Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়ে নিতে হবে জীবনভর

লক্ষ্মণরেখার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে এক দিন সানারাও শিখে যান, চাইলেই সব বলা যায় না, লেখা যায় না। সানাদের আসলে অনেক কিছুই করতে মানা।

জিনাত রেহেনা ইসলাম
শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ২২:৪২
Share: Save:

সানা গঙ্গোপাধ্যায়ের টুইট সাড়া ফেলেছিল আম বাঙালির মনে। কিন্তু জটিলতা ধেয়ে এল একটু পরেই। সামাল দিতে নামতে হল ‘এ ভাবেও ফিরে আসা যায়’-এর নায়ককে। তিনিও বুঝিয়ে দিলেন, ২২ গজের যোদ্ধা আদপে এক জন দুর্বল অভিভাবক ও ভীতু পিতা। তা বেরিয়ে পড়ল সঙ্কটের মতো। এই ভয় আসলে নতুন ভারতের মূল্যবান মূলধন। মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়। অকারণ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়। আশঙ্কা ও উদ্বেগ মেয়েকে নিয়ে। তাই এড়িয়ে যাওয়া। এর মধ্যে মুখোশ নেই। আড়াল নেই। এটাই আমাদের সমাজে অনেক আদর্শ কন্যাসন্তানের বাবার ভূমিকা। এই চিত্রের সঙ্গে ভাল করেই সম্পৃক্ত বাঙালির পারিবারিক জীবন।

সানার টুইট খুব সঙ্গত। দেশ জুড়ে রাস্তায় ছাত্রছাত্রীর ঢল। ভাঙছে হাঁটু, গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে আঙুল! বেরিয়ে এসেছে চোখের লেন্স। চলেছে গুলিও। কিন্তু হার না মানা স্পর্ধা নিয়ে আন্দোলন চলছে। এমন ঢেউয়ের স্পর্শে সানাও নড়েচড়ে বসবেন নাই বা কেন? এই তো সময় নিজের সহনাগরিক, বন্ধু ও প্রতিবাদীদের পাশে দাঁড়ানোর! বিপদের মুখে তাঁদের দেখেও চুপ করে থাকাটা কি বীরত্বের? নাকি দেশপ্রেমের? তাই তো সানার তরফে ছিল এই টুইট ও ইনস্টাগ্রাম পোস্ট। নেট দুনিয়া অভিনন্দন জানাল সানাকে! পা মেলানোর সুযোগ না পেলেও কণ্ঠ মেলালেই বা কী ক্ষতি! উচ্চবিত্ত পরিবারের নামী প্রতিষ্ঠানে পড়া মেয়ে কি সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে শিখবেন না?

বড় প্রশ্নের বড় উত্তর আশা করা যায়। তাই সানা যে প্রশ্ন তুলেছেন তা নিয়ে বড় করে ভাবা দরকার। মৌলিক অধিকার আজ বড় প্রশ্নের মুখে। নাগরিকের অধিকার সশস্ত্র পুলিশের বন্দুক ও লাঠির ডগায় নিঃশ্বাস ফেলছে। সানার মতো ছাত্র-যুবদের যা একদম পছন্দ নয়। সেই অপছন্দের ভাষা তাঁরা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। নিজের মত প্রকাশের জন্য কারও আগাম অনুমতিও প্রার্থনা করেন না তাঁরা। তবে অভিভাবকের সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নেন। এই প্রজন্মের মেয়েদের কাছে দেশ ও অভিভাবকের মধ্যে তেমন ফারাক নেই। দুটোর মান বাঁচাতেই তাঁদের অন্তর অস্থির।

বাধ্য থাকা মেয়েদের চয়েস। কিন্তু এই মেনে নেওয়ার মধ্যে যে কোনও মহত্ত্ব নেই, এটা তাঁরা শেখেন না। শেখানোও হয় না। মতামত দাবিয়ে রাখার মধ্যেই নম্রতার অনুশীলন। স্পষ্ট কথা না বলতে দেওয়ার মধ্যেই সংস্কৃতির অলিখিত জয়। এই অবদমনের আর এক নাম বুঝি মেয়েদের শালীনতা! প্রতিবাদহীনতার নাম সম্ভ্রম রক্ষা। এই উল্টো সহজপাঠ রপ্ত করা সমাজে গন্ডগোল শুরু হয় যখন সানারা মাথা তোলেন। তখন একটা সীমারেখা টেনে দেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়ে। এই লক্ষ্মণরেখার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে এক দিন সানারাও শিখে যান, চাইলেই সব বলা যায় না। ইচ্ছে হলেই সব লেখা যায় না। সানাদের আসলে অনেক কিছুই করতে মানা। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সানা বোঝেন, বড্ড চতুর পৃথিবীতে তাঁর একটি টুইটের রাজনৈতিক মূল্য বিলিয়ন ডলার। বাবার না ও পরিবারের বয়ানের সামনে নেটিজেনের আদর ও উচ্ছ্বাস নিমেষে তুচ্ছ হয়। বুঝতে হয়, ভিড় থেকে দূরে থাকার নিরাপত্তাজনিত পরামর্শ। জনতাবলয় অনুকূল নয়, এই পাঠ ধীরে ধীরে রপ্ত করেন সানারা।

এই ভয় জয় করার কথা কোনও বইয়ে লেখা নেই। অগত্যা অভিভাবকের প্রেসক্রিপশনই শেষ কথা। মেয়ের যাবতীয় কী ও কেন-এর জবাবের দায় একান্তই মেয়ের বাবার। এই গ্লানি থেকে ও এই দর্শনের সমাজ মানসিকতা থেকে মেয়ের বাবার দূরত্ব রক্ষার নিরন্তর প্রয়াস থাকে। নিরাপত্তার প্রশ্নে মেয়েদের আগলে রাখার উপায় হাজার সমালোচিত হলেও সেটাই পরিবারে সবচেয়ে মুখ্য হয়। সানার নিরাপত্তার দায় একান্ত ভাবেই তাঁর বাবার। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিও এই মুহূর্তে দেশের বেশিরভাগ বাবারই দর্শন। মেয়ের যেন কোনও বিপদ না হয়! পরিবারের কোনও আচরণ বা সানার কোনও বিষয় যেন তাঁর নিরাপত্তার সঙ্গে জুড়ে না যায়। তার জন্য যা করার শেষতক পরিবারকেই করতে হয়। তার ব্যাখ্যা মানুষ যে ভাবেই করুক, সত্যিই কিছু ফারাক পড়ে না।

ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সারা দেশ ওয়াকিবহাল। ওয়াকিবহাল মেয়ের বাবারাও। তাঁরা মেয়েদের সাহস না দিয়ে বাড়তি উদ্বেগের পথে হেঁটে বাচ্চাদের সতর্ক করবেন, এটাই বাস্তব। সেই বাস্তব বদলের প্রক্রিয়া তেমন সক্রিয় হয়ে ওঠেনি। সানাও ব্যতিক্রম নন। চুপ করে যাওয়া ও বিষয় থেকে চটজলদি সরে যাওয়ার গার্হস্থ্য কৌশলে অভ্যস্ত মেয়েরা। তবে কি কপালে লেখা এই ভয়ের জীবনরেখা থেকে সানারা বেরোবেন না কোনও দিন? কারও সাবাশি কি কোনও ভাবে ওঁদের বলে দেবে না সাহসের পথটাই জীবনের অন্যতম নির্বাচিত পথ। এর বাইরের সব রাস্তা মিথ্যে, অর্থহীন। পরিচয়ের হাই প্রোফাইল গণ্ডী পেরিয়ে এক দিন এই ব্যক্তি সানাকেই কিন্তু হাতে তুলে নিতে হবে ব্যাট। বাবার মতোই বাউন্ডারি লাইন পার করাতে দেখা যাবে বিপক্ষ মত। নিশ্চিত সে দিন স্বমহিমায় ফিরবেন সানা গঙ্গোপাধ্যায়। যুক্তির ঝড়ে একের পর এক ছক্কা হাঁকাবেন। কোণঠাসা করবেন সব আক্রমণ।

এমন স্বপ্ন দেখার পরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়! এই ঘটনার পরে দেশের হাজার হাজার সানা কি কোথাও আটকে গেলেন আজ? এক নতুন উদাহরণের শিকার হলেন তাঁরা? কোটি কোটি প্রবাদের সঙ্গে যোগ হল নতুন বাক্যবাণ— ‘দেখলি তো! এত বড় ক্রিকেটারের মেয়ে! এত ক্ষমতা। সেও এ সবে মেয়েকে জড়াতে বারণ করছে!’ এই ‘এ সবের’ অভিধানে নিজেদের আটকে রাখার পথ শুধু চওড়াই হয়। চিহ্নিত ও স্বীকৃত দুর্বলকে আরও ভীত করে চারপাশে দেওয়াল তুলে দেওয়ার মধ্যেই কি সুরক্ষাকবচ লুকিয়ে? সানার অভিমত বন্দি হয়ে গেল। সেই সঙ্গে হাজার কিশোরীর নির্বাসন হয়ে গেল না তো?

পাতা জোড়া মেয়েদের হেনস্থার কাহিনি পড়ে ও দেখে বড় হওয়া পুরুষ যখন এ দেশে কন্যাসন্তানের পিতা হয় তখন অজান্তেই এক নিরাপত্তাহীনতার ভয় মিশে যায় ভাবনায়। তবুও বহরমপুর শহরের এক বাবা কাজের ভিড় ঠেলে মেয়েকে ক্যারাটে ক্লাসে নিয়ে যান। নিজের মেরামত করা পুরানো সাইকেলে মেয়েকে ক্যারাটের পোশাকে বসিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে প্রতিদিন অনুশীলনের পরে বাড়ি ফেরেন। মেয়েকে ঘরের গণ্ডী থেকে বাইরের দুনিয়া ইঞ্চি ইঞ্চি লড়ে নিতে শেখান তিনি। ক্যারাটের মাঠ ফেরত ওই ছাপোষা ভীত মধ্যবিত্ত বাবা কি কোথাও থমকে গেলেন আজ? কন্যার আত্মরক্ষার দায় শিক্ষার মতোই জরুরি হয়ে উঠছিল যে অভিভাবকের সামনে, তিনিও কি রাস্তার কোনও এক সিগন্যালের সামনে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবলেন, ‘ধুস, মেয়েকে ক্যারাটে শিখিয়ে কী হবে? দেশে কেউই নিরাপদ নয়!’ সাহসের পাঠ এমনি করেই থমকে যাবে না তো আজ কোনও এক মেয়ের বাড়িতে? অনেক মশালের ভিড়ে কোনও এক বাড়িতে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তে বলা হবে না তো কোনও মেয়েকে? যার কথা ছিল আগামীর প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটার।

লেখক: শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল

অন্য বিষয়গুলি:

Sana Ganguly Sourav Ganguly
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy