জগদীপ ধনখড়।
অনুমান সত্যি হয়ে উঠেছে। রাজ্য-রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। প্রায় প্রতি দিন সরকার এবং শাসক দলকে বিঁধে তাঁর কোনও না কোনও কার্যকলাপ, মন্তব্য অথবা রাজভবন থেকে জারি করা একের পর এক বিবৃতি নজর করলে খুব সহজেই এটা বোঝা যায়। তিনি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, এই পথ থেকে সরার কোনও অভিপ্রায় তাঁর নেই।
শপথ নেওয়ার পর থেকেই তাঁর বিবিধ কার্যকলাপ রাজনীতির উপাদান হয়ে উঠছিল। যাদবপুর-কাণ্ড তাতে প্রথম বড় মাত্রা যোগ করে। এই কলামে তখনই লেখা হয়েছিল, সরকারের সঙ্গে এই রাজ্যপালের তিক্ততা আরও বাড়বে। কারণ ধনখড় সরাসরি মাঠে নেমে খেলতে চান। আর কেন্দ্রের শাসকেরাও বিষয়টি সম্পর্কে হয়তো সচেতন ভাবেই উদাসীন থাকবেন।
কেউ বলতে পারেন, এক হাতে তালি বাজে না। রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্যের ‘লড়াই’ হচ্ছে সেয়ানে-সেয়ানে। রাজ্যপাল যেমন রাজ্যকে বিঁধছেন, রাজ্যও তেমনই রাজ্যপালকে ছেড়ে কথা বলছে না। কিন্তু রাজ্যপালের ভূমিকা যদি রাজনীতিতে ইন্ধন জোগানোর মতো হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে সেই পদের অবনমনের দায়ভার তো প্রধানত পদাধিকারীর উপরেই বর্তায়। বিরোধের পরিসরও তাতে বাড়ে।
তবে শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, বিভিন্ন রাজ্যেই রাজ্যপালেরা ক্রমশ কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থাৎ দেশের ক্ষমতাসীন দলের ‘রাজনৈতিক এজেন্ট’ হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করে ফেলছেন। দীর্ঘ দিন ধরে যে কোনও সরকারের আমলেই এটা হয়ে চলেছে। সে-দিক থেকে ওই পদের গরিমা বলে আজ আর তেমন কিছু নেই। বরং যত দিন যাচ্ছে, রাজ্যপালদের ভূমিকা ততই প্রশ্নের মুখে পড়ছে। তাই কেন্দ্রের দ্বারা মনোনীত এই ‘রাজ্যপাল’ নামক পদটির কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, তা নিয়েও আজ পর্যালোচনা দরকার।
আইনজ্ঞ রাজ্যপাল ধনখড় অবশ্য রোজ বলেন, তিনি তাঁর অধিকারের সীমা মেনেই যা করার করছেন। কূট তত্ত্বে যাব না। শুধু নিতান্ত অর্বাচীন প্রশ্ন— এই অধিকারবোধের অর্থ কি নিয়মিত রাজ্য সরকার বা শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ-অভিযোগ-সমালোচনা উগরে দেওয়া? রাজনীতির লোকেদের মতো প্রচারমাধ্যমের সামনে সরকার-বিরোধী বার্তা ছড়ানো? তার দ্বারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের কার্যত ‘উৎসাহিত’ করা?
তাঁর পূর্বসূরিদের অনেকের সঙ্গেই তৎকালীন শাসকদের সম্পর্ক মধুর ছিল না। কিন্তু কোনও রাজ্যপাল কখনও এই ভাবে নিজেকে ব্যক্ত করেছেন বলে মনে পড়ে না। এই পদটি বরং মেঠো-কোঁদলের চেয়ে কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বে বলেই মান্যতা পেয়ে এসেছে। সেই ভেদরেখা কি মুছে যেতে বসল?
ইতিহাস জানে, ১৯৪৬-এর ৩০ অক্টোবর কলকাতায় তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর ফ্রেডরিক বারোজ়-এর সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাতে গিয়েছিলেন মহাত্মা গাঁধী। রাজ্যে তখন সোহরাওয়ার্দির সরকার। পরিস্থিতি অশান্ত। গাঁধীর কাছে গভর্নরের প্রশ্ন ছিল, ‘‘আপনি আমাকে কী করতে বলেন?’’ উত্তর এল, ‘‘নাথিং, ইয়োর এক্সেলেন্সি!’’ কেন? কারণ, সরকার যখন ক্ষমতায়, তখন রাজভবনের কিছু করার নেই।
রাজ্যপাল হিসেবে নিজের ‘সক্রিয়তা’ প্রমাণের জন্য ধনখড় কিন্তু নজিরবিহীন ভূমিকায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভ থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে ‘উদ্ধার’ করতে চলে গিয়েছিলেন এবং নিজের ‘ক্ষমতাবল’-এ উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডাকার হুমকি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি সরকারের সঙ্গে ‘সম্মুখসমর’-এ বিশ্বাসী। তাঁর কার্যকালের তখন এক মাসও পেরোয়নি। ওই রাতেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে কড়া মন্তব্যও করেছিলেন তিনি। যদিও একই ঘটনা কেন্দ্র করে যাদবপুরে বিজেপির ছাত্র সংগঠন যে পাল্টা তাণ্ডব করে, তা নিয়ে একটি বাক্যও শোনা যায়নি তাঁর মুখে। অর্থাৎ, রাজ্যপাল ধনখড়ের প্রথম ‘সক্রিয়তা’ তাঁকে চিনিয়ে দিয়েছিল রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার মাপকাঠিতে।
সেই শুরু। ঘটনার পর ঘটনা, মন্তব্যের পর মন্তব্যে বিরোধের বাষ্প এখন আরও ঘনীভূত। এটাও ঠিক যে, সরকারের তরফে সর্বদা তাঁর প্রতি ‘প্রত্যাশিত’ সৌজন্য দেখানো হয়নি। সেটা উচিত কাজ নয়। কিন্তু ইট ছুড়লে তবেই পাটকেল আসে!
সবাই জানেন, স্বাধীন ভারতে প্রাদেশিক রাজ্যপালের পদ ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার। কিন্তু স্বাধীনতার পরে দু’দশক রাজ্যপালদের নিয়ে কোনও সমস্যা বা প্রশ্ন সামনে আসেনি। কারণ কেন্দ্র, রাজ্য সব ছিল একই দলের শাসনাধীন। তখনকার রাজ্যপালদের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁরা কয়েক জন নানা রকম মন্তব্যও করে গিয়েছেন। মধ্যপ্রদেশে রাজ্যপালের দায়িত্ব নেওয়ার পরে পট্টভি সীতারামাইয়া বলেছিলেন, ‘‘আমার কাজ বলতে শুধু রাজভবনে অতিথি আপ্যায়ন!’’ উত্তরপ্রদেশে সরোজিনী নাইডু নিজের রাজ্যপাল পদকে ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘সোনার খাঁচায় বন্দি পাখি’ বলে। মহারাষ্ট্রে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত তো পদটি রাখার কোনও যুক্তিই খুঁজে পাননি!
রাজ্যপালেরা ‘অর্থবহ’ হয়ে উঠতে থাকেন রাজ্যগুলিতে কেন্দ্র-বিরোধী সরকার গঠনের সূচনা থেকে। আঞ্চলিক দলগুলির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যপালদের প্রয়োজন মতো ‘কাজে লাগানো’ কেন্দ্রে শাসকদের পরিচিত কৌশল হয়ে দাঁড়ায়। নিয়োগের চিঠিতে রাষ্ট্রপতি সই করলেও দেশের শাসক বর্গের নিজস্ব পছন্দের লোক না হলে কাউকে সচরাচর রাজ্যপাল করা হয় না। যাঁরা পদটি পান, তাঁদেরও যৎপরোনাস্তি চেষ্টা থাকে পাঁচ বছরের কার্যকালে ‘রাজনৈতিক প্রভু’দের মনোরঞ্জন করে চলা। ফলে রাজার ঘরের ধন হয়ে শাসকদের স্বার্থে তাঁরা কলকাঠি নাড়বেন, তাতে আর আশ্চর্য কী!
সবাই জানেন, সরকারের কাজে রাজ্যপালের হস্তক্ষেপের অধিকার না থাকলেও সরকার গঠনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমস্যা দেখা দিলে তাঁদের ভূমিকা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়। তখন কেন্দ্রে বসে থাকা শাসকদের ইচ্ছানুযায়ী রাজ্যপালদের হাতের ‘কলকাঠি’ কী ভাবে কাজ করে, তারও ভূরি ভূরি উদাহরণ আমাদের জানা আছে। অনেক রাজ্যপাল তাঁদের কৃতকর্মের জন্য নিন্দিতও হয়েছেন।
কিন্তু রাজ্যপালদের একটি ‘রক্ষাকবচ’ আছে। তাঁদের অপসারণের বিষয়ে সংবিধানে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই। রাষ্ট্রপতি যদি কোনও রাজ্যপালকে সরিয়ে দেন, তা হলে ‘উপযুক্ত’ কারণ জানতে চেয়ে তিনি আদালতেও যেতে পারেন। বিরল ক্ষেত্র বা অতি গর্হিত অপরাধ ছাড়া রাজ্যপালদের অপসারণ করা তাই এখনও খুব সহজ নয়।
রাজ্যপালদের অপসারণের বিষয়ে তিনটি কমিশনের মতামত আছে। ১৯৮৮ সালে সারকারিয়া কমিশন বলেছিল, ‘বিরলতম’ কারণ ছাড়া অপসারণ করা ঠিক নয়। ২০০২ সালে বেঙ্কটচালাইয়া কমিশন বলে, যদি সরাতেও হয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মতামত নিতে হবে। ২০১০-এ পুঞ্ছি কমিশন অভিমত দেয়, রাষ্ট্রপতি বা কেন্দ্রের ইচ্ছায় রাজ্যপালকে সরানো যাবে না। তার জন্য সেই রাজ্যের বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করাতে হবে। তবে তিন কমিশনের সুপারিশের কোনওটিই আজ পর্যন্ত সংসদে পেশ করা হয়নি।
ইতিহাস এবং অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই যে মৌলিক প্রশ্নটা ওঠে, তা হল, রাজকোষের টাকায় রাজ্যপাল পদটি আদৌ রাখার কোনও যুক্তি আছে কি? যদি সরকারকে শপথ নেওয়ানোই তাঁর মূল কাজ হয়, তা হলে রাজ্যের প্রধান বিচারপতিই তো তা করাতে পারেন। কিন্তু সরকার ‘বসিয়ে’ দেওয়ার মতো গূঢ় রাজনৈতিক স্বার্থের কথা ভেবেই হয়তো বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পায় না!
তাই কেন্দ্রের এজেন্ট রাজ্যপালেরা ‘মহামহিম’ রূপে বিরাজ করেন। রাজভবনের রাজনীতি ‘সাংবিধানিক অধিকার’ হয়ে ওঠার সুযোগ পায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy