বালিগঞ্জের প্রৌঢ়া চিত্রা দেবীর জীবনে করোনা-কাল এক নতুন উপলব্ধি নিয়ে এল। একা থাকেন, ছেলেমেয়ে থাকে আমেরিকায়। কেয়ারটেকার নমিতা, ড্রাইভার তারাপদ, ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট শিবানী, পাম্প অপারেটর বঙ্কু, এঁরাই তাঁর সহায়। তাঁরা আসেন ট্রেনে, বাসে, সাইকেলে। করোনার ভয় উপেক্ষা করে তাঁরা যা সেবা করেছেন, তা ভুলতে পারেন না চিত্রা। ছেলেমেয়েকে ফোনে বলেন, “এরা না থাকলে আমার চলত কী করে?”
কিন্তু এই কর্মীদের কদর কতটা? সমাজের কোন কাজের কী কদর, তার অন্যতম আয়না বিয়ের পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপন; সেখানে তিন-চারটি ডিগ্রি, ছ’-সাতটি পেশারই চাহিদা। নিযুক্তির নিরিখে দেশের মোট ৪৫ কোটি কর্মীর মধ্যে যদিও ওই ছ’সাতটি পেশার কর্মী দুই কি তিন শতাংশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও সেই ভাবেই গুরুত্ব বিচার করে। তাই মোট ৩৯ হাজারের মতো ডিগ্রি কলেজ, আর আটশো বিশ্ববিদ্যালয় আছে। অন্য দিকে নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে মাত্র ৮৬০০, আইটিআই আছে দশ হাজার মতো। প্রতি বছর ৩.২ লক্ষ নার্স তৈরি হচ্ছেন, ১৪ লক্ষ প্রযুক্তিবিদ আইটিআই ডিপ্লোমা নিয়ে বার হচ্ছেন। অন্য দিকে, আড়াই কোটি গ্র্যাজুয়েট, ২৭ লক্ষ পোস্ট গ্রাজুয়েট, আর ১.৮ লক্ষ ডক্টরেট বেরোচ্ছেন।
করোনা সারা বিশ্বের মতো এ দেশেও প্রশ্ন তুলেছে যে নার্স, ডাক্তার, আয়া, অ্যাম্বুল্যান্স কর্মী, জঞ্জাল সাফাই বা শ্মশান কর্মী, আশা কর্মী, পুলিশ, পুরকর্মী, দুধ, রুটি, বা ওষুধ কারখানার শ্রমিক—এঁদের দায়িত্ব, পরিশ্রম ও দক্ষতার কদর কি সমাজ দিয়েছে? এঁরা ঘরে বসে থাকলে আরও কত লোক বিপন্ন হত! অথচ, বিশেষ সম্মান তো দূরের কথা, এঁরা অনেকেই ঠিক সময় মাইনে পাননি, সুরক্ষা-কিট পাননি, যানবাহনের সুবিধা মেলেনি এঁদের।
সমাজে কোন কাজগুলির বেশি কদর হওয়া উচিত, আর কদরের সঙ্গে রোজগারের সমতা কতটা জরুরি, এই প্রশ্নটা তাই নতুন করে উঠে এসেছে। কাজকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়— কায়িক, মানসিক, আর সংবেদনশীল (ইমোশনাল)। কায়িক কাজে শরীরের পরিশ্রম বেশি হয়, মানসিক কাজে মস্তিষ্কের, আর তৃতীয়টিতে, শরীর মস্তিষ্ক ছাড়াও, সংবেদনশীলতার প্রয়োজন হয়। যেমন বাচ্চা সামলানোর কাজ। এই তিনটির প্রতিটির মধ্যে দক্ষতার কিছুটা স্তর বিভেদ সম্ভব। দায়িত্বকেও নানা ভাগে ভাগ করা যায়, ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের নিয়মে যেমন করা যায়, তেমনই সামাজিক গুরুত্বের নিয়মে করা যেতে পারে। আর পরিশ্রম মাপা তো শ্রম বিভাজনের বহু কালের কাজ, কিন্তু এই আধারে, তার সঙ্গে পরিশ্রমের ক্ষেত্রটিও ভাবতে হয়। যেমন ময়লা তোলার পুরকর্মীর পরিশ্রম, সুপার মার্কেটের সেলস কাউন্টারে ১০ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কাজ করা মেয়েটির পরিশ্রম।
এক শতক হতে চলল, আমরা কাজের মূল্যকে জিডিপির চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। তাই আজ আইটি কোম্পানির কাজের কদর বেশি, শিক্ষিকার কদর কম, পুরকর্মীর কদরই নেই। শুধু তা-ই নয়, তার সঙ্গে জ্ঞান, মেধা, ও দক্ষতা সম্পর্কেও একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। যে কাজ সর্বজনীন ন্যায় ও কল্যাণকে ঊর্ধ্বগামী করে, বা পরিবেশ সংরক্ষণ করে, তাকে আমরা কম কদর করি। যে কাজ কোম্পানির ও ব্যক্তির পকেট ভরায়, তাকে আমরা বেশি কদর করেছি, সেই কর্মীদের বেশি ‘মেধাবী’ ভেবেছি। যে কাজ মানুষ বাঁচায়, পরিবেশ বাঁচায়, সেগুলিকে ‘সামান্য মেধার কাজ’ বলে ভেবেছি।
মানব সভ্যতা একুশ শতক পেরোবে কি না, তার সম্ভাবনা নিয়ে নানা অঙ্ক কষা চলছে। যদি পেরোতে হয়, তা হলে সমাজে কাজের গুরুত্ব ও কদরের সম্পর্কে আজকের বিশ্বাস অনেকটাই পাল্টাতে হবে। শুধু দক্ষতা নয়, তা ছাড়াও দায়িত্ব এবং পরিশ্রম— এই তিনটি আধারের নিরিখে বিচার করে কাজের পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। করোনা সঙ্কটের সময়ে অনেকেই সে কাজটা করছেন নতুন করে।
নিউ জ়িল্যান্ডে সম্প্রতি চালু হল রোজগার সমতা (পে-ইকুইটি) আইন। একই রকমের দক্ষতা, একই রকমের দায়িত্ব, আর একই রকমের পরিশ্রম— এই তিনটি আধারের ভিত্তিতে বিভিন্ন কাজের মাইনের মধ্যে সমতা আনা হয়েছে সে দেশে। এই আইন কানাডাতে ইতিমধ্যেই আছে, আমেরিকার কয়েকটি রাজ্যেও আছে। নিউ জ়িল্যান্ডের কৃতিত্ব, তাদের পার্লামেন্টে বিনা আপত্তিতে এই আইন পাশ হয়েছে।
শ্রমের বিভাজন যদি বাজারের নিয়ম, আর জাতি-লিঙ্গ ব্যবস্থার নিয়মে আটকে থাকে, তা হলে আমরা কখনওই কাজের যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারব না। তা করতে গেলে দক্ষতার মধ্যে সংবেদনশীলতাকে, আর তার সঙ্গে দায়িত্ব আর পরিশ্রমকে সামাজিক গুরুত্ব ও কল্যাণের নিরিখে বিচার করতে হবে। তা হলে কাজের মূল্যের এক নতুন সংজ্ঞা খুঁজে পাব। কানাডা, নিউ জ়িল্যান্ডে এই সংজ্ঞা ব্যবহার করে কর্মীরা, বিশেষত মেয়েরা উপকৃত হচ্ছেন। আমাদের দেশ এই ভাবনা নিয়ে এগোলে সমাজ সংস্কারের কাজটা কিছুটা এগোবে।
আজ়িম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy