Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪

সে কালের বইপাড়ায় প্রকাশনা ব্যবসা খুলেছিলেন বিদ্যাসাগর

আলুপটল অবশ্য বেচেননি বিদ্যাসাগর। কিন্তু বই বেচেছিলেন। নিজের বইয়ের স্বত্ত্ব প্রকাশককে বেচা নয়। রীতিমতো প্রকাশনা-ব্যবসা খুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

আশিস পাঠক
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:২৯
Share: Save:

সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের চাকরি তখন ছেড়ে দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিরোধটা বেধেছিল সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে। কী ভাবে পড়ানো হবে ছাত্রদের, তাই নিয়ে। রসময়বাবু তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করতে লাগলেন আড়ালে, চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদ্যাসাগর খাবে কী! বিদ্যাসাগর শুনে বললেন, ‘রসময়বাবুকে বলো বিদ্যাসাগর আলু পটল বেচে খাবে।’

আলুপটল অবশ্য বেচেননি বিদ্যাসাগর। কিন্তু বই বেচেছিলেন। নিজের বইয়ের স্বত্ত্ব প্রকাশককে বেচা নয়। রীতিমতো প্রকাশনা-ব্যবসা খুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি। বাণিজ্যে বাঙালি তখনও বীতরাগ। আর মুদ্রণ বা প্রকাশনার ব্যবসায় তো সে ভাবে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বাঙালি তখন আসেইনি।

কিন্তু পথ কেটে চলাটাই যে বিদ্যাসাগরের স্বভাব। আর তাই আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগে নিজেদের বই নিজেদের মতো করে ছাপবেন বলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার দু’জনে মিলে ছাপাখানা খুলেছিলেন ‘সংস্কৃত যন্ত্র’ নাম দিয়ে। সে ছিল কাঠের প্রেস, দাম ছ’শো টাকা। কিন্তু সে কালের বাজারে ছ’শো টাকাই বা বিদ্যাসাগর পাবেন কোথায়? শেষে ধার করলেন বন্ধু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ধার তো করলেন। কিছু দিন পরেই সে টাকা শোধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বিদ্যাসাগর। গেলেন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের মার্শাল সাহেবের কাছে। বললেন, ‘আমরা একটি ছাপাখানা করিয়াছি, যদি কিছু ছাপাইবার আবশ্যক হয়, বলিবেন।’

বর্ণপরিচয়।

মার্শাল কাজ দিয়েছিলেন। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল ছাপার কাজ। অন্নদামঙ্গল তখন ছাপা ছিল না এমন নয়। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পড়ুয়া সিভিলিয়ানদের যে বইটি পড়ানো হত তা ছিল ‘অত্যন্ত জঘন্য কাগজে ও জঘন্য অক্ষরে মুদ্রিত, বিশেষত অনেক বর্ণাশুদ্ধি আছে।’ অতএব মার্শাল সাহেবের অনুরোধে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে আদি, অথেন্টিক অন্নদামঙ্গলের পুথি আনিয়ে ছাপলেন বিদ্যাসাগর আর মদনমোহন। ছ’টাকা প্রতি কপি দামে একশো বই কিনে নিল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। ওই ছ’শো টাকায় শোধ হল নীলমাধবের ধার। বাকি কপি বিক্রির টাকা রইল প্রেসের উন্নতির জন্য। সাহিত্য, ন্যায়, দর্শনের নানা বই ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জন্য ছাপতে লাগলেন বিদ্যাসাগর। প্রেসেরও সম্বল বাড়তে লাগল।

সিলেবাসের বইই ছাপতেন বিদ্যাসাগর, সংস্কৃত প্রেস থেকে। তাঁর বইয়ের দোকান সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি ছিল কলেজ স্ট্রিটে। ‘বইপাড়া’ হয়ে ওঠা তো দূর অস্ত্, কলেজ স্ট্রিটে তখন বইয়ের দোকানই ছিল না। তখন বটতলার বইওয়ালাদের যুগ। প্রধানত চিৎপুর এলাকায় ছাপা হত বটতলার বই। বিক্রি হত বই ফিরিওয়ালাদের মাধ্যমে। অর্থাৎ বই পৌঁছে যেত ক্রেতার কাছে। সে ইতিহাস আজকের বই-ব্যবসায় পুনরাবৃত্ত হয়েছে। কলেজ স্ট্রিটের গণ্ডি ছাড়িয়ে সরাসরি সম্ভাব্য ক্রেতার ঘরে হানা দিচ্ছেন প্রকাশকেরা। কিন্তু আজকের মতো সংগঠিত, গতিময় হোম ডেলিভারি বটতলার যুগে ছিল স্বপ্নেরও অতীত। সুতরাং, তখন দরকার ছিল, বইয়ের একটা স্থায়ী ঠিকানার। আর সে দরকারটা ধরা পড়েছিল বীরসিংহের সিংহশিশুর দূরদর্শিতায়। এতটাই সে দূরদর্শিতা এবং ব্যবসায়িক বুদ্ধি যে তাঁর সময়ে বিদ্যাসাগর ছিলেন পাঠ্যবইয়ের রীতিমতো তাক-লাগানো ব্যবসায়ী।

১৮৫৫ সাল নাগাদ বইয়ের ব্যাবসা থেকে মাসে অন্তত হাজার তিনেক টাকা আয় হত বিদ্যাসাগরের। বছর দুয়েক পরে কলকতার ছেচল্লিশটি প্রেস থেকে ৫৭১৬৭০ কপি বাংলা বইয়ের মধ্যে সংস্কৃত প্রেস থেকে ছাপা বই ছিল ৮৪২২০টি। এক বছরে বিদ্যাসাগরের বইয়ের ২৭টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এমন তথ্যও আছে। আজকের বিচারে পরিসংখ্যানগুলোর মানে দাঁড়ায় সে কালে পাঠ্যবইয়ের বাজারের অনেকটাই ছিল বিদ্যাসাগরের দখলে।

এর পিছনের রসায়নটা কী তা নিয়ে বহু তর্ক আছে। সরকারি সাহায্যের অবদান এর পিছনে কতটা সে প্রশ্নও অনেকে তোলেন। অন্তত এই বিষয়বুদ্ধি বিদ্যাসাগরের ইমেজের সঙ্গে যায় কি না তা-ও অনেকের ভাবনার বিষয়। আর এই ভাবনাগুলো থেকেই একটা সোজা কথা উঠে আসতে পারে তাঁর এই দ্বিশতবর্ষে। ভাঙা মূর্তি জোড়া লাগালেই যেমন বিদ্যাসাগরের পথ যথার্থ অনুসরণ করা যায় না, তেমনই শূন্য কোষাগারে শুধু চোখের জল ফেলে গেলেই কি আর ‘করুণাসাগর’ হয়ে উঠতে পারতেন বিদ্যাসাগর!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE