বিদ্যাসাগরের লেখা চিঠির নমুনা।
বিদ্যাসাগর ‘‘সহসা এক মহা আন্দোলনের কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিলেন’’, লিখছেন তাঁর জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সালটা ১৮৫১, বিদ্যাসাগর সবে সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছেন। সংস্কৃত কলেজে গোড়া থেকেই পড়বার অধিকার ছিল শুধু ব্রাহ্মণ আর বৈদ্যসন্তানদের, তাও বৈদ্যরা ধর্মশাস্ত্র শিক্ষার অধিকারী ছিলেন না। এ বার উঠল কায়স্থ ও অন্যান্য বর্ণের কথা। যে কেউ সংস্কৃত পড়তে পারবে? রে রে করে উঠল তাবৎ পণ্ডিতসমাজ। কাউন্সিল অব এডুকেশনের সেক্রেটারি মতামত চাইলেন বিদ্যাসাগরের। উত্তরের গোড়াতেই বিদ্যাসাগর স্পষ্ট লিখলেন, ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়া অন্যান্য বর্ণের হিন্দু— অর্থাৎ বিভিন্ন শ্রেণির শূদ্রদের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশের অধিকার দিতে তাঁর কোনও রকম আপত্তি নেই। কিন্তু, এই মুহূর্তে শুধু কায়স্থদেরই সেই অধিকার দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে। অন্যেরা এখনও সেই সম্মান অর্জন করতে পারেননি, সামাজিক বিবেচনাতেও অন্যদের অবস্থান নিম্নতর। ফলে তাঁদের প্রবেশাধিকার দিলে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থহানি ঘটবে। সংস্কৃত কলেজের প্রধান অধ্যাপকরা অবশ্য দরজা একটুও ফাঁক করতে দিতে রাজি ছিলেন না, তবে সরকার বিদ্যাসাগরের মতটিই মেনে নেয়।
মাত্র তিন বছর পরেই, ১৮৫৪ সালের শেষে বিদ্যাসাগর হিন্দুদের মান্যগণ্য সব শ্রেণির জন্যই (ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ও নবশাখ) সংস্কৃত কলেজের দরজা খুলে দেওয়ার সুপারিশ করেন। অনুমোদিত হয় সেই প্রস্তাবও। কিন্তু সুবর্ণবণিকরা সেই সুযোগ ১৮৫৫-তেও পাননি। সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের এক ছাত্রের ভর্তির ব্যাপারে বিদ্যাসাগর সেই সময় বলেছিলেন, পড়াশোনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ভাবে তিনি কোনও রকম ‘এক্সক্লুসিভ সিস্টেম’-এর বিরোধী। কিন্তু এখনই সুবর্ণবণিক শিক্ষার্থীদের প্রবেশাধিকার দিলে শুধু যে কলেজের রক্ষণশীল অধ্যাপকদের সংস্কারে আঘাত লাগবে তা-ই নয়, প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয়তা ও সম্মানের হানি ঘটবে। ১৮৫৮-য় ইস্তফা না দিলে হয়তো বিদ্যাসাগর আর একটু সময় পেতেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলে সর্ব স্তরের শিক্ষার্থীরাই সুযোগ পেতেন সংস্কৃত কলেজে পড়বার। ১৮৬৩ সালে সরকারের উদ্যোগেই এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল। খেয়াল রাখার বিষয়, বিদ্যাসাগর এই সময়েই বেথুন স্কুল কমিটির সম্পাদক ছিলেন, আর সেখানে কিন্তু নবশাখদের পরবর্তী স্তরের হিন্দু মেয়েরাও পড়ার সুযোগ পেতেন। অন্তত ১৮৬২ সালের শিক্ষাবিভাগের নথি সেটাই জানাচ্ছে।
বিদ্যাসাগরের বিভিন্ন জীবনীর সূত্রে এই তথ্য অল্পস্বল্প অনেকেরই জানা। কিন্তু সরকারি নথির ইংরেজি বয়ানে বিদ্যাসাগর কী ভাবে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছিলেন? দু’একটি বাক্যে তো বলেননি, যত্ন করে যুক্তিপরম্পরা সাজিয়েছিলেন। কায়স্থদের পড়বার অধিকার দেওয়ার পক্ষে তাঁর যুক্তিগুলি ঠিক কী ছিল? বিপক্ষের যুক্তিই বা তিনি কী ভাবে খণ্ডন করেছিলেন? এ কথা জানতে হলে মূল নথি দেখা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সংস্কৃত কলেজের ‘লেটার্স সেন্ট’ ফাইলের বিভিন্ন খণ্ডে এই সব চিঠির প্রতিলিপি আছে বলে জানিয়েছিলেন অরবিন্দ গুহ, তাঁর সঙ্কলিত ‘আনপাবলিশড লেটার্স অব বিদ্যাসাগর’ (১৯৭১) বইয়ে। সে কি আর আগ্রহী পাঠক চাইলেই দেখতে পারবেন? অনেক দিন ধরেই দুর্লভ এই বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ায় (সম্পা: বিশ্বনাথ মাজি, রিডার্স সার্ভিস) তবু মূল ইংরেজি চিঠিটি পড়া সম্ভব। এই বইয়ে সঙ্কলিত হয়েছে তিনশোরও বেশি চিঠি। কিন্তু এই সব চিঠিপত্রের বাইরে রয়ে গিয়েছে আরও অনেক রিপোর্ট, অন্য বহু নথি, যা বিদ্যাসাগর ইংরেজিতেই লিখেছিলেন, এবং কিছু কিছু নথি বাংলায় অনূদিত হলেও মূল বয়ান পড়তে না পারলে তিনি ঠিক কী লিখতে চেয়েছিলেন বোঝা সম্ভব নয়। নানা বিতর্কের প্রেক্ষিতে পুরনো সে সব অনুবাদও কতটা যথার্থ, সে প্রশ্নও তোলা যেতে পারে। আছে কিছু ব্যক্তিগত চিঠিও, যেমন মাইকেল মধুসূদনকে লেখা ইংরেজি চিঠি (সঙ্গের ছবি)।
কিংবা ধরা যাক নকশালপন্থীদের মূর্তিভাঙার অজুহাতের কথা। সরোজ দত্ত লেখেন, ‘‘ব্যারাকপুরে যখন মঙ্গল পাঁড়ের ফাঁসী হয় এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ সারা বাংলায় জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেয়, সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর কি তখন তার কলেজকে এই বিদ্রোহ দমনের জন্য সেনানিবাসে পরিণত হতে দেয়নি?’’ অথচ সরকারি নথি থেকে স্পষ্ট, সংস্কৃত কলেজ ভবন ‘‘অ্যাপ্রোপ্রিয়েটেড ফর দি অ্যাকোমোডেশন অব ট্রুপস আন্ডার দি অর্ডার্স রিসিভড ফ্রম দ্য মিলিটারি ডিপার্টমেন্ট’’। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে বিদ্যাসাগরকে সিদ্ধান্তটি জানানো হয় এবং কলেজ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে বলা হয়। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যাসাগর ইস্তফাও দিতে চেয়েছিলেন। তা হলে তাঁকে এই প্রেক্ষিতে ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুচর’ বলাটা কতটা যুক্তিসহ? কিন্তু যুক্তি বুঝতে হলে তো, আবার সেই, মূল নথি দেখতে হবে।
মডেল স্কুল তৈরির আগে গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে পরিস্থিতি দেখেছিলেন বিদ্যাসাগর, সংস্কৃত কলেজ নিয়ে তাঁর সেই বিখ্যাত পরিকল্পনা, একের পর এক বালিকা বিদ্যালয় গড়ার যে অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন তিনি, আবার তা নিয়েই তিক্ততা শুরু হচ্ছে সরকারের সঙ্গে, ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশন কি বেথুন স্কুল, আবার ফিমেল নর্মাল স্কুল নিয়ে তিনি যা লিখছেন, সব রিপোর্টই লুকিয়ে আছে লেখ্যাগারে। বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহ ও সহবাস সম্মতি বিল নিয়ে মতামত তো আছেই। এগুলি কেন তাঁর রচনা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে না? এ পর্যন্ত কোনও রচনাবলিতেই বিদ্যাসাগরের ইংরেজি লেখা স্থান পায়নি। বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থের ভিতরে ও পরিশিষ্টেই তাদের আংশিক ঠাঁই হয়েছে। এ বার রচনাবলির একটি খণ্ডে সঙ্কলিত হোক না তাঁর এই সব ইংরেজি রচনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy