Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

বনস্পতিরও ছায়া লাগে

প্রবীণদের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কারণ এ দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়তে বাড়তে প্রায় সত্তরে পৌঁছেছে।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৯ ০১:০১
Share: Save:

সম্প্রতি নরেন্দ্রপুর, বেহালা, নেতাজিনগর, সোদপুর-সহ বেশ কিছু জায়গায় পর পর প্রবীণ মানুষের মৃত্যু ঘটল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাঁরা একা থাকতেন। অর্থাৎ, এঁদের অনেকেই অরক্ষিত ছিলেন। মৃত্যু সেই খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে। এই অবস্থা এক দিনের বঞ্চনার ফল নয়। দীর্ঘ একাকিত্বের কাহিনি অনেক বয়স্ক মানুষের যাপনেই রচিত হচ্ছে। দুর্ঘটনা তাকে প্রকাশের আলোয় আনছে মাত্র।

সেই সন্তানদের ক্ষমা নেই, যারা মা-বাবাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে একা ফেলে যায়। কেউ তাঁদের ঘরে বন্ধ করে বেড়াতে চলে যায়, কেউ অচেনা স্টেশনে বসিয়ে দিয়ে আসে, আবার কেউ মারধর করে জন্মদাত্রীকে নিজের বাড়ি থেকেই তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এমনও সন্তান আছে, যারা পরিস্থিতির কারণে মা-বাবার সঙ্গে থাকতে পারে না। তাদের ‘খলনায়ক’ বানিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। শোনা যাচ্ছে, পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রবীণ মানুষদের খবর নিচ্ছে। এঁদের জন্য রাজ্যে বিশেষ সেল তৈরি হচ্ছে। এমন উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু বিপুল জনসংখ্যার এই উপমহাদেশে পুলিশ প্রহরায় সত্যিই কি সমস্ত বৃদ্ধ মানুষকে ভাল রাখা সম্ভব?

প্রবীণদের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কারণ এ দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়তে বাড়তে প্রায় সত্তরে পৌঁছেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতের প্রবীণদের সংখ্যা কুড়ি শতাংশ বেড়ে যাবে। শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁরা যাতে সমাজের ‘দায়’ না হয়ে ‘অলঙ্কার’ হতে পারেন, তার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চাই। প্রবীণদেরও মানবাধিকার আছে। তাঁদের শারীরিক, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব আমাদের। দেখতে হবে, এঁরা অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলি মেটাতে পারছেন কি না। সঞ্চয় সুরক্ষিত রাখার মতো আইনি সহায়তা পাচ্ছেন কি না। সহযাপকদের ব্যবহারে সেই উষ্ণতা থাকছে কি না, যা তাঁদের ভাল ভাবে বাঁচার উৎসাহ জোগাবে।

ভারতে বয়স্করা কেমন আছেন, তা নিয়ে গবেষণা চালিয়েছে অনেক সংস্থা। ২০১৬ সালে ‘অল ইন্ডিয়া সিনিয়র সিটিজ়েন্স কনফেডারেশন’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে গড়ে ৬৫ শতাংশ প্রবীণই পরনির্ভরশীল। প্রায় ৮০ শতাংশ বয়স্ক মানুষের চিকিৎসার সঙ্গতি নেই। ৩৯ শতাংশ প্রবীণকে তাঁদের ‘আপনজন’ ফেলে গিয়েছে। ‘আগরওয়াল ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এঁদের ৩৭ শতাংশ প্রত্যহ পরিবার ও সমাজে অপমানিত হন। ১৩ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। সত্যি যে, পরিসংখ্যান সব সময় ঠিক বলে না। কিন্তু সমাজের দিকে তাকালে যে হতাশ, অসুস্থ, অসহায় এবং একা মানুষদের দেখা যায়, তাঁদের জীবনের ধূসরতা পরিসংখ্যানকেও ছাড়িয়ে যায়! উচ্চ বা মধ্যবিত্ত পরিবারেও প্রবীণরা অনেকাংশেই অসুখী এবং অবহেলিত। গ্রামের বয়স্ক মানুষদের প্রায় ৬০ শতাংশকে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য প্রত্যহ অমানবিক পরিশ্রম করতে হয়। মহিলাদের অবস্থা আরও খারাপ। একে লিঙ্গবৈষম্যের অভিশাপ, তার উপর শিক্ষা এবং মুক্ত পরিবেশের অভাব অধিকাংশের জীবনকেই নারকীয় করে তোলে।

ভারতের বেশির ভাগ প্রবীণ তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। শারীরিক বা মানসিক দুর্বলতার কারণে, লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে নিজের অধিকার বুঝে নিতেও পারেন না। ফলে সন্তান বা আত্মীয়বর্গ সহজেই তাঁদের ভুলিয়ে সর্বস্বান্ত করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রবীণদের জন্য অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ‘ইউনাইটেড নেশন পপুলেশন ফান্ড’ (ইউএনএফপিএ) তৈরি হয়েছে। এ দেশেও বয়স্কদের সাহায্যার্থে কেন্দ্রীয় স্তরে বেশ কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যেমন, ‘ন্যাশনাল হেলথ প্রোটেকশন স্কিম’, ‘ন্যাশনাল পলিসি ফর সিনিয়র সিটিজ়েন্স’, ‘প্রোটেকশন এগেন্সট এক্সপ্লয়টেশন’, ‘ন্যাশনাল ওল্ড এজ পেনশন স্কিম’, ‘অ্যাডাল্ট এডুকেশন প্রোগ্রাম’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও বহুল প্রচারিত ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর আওতায় এ দেশের পঞ্চাশ কোটি নাগরিককে এনে চিকিৎসার খরচ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এই সুযোগ ক’জন নিতে পারছেন, সন্দেহ থেকে যায়। কারণ ভারতের একটা বড় অংশ এখনও অশিক্ষা, বিচ্ছিন্নতা, কুসংস্কারের অন্ধকারে বাস করে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়া বয়স্ক মানুষ তবু তাঁর অধিকার, সুখসুবিধা খানিক আদায় করতে পারেন। বাকিদের অবস্থা মোটেই আশাপ্রদ নয়। এর প্রমাণ শুধু পরিসংখ্যান দেয় না, রাস্তায় মরে কাঠ হয়ে পড়ে থাকা বৃদ্ধা থেকে শুরু করে ধর্মস্থানের সামনে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে বসে থাকা বৃদ্ধ, সর্বত্রই প্রমাণের ছড়াছড়ি।

কাজেই একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা চাই। কেন্দ্র ও রাজ্য— দুই স্তরেই গবেষণা এবং আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এমন পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে, যার মধ্যে সমাজের সমস্ত স্তরের প্রবীণ মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা পান। বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী দু’জনের মা-বাবাই যাতে দু’জনের সান্নিধ্য এবং যত্ন পান, দেখতে হবে। যাঁদের কেউ নেই বা যাঁরা ঘটনাচক্রে একা, তাঁদের ব্যবস্থা রাষ্ট্র এবং রাজ্যকে মিলেমিশে করতে হবে। সেই ব্যবস্থা খাদ্য, আশ্রয় এবং ওষুধপত্রের পাশাপাশি আনন্দ-উৎসবের জোগানও দেবে। এক কালে এই দেশকে ছায়া দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদেরও বয়সকালে ছায়া লাগে। সে ছায়া তাঁদের অধিকার, অনুকম্পার দান নয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Security Senior Citizen
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy