উজ্জ্বলকুমার রক্ষিতের কাছে জীবনানন্দ দাশের চিঠি। —নিজস্ব চিত্র।
খড়্গপুর কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। রেলশহরে তাঁর জীবন মাত্র পাঁচ মাস ১২ দিনের। কেমন ছিল রেলশহরে কবির জীবন? ১৯৫০ সাল। বছর তিনেক আগেই বাংলাদেশের বরিশালের ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে ফিরে এসেছেন কলকাতায়। চাকরি খুঁজছেন। ভাই অশোকানন্দ দিল্লির এক মিলিটারি ট্রেনিং কলেজে চাকরির সুযোগ করে দেন। তবে বাংলা ছাড়তে নারাজ কবি। সেই সময়েই খড়্গপুর কলেজে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। ঢাকার মানিকগঞ্জ কলেজ থেকে খড়্গপুরে আসা হিমাংশুভূষণ সরকারের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক ১৯৪৮ সালের ২৯ অগস্ট কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ইংরেজির একমাত্র অধ্যাপক সরোজকুমার ভট্টাচার্যের পক্ষে বিভাগ চালানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। কবি খ্যাতির জন্য অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণের চেষ্টায় নিয়োগপত্র পেলেন। ১৯৫০ সালের ৪ অগস্ট নিয়োগপত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করে অধ্যক্ষকে চিঠি দেন কবি।
কলকাতা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে খড়্গপুর। কিন্তু বাংলায় থাকার সুযোগ তো মিলছে! কয়েকদিনের মধ্যে চলে আসেন খড়্গপুরে। পরিবেশ, থাকা খাওয়ার সুবিধা ইত্যাদি বিষয় সরেজমিন দেখে গিয়েছিলেন। অধ্যক্ষ সহকর্মীদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কবির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। কারখানা, রেলের বিভিন্ন কার্যালয়, লাল মাটির রাস্তার ধারে থাকা গাছ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি। কলকাতায় ফিরেই কাজে যোগদানের সম্মতিপত্র পাঠিয়ে দেন কলেজে। ১৯৫০ সালের ২৫ অগস্ট। চিঠিতে অধ্যক্ষকে কলেজ হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। লিখেছিলেন, নিয়োগপত্র অনুযায়ী ১ সেপ্টেম্বর থেকেই কলেজে যোগ দেবেন। হস্টেলে পৌঁছে যাবেন ৩১ অগস্ট।
তখনও কলেজের নিজস্ব ভবন হয়নি। সিলভার জুবিলি হাইস্কুলে সকাল ও সন্ধ্যায় ক্লাস হত। স্কুলের ছাত্রাবাসের একটি ঘরেই জীবনানন্দের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। ২ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন কবি। জীবনযাপন উদাসীন এবং অনাড়ম্বর। হস্টেলের ঘরে সামান্য একটি খাট, বিছানা। কিছু বই, আর কালির দোয়াত। কোনও শিক্ষক ছাত্রাবাসে থাকতেন না। ছাত্রাবাস দেখভালের দায়িত্ব ছিল কলেজের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক পুলিনবিহারী পালের। তাঁর সঙ্গে সহজ-সরল সম্পর্ক ছিল কবির।
জীবনানন্দের খড়্গপুর বাস নিয়ে একসময় লিখেছিলেন শহরের বাসিন্দা কবি কামরুজ্জামান। তিনি লিখেছেন, ‘‘খড়্গপুর কলেজে কবি ইংরেজি গল্প, প্রবন্ধ, একাঙ্ক নাটক এমনকী শেষের কয়েকদিন কবিতা পড়ানো শুরু করেছিলেন। বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রদের কাছে ইংরেজি সাহিত্যের আকর্ষণ কতদূর হবে তা তো সকলের জানা। তবে কলাবিভাগের ছাত্ররাও যে খুব একটা আকৃষ্ট হতেন তার প্রমাণও নেই। যদিও তিনি ঠিক সময়েই ক্লাসে যেতেন।’’ ক্লাস করানোর সময়টুকু ছাড়া হস্টেলের ঘরে থাকতেন। দরজা বন্ধ করে লিখতেন ও পড়তেন। বেশিরভাগ সময় উদাস, নয়তো চিন্তাশীল। কেউ দেখা করতে এসে দরজায় কড়া নাড়লেও তিনি আত্মনিমগ্ন। দরজা খুলতেন না। খড়্গপুর বাসের সময় কবি কোনও কবিতা লিখেছিলেন কিনা জানা যায়নি। কামরুজ্জামানও বলছিলেন, “কবি সেই সময়ে নিশ্চয় কবিতা লিখেছেন। তবে কোন কবিতা তা জানা যায়নি। কারণ তিনি তো ওই ঘরে বসে থাকতেন, দরজা খুলতেন না। একমাত্র পুলিনবিহারী পাল ডাকলে দরজা খুলতেন। কিন্তু যে কোনও কথার জবাব হ্যাঁ বা না, এই দুই শব্দে সীমাবদ্ধ থাকত। এমনকী পুলিনবাবু নিজের লেখা প্রবন্ধ, গল্প নিয়ে গিয়ে কবিকে শোনালে ভাল বলে চুপ করে যেতেন বলে শুনেছি।”
বাংলায় থাকবেন বলে দিল্লি যাননি। আবার কলকাতা থেকে দূরে স্ত্রী-ছেলের জন্য উতলা হতেন। শনিবার হলে বা ছুটির দিন পেলেই কলকাতায় পালিয়ে যেতেন। পরে খড়্গপুরে পাকাপাকি থাকারও ইচ্ছে হয়েছিল কবির। স্ত্রী লাবণ্যপ্রভার খড়্গপুরের মালঞ্চর একটি স্কুলে চাকরির সুযোগ হয়। খড়্গপুরে বাড়িও দেখতে শুরু করেছিলেন। মালঞ্চয় বাড়ি ভাড়া নিয়েও ফেলেন। কিন্তু কলকাতায় গিয়ে দেখেন, প্রবল শীতে স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ। স্ত্রীকে এমন অবস্থায় রেখে ফিরে আসতে পারেননি কলেজে। কয়েকদিন পর কলেজ খুলতে সমস্যার কথা জানিয়ে ৫ ডিসেম্বর অধ্যক্ষকে চিঠি দেন। চিঠিতে দ্রুত কলেজে যোগদান করার কথা বলে ভাড়া নেওয়া বাড়িটি কাউকে দিয়ে দিতে বলেন। অবশ্য দিন কয়েকের মধ্যেই জীবনানন্দ নিজেই জ্বরে আক্রান্ত হন। ভুগলেন বেশ কয়েকদিন। ১৯৫১ সালের ১৩ জানুয়ারি চাকরি হারানোর আশঙ্কায় হিমাংশুভূষণকে ফের চিঠি দিলেন। শেষমেশ ওই বছরের ২২ জানুয়ারি দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে কলেজে যোগ দিলেন কবি।
কিন্তু খড়্গপুরে আবার জ্বরে আক্রান্ত হলেন কবি। ১৪ ফেব্রুয়ারি কোনও ক্রমে ক্লাস নিয়েই কলকাতায় চলে গেলেন। গিয়ে দেখলেন স্ত্রীর অসুস্থতা বেড়েছে। চিকিৎসক জানালেন, সুস্থ হতে মাস তিনেক সময় লাগবে। স্ত্রীর এমন পরিস্থিতিতে আবার ছুটির আবেদন করলেন। সেই আবেদনে পাঠক্রম প্রায় শেষ করে দিয়েছেন বলে জানালেন। সেই সঙ্গে ইংরেজি বিভাগের পদটি যাতে রাখা হয় তার অনুরোধ করলেন। এর পরেও কলেজ কর্তৃপক্ষ না মানলে ইস্তফা দেওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনও রাস্তা থাকবে না বলেও জানিয়ে দিলেন। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ লেখা ওই চিঠিতে তিনি যে দিল্লির চাকরি ছাড়ার মতো কতটা ত্যাগ স্বীকার করে এই কলেজে যোগ দিয়েছিলেন সে কথাও স্মরণ করিয়ে দেন। জীবনানন্দের দীর্ঘ ছুটি সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য কলেজ পরিচালন সমিতির সভা ডাকা হয়। কিন্তু কলেজের আর্থিক সঙ্কটের কথা ভেবে শেষমেশ বিলুপ্ত করা হয় ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় পদটি। ফুরিয়ে যায় কবির সঙ্গে খড়্গপুরের সব লেনদেন। কবি ব্যক্তিগত ভাবে পুলিনবিহারী পালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সম্পর্ক ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছিল।
শেষমেশ কবির সঙ্গে খড়্গপুরের যোগসূত্র হয়ে যায় তাঁর পাঁচটি চিঠি। অবশ্য চিঠিগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছিল। কলেজে ১৯৭০ সালে করণিক পদে যোগ দেওয়া উজ্জ্বলকুমার রক্ষিত সেসব সযত্নে রেখেছেন। অসুস্থ উজ্জ্বলকুমার বলছিলেন, “আমি হিমাংশুভূষণ সরকারের থেকেই জীবনানন্দ সম্পর্কে অনেকখানি জেনেছিলাম। হিমাংশুবাবু চিঠিগুলো কলেজের অফিসঘরে রেখেছিলেন। ১৯৭৫ সাল নাগাদ কলেজে চুরি হয়। চোরেরা চিঠিগুলি কলেজের বাইরে ফেলে দিয়েছিল। আমি দেখতে পেয়ে চিঠিগুলো কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে নিজের কাছে রেখেছি। পরে লাবণ্য দাশের স্কুলে চাকরির নিয়োগপত্রও সংগ্রহ করেছি।”
জীবনানন্দের স্মৃতি পুনরুজ্জীবনে ১৯৯৮ সালে উদ্যোগী হন শহরের কয়েকজন লেখক-কবি। তাঁরা গড়ে তোলেন জীবনানন্দ শতবর্ষ কমিটি। কমিটির উদ্যোগেই খড়্গপুর কলেজের নিজস্ব ভবনে বসানো হয় কবির আবক্ষ মূর্তি। কমিটি এখন সক্রিয় নয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিবস। কবির চিঠিগুলোই নাড়াচাড়া করবেন উজ্জ্বলকুমার রক্ষিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy