সিউড়ির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ফাইল চিত্র
সময়টা ১৯৬২ সাল। শপথ গ্রহণ করলেন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি তথা দার্শনিক, জ্ঞানযোগী, মানবদরদি ভারতরত্ন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। শোনা যায়, রাষ্ট্রপতি হওয়ার কয়েক দিন পরে তাঁর কয়েক জন ছাত্র ও অধ্যাপক বন্ধুবান্ধব ৫ সেপ্টম্বর দিনটি তাঁর জন্মদিন পালন করার অনুমতি চাইলেন। রাধাকৃষ্ণণ তাঁদের বলেছিলেন, ‘‘Instead of celebrating my birthday, my it would proud privilege if September 5 is observed as Teachers’ Day’’. অর্থাৎ, ‘‘আমার জন্মদিন পৃথক ভাবে পালন না করে দিনটি যদি দেশের সমস্ত শিক্ষকদের উদ্দেশে পালন করা হয়, তা হলে আমি গর্বিত হব।’’
সমাজে শিক্ষকদের সম্মান ও অবদানের জন্য ১৯৬২ সাল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের পঞ্চম দিনটি নির্দিষ্ট করে, স্কুল-কলেজে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। প্রধানত ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রিয় শিক্ষক-শিক্ষিকাকে উপহার দেয়। শিক্ষকেরাও তাদের আশীর্বাদ স্বরূপ মিষ্টিমুখ করান। রাধাকৃষ্ণণ মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, এই শিক্ষক দিবসের অন্তরালে ছাত্র দিবসটিও দৃপ্ত হয়ে থাকুক। কারণ শিক্ষকদের শ্রদ্ধা ও সম্মাননা জ্ঞাপন করতে গিয়ে ছাত্রেরা সহজ-সরলভাবে শিক্ষকদের সঙ্গে মিশতে পারে, যা হয়তো বছরের অন্য দিনগুলোতে অতটা সম্ভব হয় না। আবার ওই দিন তাদের অনেকেই শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে শিক্ষাদান প্রক্রিয়াটিকে পরখ করে নিতে পারে। কোনও কালেই কোনও শিক্ষাধারায় ছাত্র ও শিক্ষক দুই আলাদা গ্রহের বাসিন্দা নয়। শিক্ষার সঙ্গে ভালবাসার সংযোগ না ঘটলে সে শিক্ষা সার্থকতা লাভ করে না। উল্টে ছাত্র-শিক্ষক দুস্তর ব্যবধান রচিত হয়ে সমগ্র শিক্ষা প্রক্রিয়াটিই বানচাল হতে বসে। এই রকম একটি ভাবনা থেকেই রাধাকৃষ্ণণ শিক্ষক দিবস পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
একবার একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বলেছিলেন— ‘তবু সর্বোপরি আমি এক জন শিক্ষক। মনেপ্রাণে, আমার বিশ্বাসে, আমার কর্মে আমি সে কথা কখনও ভুলি নি। আমার কাছে ছাত্ররাই পৃথিবীর সবথকে প্রিয়। আমি তাদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসি।’
একটি ঘটনা রাধাকৃষ্ণণের এই বিশ্বাসকে সমর্থন করে। তাঁর কথায়, ‘‘একজন শিক্ষক মনপ্রাণ দিয়ে ছাত্রদের ভালবাসলে, সেখানে সম্পর্ক যে কতটা গভীর হয় সেটা, আমি নতুন করে বুঝলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে। মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত ফুল দিয়ে সাজানো একটি গাড়িতে আমাকে বসিয়ে তারা নিজেরাই টেনে নিয়ে এল। আবেগে আপ্লুত হয়ে মনে হয়েছিল – আমার শিক্ষক জীবনের সার্থকতা তো এখানেই।”
তিনি সকল শিক্ষককেই চিরকালীন এই নির্দেশিকাটি মানতে অনুরোধ করেছন— “Respect for teacher cannot be ordered ; it must be earned” এই মহান দার্শনিক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে অতীন্দ্রিয়বাদের মূল সত্য, সেবা ধর্ম, অন্তদৃষ্টি এবং মানুষকে ভালবাসার প্রয়োজনীয়তার কথা তরুণ মনে এবং কোমল অন্তঃকরণে একবার পরিষ্কারভাবে জাগিয়ে দেওয়া বা গেঁথে দেওয়া যায়, তা হলে পরবর্তী জীবনে কোনও প্রলোভনেই তাদের অধর্মের দিকে প্রলুব্ধ করতে পারবে না। তাঁর ভাবনায় অন্তরাত্মার নতুন তেজ ও শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে শিক্ষক-ছাত্র প্রত্যেকের পক্ষেই প্রতিদিন কিছুক্ষণ শান্ত ও সমাহিত চিত্তে জীবনযাপন করা একান্ত প্রয়োজন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর তো এটা অবশ্য করণীয়। অবশ্যই একজন শিক্ষক এ ব্যাপারে হবেন ছাত্রছাত্রীর পথ প্রদর্শক। ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাঁর হৃদয়ের দরজা সবসময় খুলে রাখতে হবে। তাঁর মনের সম্পদ ও ঐশ্বর্যটুকু তাদের মধ্যে অকাতরে বিলিয়ে দিতে হবে।
আর এক বিখ্যাত শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাধাকৃষ্ণণের শিক্ষাদান ও শিক্ষাভাবনায় বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়ে তাঁকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কবিগুরুর অনুরোধ ছাত্র ও কর্মীবৃন্দের সভায় শিক্ষাতত্ত্বের উপরে ভাষণও দিয়েছিলেন রাধাকৃষ্ণণ। শিক্ষাতত্ত্বকে কী ভাবে মানুষের আধ্যাত্মিক চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করা যায়, সে বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘আমাদের ছাত্রছাত্রীরা আপনার ব্যক্তিগত সংস্পর্শে আসতে পেরে এবং আপনার মৌলিক চিন্তাধারা ও ভগবততত্ত্বের বিস্ময়কর বাগ্মীতা উপভোগ করার সুযোগ লাভ করেছে। তার জন্য আমি বিশেষ খুশি হয়েছি।’’
রাধাকৃষ্ণণ স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেছিলেন, শুধু বিবেকানন্দের নাম-গান করলেই চলবে না। তিনি যে মানবতাবাদী মানুষ তৈরির শিক্ষা দিয়েছেন, তা আমাদের সম্পূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। এই পুণ্যভূমিতে আমাদের যোগ্য নাগরিক হতে হবে।
আর এ কাজে শিক্ষকেরাই শ্রেষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষায় খিলানের কৌণিক পাথরটি হল শিক্ষক। তিনি বিশ্বাস করতেন— “Teachers should be the best minds in the Society”। তাঁদের দ্বারাই একটি সৎ-শোভন-সুন্দর-নিয়ন্ত্রিত সমাজ সৃষ্টি হতে পারে। আর যাঁরা কেবল স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য জগতে এসেছেন, তাঁরা সামজের ক্ষতি করে থাকেন। শিক্ষকসমাজকে বুঝতে হবে, প্রত্যেক শিক্ষার্থী তথা মানুষের মধ্যে একটা আশ্চর্য শক্তি লুকিয়ে আছে। তাঁদের উচিত সেই শক্তির স্বরূপটি উপলব্ধি করা এবং ইতিবাচক বাতাবরণের মধ্যে তার যথার্থ বিকাশ ঘটানো। এর জন্য চাই ত্যাগের মনোভাব। এ জন্য আমাদের আরও বেশি পরিশ্রমী ও উদ্ভাবনী হতে হবে।
১৯৩১ সালে ২৬শে ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনা সভায় রাধাকৃষ্ণণ এক অসাধারণ বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথকে প্রগতিবাদী, মানবতাবাদী, আধ্যাত্মচেতনাসম্পন্ন এক অসাধারণ মানুষ ও বিরল শিক্ষক বলে বর্ণনা করেন। তিনি মনে করতেন, ছাত্রদের আরও বেশি বেশি রবীন্দ্রনাথ পড়তে হবে। কারণ, তাঁর লেখার মধ্যে এমন একটি আন্তরিকতা আছে, যার আবেদন চিরন্তন ও সার্বজনীন। শিক্ষক রবীন্দ্রনাথও বিশ্বাস করতেন, আন্তর্জাতিকতাবোধ বিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর মানসিক কাঠামোকে তৈরি করতে পারেন শিক্ষক। এ জন্য তাঁকে কল্পনাপ্রবণ ও সৃজনশীল হতে হবে। শিক্ষক তাঁর আচার-আচরণে সহজ, সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপনের দ্বারা ছাত্রদের সামনে এক চিরকালীন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।
লেখক বোলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy