কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন জানাইয়াছেন, বায়ুদূষণ মন্দ ঠিকই, কিন্তু তাহাতে প্রাণহানি হইতেছে, এমন দাবি করা খানিক বাড়াবাড়ি হইবে। যে যুক্তিটি তিনি ব্যবহার করিয়াছেন, তাহা সরকারি মহলে বহুলপ্রচলিত— মহামারি হইতে ডেঙ্গি, হরেক ক্ষেত্রে প্রযুক্ত— স্বাস্থ্য খারাপ হইলে মানুষ এমনিই মরিয়া যায়, তাহার জন্য অন্য কিছুকে দোষারোপ করা ঠিক নহে। দিল্লি যখন বিষবাষ্পে ডুবিয়া আছে, তখন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রীর এহেন উক্তিকে নেহাত ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ভাবিলে ভুল হইবে। মনে রাখিতে হইবে, গত তিন দশকে সুপ্রিম কোর্টের বিবিধ পর্যবেক্ষণ বিশুদ্ধ বায়ুর অধিকারকে মানুষের জীবনের অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবেই দেখিয়াছে। হর্ষ বর্ধনের মন্তব্যটিকে সেই প্রেক্ষিতে বিচার করাই বিধেয়— তিনি সম্ভবত জীবনের অধিকারের প্রশ্নটিকে গোড়ায় মারিয়া রাখিতে চাহিয়াছেন। তবে, এমন বিপুলসংখ্যক মানুষের ফুসফুসে রোগ কেন বাসা বাঁধে, সেই প্রশ্নের উত্তর হর্ষ বর্ধন দেন নাই। তিনি পেশায় চিকিৎসক, কাজেই উত্তরটি তিনি নিশ্চয়ই জানিবেন। তবুও বলেন নাই, কারণ দিল্লির বিষবায়ু অপেক্ষা তাঁহাদের নিকট রাজনীতির সমীকরণ অনেক বেশি জরুরি প্রশ্ন। নচেৎ তিনি, অথবা তাঁহারা, প্রথমেই স্বীকার করিতেন, দিল্লি এবং সংলগ্ন এলাকায় যাহা চলিতেছে, তাহা মানুষের মৌলিক অধিকারকে প্রবল ভাবে ক্ষুণ্ণ করিতেছে। কোনও সভ্য দেশ তাহার নাগরিকদের এই দূষণে বাঁচিতে (অথবা, মরিতে) বাধ্য করিতে পারে না। এবং, এই স্বীকারোক্তির পর তাঁহারা বায়ুর হাল ফিরাইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িতেন। প্রশ্ন শুধু কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের দায়িত্বের নহে। রাজনৈতিক ব্যবধান ভুলিয়া এই সমস্যার সমাধান করিতে সচেষ্ট হওয়াই সভ্যতার, এবং রাজনৈতিক পরিণতমনস্কতার পরিচায়ক হইত।
তাহার পরিবর্তে ঘোলা হাওয়ায় মাছ ধরিবার প্রতিযোগিতা চলিতেছে। ভক্তরা উদ্বাহু হইয়া বলিতেছেন, হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করিয়া দীপাবলিতে বাজির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় যে কোনও লাভ হয় নাই, তাহা স্পষ্ট হইয়া গেল। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পঞ্জাব ও হরিয়ানার উপর দায় চাপাইয়াছেন— অস্যার্থ, সেখানে খেতে ফসল কাটিয়া লওয়ার পর পড়িয়া থাকা গোড়া জ্বালাইয়া দেওয়াই এই দূষণের একমাত্র কারণ। হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী আবার দিল্লির দিকে কামান ঘুরাইয়া দিয়াছেন। তাঁহার দাবি, যেহেতু দিল্লির মানুষও সেই ফসলই খান, অতএব ফসলের গোড়া জ্বালাইবার বদলে অন্য কোনও ব্যবস্থা চাহিলে দিল্লিকেও টাকা দিতে হইবে। যে কোনও প্রশ্নে যে রাজনীতিই মুখ্য, আরও এক বার প্রমাণ হইতেছে।
সেই তরজার ধোঁয়াশায় জরুরি প্রশ্নগুলি ঢাকা পড়িয়া যাইতেছে। আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও খেতে ফসলের গোড়া জ্বালানো হয় কেন, উত্তর নাই। দিল্লির দূষণের জন্য এই বাৎসরিক অপকীর্তিটি কতখানি দায়ী, সেই আলোচনাও নাই। কৃষকদের ঘাড়ে দায় চাপাইয়া দেওয়া সহজতম বিকল্প, কাজেই নেতারা তাহাকেই বাছিয়াছেন। দিল্লি এবং পরিপার্শ্বে বিপুল নির্মাণ ব্যবসার কথা তাঁহারা উল্লেখ করেন না। বলেন না, ২০০০ সিসি-র বেশি ক্ষমতার ইঞ্জিনসম্পন্ন ডিজেল গাড়ির উপর নিধেষাজ্ঞা জারি করিবার পরও তাহা তুলিয়া লওয়া এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শিল্পক্ষেত্রের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাবের কথা আলোচনায় আসে না। কারণ, প্রতিটি প্রশ্নই বিপজ্জনক, তাহার সহিত অর্থ এবং ক্ষমতার যোগ স্পষ্ট। নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষা করিবার চেষ্টায় সেই স্বার্থে ঘা দেওয়ার বাসনা রাজনীতিকদের নাই। অতএব, তাঁহারা কুযুক্তি এবং ভ্রান্ত তর্ককেই সার মানিয়াছেন। তাহাতে দিল্লির ফুসফুস যদি ঝাঁঝরা হইয়া যায়, তো যাউক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy