মনে করেন, তাঁদের আন্দোলনকে দানা বাঁধতে না দেওয়ার লক্ষ্যই ছিল শাসককুলের। কিন্তু তা বলে, এ ভাবে বহিরাগতেরা হস্টেলে ঢুকে পড়ুয়াদের উপরে হামলা চালানো হবে! এর নিন্দা করার ভাষা জানা নেই।
সোমা সিংহরায়ভূগোল, পঞ্চম সেমিস্টার, বিবেকানন্দ মহাবিদ্যালয়
হিংসাই যেন দমনের পন্থা
সম্ভবত এই প্রথম, গোটা দেশ এক সঙ্গে ধিক্কার জানাল। এর আগে যত বারই শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি থাকা উচিত কি না, এই প্রশ্ন উঠেছে, তত বারই গোটা দেশ কার্যত দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। এক দল বলেছেন, শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি না থাকাই বাঞ্ছনীয়। অন্য দলের বক্তব্য ছিল, ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক বোধ তৈরি হয়। তাই শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি থাকা উচিত। যাঁরা শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি না থাকার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তাঁরা অন্যতম কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন রাজনৈতিক হিংসাকে। সেই হিংসারই এক রূপ দেখা গেল জেএনইউতে।
ভারতে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। পরাধীন ভারতে অনেক আন্দোলনেই পড়ুয়ারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সেই ধারা স্বাধীনতার পরেও বন্ধ হয়নি। অভিযোগ, শাসক বরাবরই শিক্ষাঙ্গনে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে তার ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করেছে। আবার সেই ছাত্র সংগঠনের একাধিক গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বও দেখেছি আমরা। জেএনইউ-র ঘটনা সব কিছুকে অতিক্রম করে গিয়েছে। অভিযোগ, রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধাচরণের অপরাধে সেখানে তাণ্ডব চালিয়েছে রাজনৈতিক মদতপুষ্ট বহিরাগতের দল। সেই হামলার হাত থেকে বাদ যাননি শিক্ষকেরাও। একে আন্দোলন দমন করার সর্বগ্রাসী চেষ্টা বলেই মনে করছেন অনেকে। মন্দার ছবি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বেকারত্বের হার বাড়ছে। নানা রাজ্যে একে একে ক্ষমতা হারাচ্ছে বিজেপি। এই অবস্থায় তারা নিয়ে এসেছে নতুন নাগরিকত্ব আইন। আসছে এনপিএ। অভিযোগ, এ নিয়ে শঙ্কায় ভুগছেন দেশবাসী। এর প্রতিবাদে পথে নেমেছেন পড়ুয়ারা। অভিযোগ, এমনিতেই চাপে থাকা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে পড়ুয়াদের আন্দোলন মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই সর্বশক্তির প্রয়োগ। তাই জেএনইউ-র মতো ঘটনা।
সৌরভ ভট্টাচার্যপ্রাক্তন ছাত্র, ভূগোল বিভাগ, বিবেকানন্দ মহাবিদ্যালয়
অন্য ছবিটাও সামনে আসুক
প্রায় কাছাকাছির সময়ে তৈরি হয়েছিল দু’টি সংগঠন। রাশিয়ার তাসখন্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। আর নাগপুরে তৈরি হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)। প্রাচীন ভারতের মুনি, ঋষিদের আদর্শ ও বৈদিক সংস্কৃতিজাত সাম্যবাদ, যার কথা স্বামী বিবেকানন্দ গোটা বিশ্বের কাছে প্রচার করেছিলেন শিকাগো ধর্মমহাসভায় সেটি এবং দীনদয়াল উপাধ্যায়ের ‘একাত্ম মানবতাবাদ’-এর আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। বিপরীতে মার্ক্সীয় সাম্যবাদের অনুসারী কমিউনিস্ট পার্টি। সাম্যবাদের এই দুই রূপের মধ্যে নানা সময় নানা ইস্যুতে মতপার্থক্য হয়েছে। উভয়ের কর্মপন্থার মধ্যে সংঘর্ষও ঘটেছে। এর আত্মীকরণের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপ।
কিন্তু অভিযোগ, যেখানেই মার্ক্সীয় সাম্যবাদ প্রাধান্য পেয়েছে সেখানেই তারা বিরোধী পক্ষকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে। তার উদাহরণ কেরল ও অন্ধ্রপ্রদেশ। অভিযোগ, কয়েক হাজার সদস্যের প্রাণের বিনিময় আজ এই দুই রাজ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ভারতীয় সাম্যবাদকে প্রতিষ্ঠার লড়াই চালাচ্ছে। আর এই কাজে আত্মোৎসর্গ করেছেন এবিভিপি-র সদস্যেরাও। মার্ক্সীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা আজ শিক্ষাঙ্গন আক্রান্ত স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। অভিযোগ, তাঁদের প্রকৃত রূপ কী তা বাংলার মানুষ অবগত। অভিযোগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন পড়ুয়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ের চুল ধরে টেনে তাঁকে হেনস্তা করেছিলেন। তাকে আর যাই হোক ‘সভ্য’, ‘ভদ্র’, ‘সংসদীয়’ ও গণতন্ত্রকামী’ বলে মনে করা চলে না। অভিযোগ, বামপন্থীদের এই ধরনের নৃশংসতা, তার বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে বিরোধী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার (ক্ষেত্র বিশেষে চিরতরে) প্রবণতাও বাংলা দেখেছ।
সংবাদপত্রে দেখলাম এবিভিপি সদস্য অনিমা সোনকারের বলেছেন, ‘‘বামপন্থী পড়ুয়াদের লাগাতার আক্রমণের মুখে এবিভিপি-র সদস্য ও নেতারা এতটাই সন্ত্রস্ত ছিলেন যে ঘর থেকে বাইরে বেড়োলে তাঁদের আত্মরক্ষার সরঞ্জাম রাখতে বলা হয়েছিল।’’ জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী ছাত্র সংসদের দ্বারা সেখানে কী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে তা এই উক্তিতেই তা স্পষ্ট। কিন্তু পাশেই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ এবিভিপির ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত সেখানে এই ধরনের পরিবেশ নেই। কারণ, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) এই ধরনের পরিবেশ তৈরিতে বিশ্বাসী নয়। আজ যাঁরা রাস্তার নেমেছেন তাঁদের সকলের প্রকৃত সত্যটা জানা এবং সেখানে বামপন্থীদের হাতে অন্য দলের হেনস্তা হওয়ার ছবিটাও সামনে আনা দরকার। তবেই ভারতের নিরপেক্ষতার গরিমা বজায় থাকবে।
আশিস পালবর্ধমান বিভাগ প্রমুখ, এবিভিপি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy