Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
অভূতপূর্ব অতি-সক্রিয়তা
Jagdeep Dhankhar

রাজ্যের ভোট-যুদ্ধে রাজভবনও এখন একটি পক্ষ হয়ে উঠছে

পুরভোটের প্রাক্‌লগ্নে এবং আগামী বিধানসভা ভোটের দিকে চোখ রেখে তাঁর এই ভূমিকা যে আরও প্রসারিত হতে যাচ্ছে, সেই সম্ভাবনাও এক খোঁচায় উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

জগদীপ ধনখড়। —ফাইল চিত্র

জগদীপ ধনখড়। —ফাইল চিত্র

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২০ ০০:২৯
Share: Save:

কেউ বনে সুন্দর। কেউ মায়ের কোলে। লোকে বলে, জগদীপ ধনখড় সুন্দর বিজেপি-সঙ্গে। সুন্দর কথাটি এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দ, সাবলীল বা স্বতঃস্ফূর্ত বলে ধরা যেতে পারে। বিজেপির ঘর থেকে আসা ধনখড় রাজ্যপালের আসনে বসেও তাঁর সাকিন ভোলেননি। কথায় ও কাজে বারবার সেটা প্রকাশ করতে তিনি দ্বিধাহীন এবং কৃতসঙ্কল্প।

পুরভোটের প্রাক্‌লগ্নে এবং আগামী বিধানসভা ভোটের দিকে চোখ রেখে তাঁর এই ভূমিকা যে আরও প্রসারিত হতে যাচ্ছে, সেই সম্ভাবনাও এক খোঁচায় উড়িয়ে দেওয়ার নয়। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ঘর থেকে বেরিয়ে দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে ধনখড় প্রকাশ্যে যে সব কথা বলেছেন, তা কোনও বিজেপি নেতার মুখে বসালেও বেমানান মনে হবে না।

তাই প্রশ্ন জাগে, সাংবিধানিক অধিকার ও দায়িত্ববোধের যুক্তি দেখিয়ে এক জন রাজ্যপাল কার্যত এমন একটি ঘোষিত অবস্থান নিতে পারেন কি? রাজ্যের বিরুদ্ধে, সরকারের পরিচালন পদ্ধতির বিরুদ্ধে রাজ্যপালের কিছু বলার থাকতেই পারে। কিন্তু তার মাধ্যম কি নিয়মিত যত্রতত্র সাংবাদিক বৈঠক করে বিষ উদ্‌গিরণ?

রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে নিয়মিত ‘গোপন’ রিপোর্ট পাঠানো রাজ্যপালদের কাজের মধ্যে পড়ে। সেখানে সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে নিজস্ব মতামত জানানোর পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁদের আছে। কিন্তু খোলাখুলি সরকার-বিরোধী ভূমিকা নিয়ে কোনও রাজ্যপাল যদি মেঠো রাজনীতির তুল্য আচরণ করতে থাকেন, তখন সেই রাজ্যপালের রাজনৈতিক ‘অভিসন্ধি’ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ সৃষ্টি হয়।

এ কথা ঠিক, বিজেপি-আশ্রিত বহু রাজ্যপাল এখন রাজভবন থেকেই খোলাখুলি ‘পদ্ম-ভজনা’ করে থাকেন। তথাগত রায় যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁদের সেই কাজে কোথাও হয়তো নিয়োগকর্তাদের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ও থাকে। পাশাপাশি সরকার ভাঙা-গড়ার খেলায় নেমে বিজেপি-পোষিত একাধিক রাজ্যপাল মুখ হাসিয়েছেন, এটাও ঘটনা। তবে মানতেই হবে, এঁদের কেউ নিয়মিত সাংবাদিকদের ডেকে সরাসরি রাজনীতিতে ইন্ধন জোগান না। তাঁদের দৈনন্দিন বক্তব্য বা বিবৃতি প্রত্যহ বিরোধী-রাজনীতির সহায়ক হয়ে ওঠে না।

ধনখড় সেখানে কিছুটা ব্যতিক্রমী। বাংলার শাসক দল কত দূর ‘স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক’ এবং বাংলার সরকার কাজে কতটা ‘অদক্ষ ও অসাংবিধানিক’, সেটা প্রতি দিন ফলাও করে বলার ‘পবিত্র’ দায়িত্ব পদে বসার পর থেকেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন এই রাজ্যপাল। তাঁর নিত্যচর্চা থেকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির হাতে মেঠো রাজনীতির ‘অস্ত্র’ও পৌঁছে যাচ্ছে। যদি কেউ একে ‘সুচিন্তিত’ কৌশল বলেন, তা হলে সেটা খুব ভুল হবে কি?

এই রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্পর্ক যে কিছুতেই দানা বাঁধছে না, তা বহুচর্চিত। এর জন্য কোন পক্ষের দায় কতটা, বলা কঠিন। সরকার সর্বদা ঠিক বা রাজ্যপাল সর্বদা ভুল, এমন কোনও সিদ্ধান্ত অবশ্যই একপেশে হবে। কিন্তু বলার কথা হল, রাজ্যপাল হিসেবে ধনখড়ের বিবিধ কার্যকলাপে বিজেপির প্রতি তাঁর অনুরাগের ছোঁয়া গোপন থাকে না। বরং কখনও তা রীতিমতো ‘দৃষ্টিকটু’ চেহারা নেয়। এটা প্রথম বোঝা গিয়েছিল তিনি রাজভবনে ঢোকার মাসখানেকের মধ্যেই।

সকলের মনে আছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়কে ঘিরে ছাত্র-বিক্ষোভের সময় তাঁকে ‘উদ্ধার’ করতে রাজ্যপালের ছুটে যাওয়ার সেই ঘটনা। যেখান থেকে প্রকাশ্য বিবাদের শুরু।

বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে সে দিন খড়্গহস্ত হয়েছিলেন ধনখড়। গুরুতর প্রশ্ন তুলেছিলেন রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে। তুলোধোনা করেছিলেন বিক্ষোভরত পড়ুয়াদের। কিন্তু বিজেপির ছাত্রবাহিনী লাঠিসোঁটা, রড, শাবল উঁচিয়ে বিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইউনিয়ন অফিস ভেঙেচুরে তছনছ করে দেওয়ার পরেও সে সম্পর্কে টুঁ শব্দটি আজ পর্যন্ত তাঁর মুখ থেকে শোনা যায়নি। তাঁর রাজ্যপালসুলভ ‘নিরপেক্ষতা’র এটি ছিল প্রথম প্রকাশ!

অনেকটা এমনই মুখ তিনি সম্প্রতি দেখালেন। সেটি কলকাতায় ‘গোলি মারো’ স্লোগান দিয়ে মিছিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। সবাই জানেন, শহরে অমিত শাহের সমাবেশে যোগ দেওয়ার মিছিল থেকে ওই দিন গেরুয়াবাহিনী ‘গোলি মারো’ ডাক ছাড়ে। এই হুঙ্কারের ব্যঞ্জনা কী ভয়ানক, তা-ও আজ সর্বজনবিদিত।

এর বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ যখন তুঙ্গে, রাজ্যপাল ধনখড় তখন বিষয়টিকে লঘু করে দেখাতে তৎপর হন। শুধু তা-ই নয়, ঘটনাটি ‘নেহাত অকিঞ্চিৎকর’ বলার সঙ্গেই তিনি আঙুল তুলে দেন রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকেও। যাকে ঢাল করে আড়াল খোঁজার পথ পেয়ে যায় বিজেপি।

একটি-দু’টি নয়, এমন নানা উদাহরণ ইদানীং রাজ্য এবং রাজ্যপালের সম্পর্কের উপর নিয়মিত ছায়া ফেলছে। ধাপে ধাপে যা ক্রমশ ‘লড়কে লেঙ্গে’ মাত্রা নিয়েছে। রাজ্যকে বিদ্ধ করার ‘সুযোগ’ খুঁজতে সদা তৎপর থাকেন রাজ্যপাল। আর রাজ্যপালের ভূমিকার নিন্দা করতে মুখিয়ে থাকে শাসক দল।

সংবিধানসম্মত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সেই রাজ্যের রাজ্যপালের ‘সম্পর্ক’-এর আদর্শ চেহারা এটা নয়। ধনখড়ের ‘অতিসক্রিয়তা’ গত কয়েক মাসের মধ্যে বারবার আলোচনায় এসেছে। এখন রাজ্য রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রাজ্যপাল তাঁর ‘পদাধিকার’কে যে ভাবে রাজভবন থেকে রাজপথে টেনে আনছেন, তাকে পর্যালোচনার বাইরে রাখা যায় না।

শোনা যায়, রাজ্যের তরফে নাকি ধনখড়ের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে ক্ষোভের কথা দিল্লিতে জানানো হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নাকি মৌখিক ভাবে দিল্লির উপরমহলে তাঁর অসন্তোষ পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং এমনটাই চলবে, সেই আভাস মেলে। যার টাটকা প্রমাণ অমিত শাহের সঙ্গে ধনখড়ের বৈঠক।

রাজ্যপালকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ তলব করেছিলেন, না কি রাজ্যপালই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হন, সেই সংশয়ে জল ঢেলে ধনখড় দিল্লির বিমানে ওঠার আগেই লিখিত বিবৃতিতে জানিয়ে দেন, তাঁকে তলব করা হয়নি। তিনি নিজ উদ্যোগে যাচ্ছেন। কারণ রাজ্যপাল হিসেবে তিনি যা জানছেন, বুঝছেন, শুনছেন, সে সব কথা তিনি শাহকে বলতে চান!

কী বললেন, বৈঠকের পরে সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাজ্যপাল। যার সার কথা হল, রাজ্যে সন্ত্রাসের বাতাবরণ। পঞ্চায়েতের মতো পুরভোটেও সন্ত্রাসের আশঙ্কা আছে। রাজ্যে পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ শাসক দলের তাঁবেদার। বিরোধীরা হামলা ও চক্রান্তের শিকার।

রাজ্যপালের এই বক্তব্যের ঠিক-ভুল, সারবত্তা বা বাস্তবতা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। যা আলোচ্য, তা হল তাঁর ভূমিকা। আবার বলছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠানো রাজ্যপালদের দায়িত্ব। ধনখড় সেই রিপোর্টে তাঁর অভিমত জানাবেন, এটাই প্রত্যাশিত। এর বাইরে ‘অলিখিত’ আরও কিছু বলতে চাইলে সেটাও তাঁর এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজেদের ব্যাপার। কিন্তু তিনি ভিতরে যা-ই বলে থাকুন, বাইরে সেটা ফলাও করে বলার পিছনে আর যে উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হোক, রাজ্যপাল পদের তথাকথিত গরিমা এতে কালিমালিপ্ত হতে বাধ্য। রাজ্যপাল সেটা বোঝেন না, তা নয়।

তবু ধনখড় এমন করলেন কেন? বলা যেতেই পারে, পুরভোটকে শিখণ্ডী খাড়া করে এটা আসলে বিধানসভা ভোটের আগে থেকে পুলিশ-প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করার কৌশল। আর বিলম্ব না করে রাজভবনের তরফে সেই কাজ শুরু হয়ে গেল! এটাই হয়তো অমিত শাহের সঙ্গে জগদীপ ধনখড়ের ‘একান্ত’ বৈঠকের প্রকৃত প্রাপ্তি!

আরও একটি জিনিস লক্ষণীয়। দিল্লিতে প্রশ্নের জবাবে রাজ্যপাল বলেছেন, বিধানসভা ভোটের আগে রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হবে কি না, সেই সিদ্ধান্তের সময় এখনও আসেনি। যার অর্থ, কথার মারপ্যাঁচে সেই সম্ভাবনার জায়গাটিও রাজ্যপাল হিসেবে তিনি জিইয়ে রাখলেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE