Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

যঃ পলায়তে

মনোজ বর্মা পুলিশমাত্র নহেন, তিনি ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার। ভাটপাড়ায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ তথা বিবিধ গুন্ডাদলের মারামারি সামলাইতে তিনি অকুস্থলে গিয়াছিলেন।

সুরক্ষা ছাড়াই ভাটপাড়ায় মনোজ বর্মা। রবিবার। ফাইল চিত্র

সুরক্ষা ছাড়াই ভাটপাড়ায় মনোজ বর্মা। রবিবার। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

জগদ্দল-ভাটপাড়ার পথে ধাবমান মনোজ বর্মাকে দেখিলে লুই আলথুসের চমৎকৃত হইতেন। বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়া যে প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির সাবজেক্টিভিটি বা বিষয়ী-সত্তা নির্মিত ও লালিত হয়, সেই ‘ইন্টারপেলেশন’-এর ধারণাটি বিশ্লেষণ করিতে গিয়া গত শতাব্দীর ফরাসি তাত্ত্বিক আলথুসের একটি উদাহরণ ব্যবহার করিয়াছিলেন: কোনও পুলিশ রাস্তায় কোনও নাগরিককে ‘ওহে, এই যে’ বলিয়া ডাকিলে, নাগরিক তৎক্ষণাৎ তটস্থ হইয়া সেই ডাকে সাড়া দেয়। অন্য কেহ ডাকিলে এই প্রতিক্রিয়া ঘটে না। পুলিশ ক্ষমতার প্রতিভূ, তাই নাগরিকের কানে তাহার ডাক অন্য পাঁচ জনের ডাক হইতে স্বতন্ত্র অর্থ বহন করে, সচেতন ভাবে কিছু না ভাবিয়াই তাহার মস্তিষ্ক সেই ভিন্ন অর্থ পড়িয়া লয় ও সেই অনুসারে সাড়া দেয়, এই সাড়া দিবার প্রক্রিয়াতেই নির্মিত হয় বিষয়ী-সত্তা। স্পষ্টতই, ক্ষমতার শাসন জারি রাখিবার কাজে এই প্রক্রিয়া বিশেষ মূল্যবান, কারণ সামাজিক ব্যক্তি যত স্বাভাবিক ভাবে, কিছু না ভাবিয়াই, ক্ষমতার আধিপত্য স্বীকার করিবে, শাসন ততই জোরদার ও সুস্থিত হইবে।

মনোজ বর্মা পুলিশমাত্র নহেন, তিনি ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার। ভাটপাড়ায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ তথা বিবিধ গুন্ডাদলের মারামারি সামলাইতে তিনি অকুস্থলে গিয়াছিলেন। এবং গুন্ডাদের নিরস্ত করিতে গাড়ি ছাড়িয়া পদব্রজে অগ্রসর হইয়াছিলেন তিনি। যথেষ্ট আত্মরক্ষার প্রকরণও ধারণ করেন নাই, সম্ভবত ভাবিয়াছিলেন তাহার প্রয়োজন হইবে না, দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসারকে দেখিলেই গুন্ডারা লেজ গুটাইয়া পলাইবে বা পায়ে পড়িবে। কিন্তু তাহা ঘটে নাই। কমিশনারকেই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিতে হইয়াছে। ইহা কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, না বৃহত্তর ও গভীরতর সত্যের প্রতীক? পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ প্রশাসনের দুর্দশা কোন অতলে পৌঁছাইয়াছে তাহার প্রতীক? পুলিশ অফিসার আক্রান্ত হইবার ঘটনা আগেও ঘটিয়াছে, নজির হিসাবে ১৯৮৪ সালে কলিকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বিনোদ মেহতার হত্যাকাণ্ড স্মরণীয়। কিন্তু ভাটপাড়ার দৃশ্যটির পরিপ্রেক্ষিত তাৎপর্যপূর্ণ। গত কয়েক বছরে রাজ্য জুড়িয়া যত্রতত্র পুলিশ অপদস্থ, আক্রান্ত, লাঞ্ছিত, প্রহৃত হইয়াছে, প্রহারের ভয়ে পুলিশকর্মীদের থানার মধ্যে টেবিলের তলায় লুকাইতে হইয়াছে। সমাজে পুলিশের মর্যাদা বহু দিনই অন্তর্হিত, কিন্তু আর কিছু না হউক, সচরাচর উর্দিধারীর প্রতি ভয়মিশ্রিত সমীহ কাজ করিত। ইদানীং সেই ভয়ও বিলীয়মান।

সর্বাপেক্ষা উদ্বেগের বিষয়, পুলিশের আত্মপ্রত্যয়েও যেন বড় রকমের ভাঙন ধরিয়াছে। অন্য বহু অবক্ষয়ের মতোই ইহার সূচনাও বামফ্রন্ট জমানায়। পুলিশ প্রশাসনকে দলদাসে পরিণত করিবার দুষ্কর্ম বামপন্থী শাসকদের অবদান। কিন্তু বর্তমান শাসকরা সেই গরল নির্মূল করিবার পরিবর্তে তাহাকে আরও অনেক তীব্রতর করিয়া তুলিয়াছেন এবং তৃণমূল অবধি সঞ্চারিত করিয়াছেন। অতীতে পার্টির বড় বা মেজো কর্তারা পুলিশকে চালাইতেন, এই জমানায় পুলিশের কর্মী ও কর্তারা পাড়ায় পাড়ায় বিঘতপ্রমাণ দাদাদিদিদের ভয়ে কাঁপেন। দুর্ভাগ্যের কথা, সরকার তথা দলের কর্ণধারেরা এই প্রক্রিয়াকে দমনের সৎ চেষ্টা করেন নাই, বরং প্রশ্রয় দিয়াছেন। কেবল দলীয় স্বার্থে পুলিশকে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করিতে বাধাই দেন নাই, জনসমক্ষে পুলিশের বড়কর্তাদের প্রতি তাঁহাদের আচরণ অনেক সময়েই কাঙ্ক্ষিত মর্যাদাবোধের শর্ত লঙ্ঘন করিয়াছে। পলায়নরত পুলিশ কমিশনারের ছবিটি প্রকৃত অর্থে এই অনাচারের করুণ পরিণতি। তবে করুণতর পরিণতির সম্ভাবনাও উড়াইয়া দেওয়া চলে না। বিজেপির মহামান্য সাধারণ সম্পাদক শ্রীযুক্ত কৈলাস বিজয়বর্গীয় মহাশয় জানাইয়াছেন, যে দিন তাঁহার দল রাজ্যে ক্ষমতায় আসিবে, পুলিশ ‘আমাদের’ জুতা পালিশ করিবে। নীচে নামিবার কোনও শেষ নাই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy