নভেম্বর ২৮, ২০১৯ সালের সেই কলঙ্কিত কালো রাত। নিজামের শহর হায়দরাবাদের ডিজিটাল সভ্যতার গর্ভগৃহ থেকে ছিটকে পড়া আধপোড়া রক্তের লাভা যেন সমগ্র দেশের হৃদয়কে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিয়েছে। অঘ্রান সন্ধ্যার হিমেল কুয়াশা নগরীর শরীরের ওম কাটিয়ে ততক্ষণে ডানা ঝাপটে বেরিয়ে পড়েছে। আলোয় মাখা ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনতে বুনতে বছর ছাব্বিশের পশু চিকিৎসক তরুণীটিও পেশার তাগিদে তাঁর স্কুটারের চেপে যাত্রা শুরু করেছে।
তার পর যা ঘটে গেছে, তা পৈশাচিক বললেও বুঝি কম বলা হবে। কসাইখানার চক্রব্যূহে আটকে পড়া শিকারের অসহায় আর্তচিৎকার। চারিদিকে রক্তলোলুপ হায়নার অট্টরোল। মাংসলোলুপ পিশাচরা তাড়িয়ে তাড়িয়ে, ছিঁড়ে, হিঁচড়ে খেয়ে চলেছে তাঁর অবলা শরীরটাকে। যে শরীরটা চেটেপুটে লুটে নেওয়া যায়, সেই শরীরটাকেই আবার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেওয়ার অধিকারও নাকি আলবৎ জন্মে যায়! আধপোড়া মানুষের গন্ধ স্তম্ভিত করে দিয়েছে আমাদের সকল সংবেদনশীলতাকে। মানুষ-পোড়া গন্ধে মম করছে আমাদের সভ্যতা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের দেশ, সমাজ, পরম্পরা। জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে তিল তিল করে গড়ে ওঠা ‘বহুজন সুখায় চ, বহুজন হিতায় চ’র আমাদের এই সাধের মাতৃভূমির চালচিত্রের কাঠামো। সমগ্র মানব সমাজটা যেন আটকে পড়েছে বধ্যভূমির উল্লাসমঞ্চে। ধর্ষিত, রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন পশু চিকিৎসকের শরীরটা আগুনে ঝলসে তবে সান্তি হয়েছিল রক্তলোলুপদের।
২৮শে নভেম্বরের সেই অভিশপ্ত রাতের প্রতিদান যেন ৬ই ডিসেম্বরের ভোররাত কড়ায়গণ্ডায় চুকিয়ে দিল। অভিযুক্ত চার ধর্ষক ও খুনি পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল। ৬ই ডিসেম্বর সকাল থেকেই সংবাদ মাধ্যম টিআরপি বাড়ানোর নেশায় বুঁদ হয়ে সেই খবর নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে দিল। সামাজিক মাধ্যম জুড়ে প্লাবনের উচ্ছ্বাসে আছড়ে পড়ল হায়দরাবাদ পুলিশের প্রতি তারিফের হুল্লোড় এবং চকিত বিচারের প্রবল জয়ধ্বনি। ভারতীয় সংবিধানে হাত রেখে শপথ নেওয়া শাসক ও বিরোধী দলের সাংসদ-বিধায়কেরাও অকৃপণ হয়ে উঠল পুলিশের এই ‘এনকাউন্টার’-এর বাঁধনহারা প্রশংসায়। সমাজের হিতের জন্য পুলিশের এই মহানায়কচিত বাহাদুরির যেন অবশ্য প্রয়োজন ছিল। পুলিশের এই অরণ্যদেব সুলভ বিচারশালায় নির্যাতিতা যেন প্রকৃত বিচার পেয়ে গেল। আইনের রক্ষকরা নির্যাতিতাকে বাঁচানোর চেষ্টায় নিবৃত থেকেও বিচারকের শিরোপাধারী সিংহাসনে উপবিষ্ট হতে পেরে বল্গাহীন খুশিতে একেবারে ডগমগ।
২৮শে নভেম্বরের সেই বিভীষিকাময় রাতে অভিযুক্ত চার পিশাচ সেই চিকিৎসকের সঙ্গে যে ভয়াভয় ব্যবহার করেছিল, তা শুধু ক্ষমার অযোগ্যই নয়, দৃষ্টান্তমূলক চরম শাস্তিই তাঁদের অবশ্য প্রাপ্য ছিল। কিন্তু প্রশ্নটা জাগে, একটি সভ্য সমাজজীবনে এবং গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় সেই শাস্তি দেওয়ার অধিকার কার ওপরে বর্তায়?
পুলিশের কাজ তো আইন রক্ষকের, অভিযুক্ত অপরাধী যাতে উপযুক্ত শাস্তি পায় তার সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচারকের সম্মুখে পেশ করার, কিন্তু কোন অবস্থাতেই বিচার বহির্ভূত কোন শাস্তির বিধান দেওয়া পুলিশের দায় বা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কোনও সভ্য সমাজব্যবস্থায় এটা কখনওই কাম্য নয়। ভারতীয় সংবিধান মোতাবেক একেবারেই নয়। যদি এমনটাই সিদ্ধ বলে মনে হয়, তবে এই এনকাউন্টারের নামে পুলিশ যদি রাজনৈতিক দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের ইশারায় কোন এক দিন স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে, তার ফল নাগরিক জীবনে কতটা ভয়াভয় হতে পারে তা কি অনুমেয় নয়? পুলিশই যদি শাস্তির বিধান ঠিক করার ত্রাতার ভুমিকা নিয়ে ফেলে, তবে বিচার ব্যবস্থারই বা আর প্রয়োজনটা কোথায়? এমনটা চললে, পুলিশের এই ‘অতি সক্রিয়তার’ থাবা যদি কোনও দিন সমাজের সকল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকেই গিলে নিয়ে সমগ্র সমাজটাকেই বোবা বানিয়ে রাখে? তা কি কিছু কম ভয়াভয় বলে মনে হবে?
মনে রাখতে হবে, নির্যাতিতার বোন ২৮শে নভেম্বরের সেই অভিশপ্ত রাতে পুলিশের দরজায় দরজায় ঘুরেও বস্তুত কোনও সাহায্যই পায়নি। সে দিন পুলিশ যদি নাগরিক নিরাপত্তার দায় মাথায় নিয়ে ওই নির্য়াতিতার বোনের সঙ্গে সহানুভূতিশীল সহায়তা করত, তা হলে হয়ত তাঁর নিষ্পাপ জীবনটা বাঁচান যেত। অথচ এনকাউন্টার-উত্তর সেই পুলিশই নাকি হয়ে গেল ‘ইনস্ট্যান্ট জাস্টিস’-এর পেটেন্টধারী!
এমনটি মনে করার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণই নেই যে এমন নারকীয় পৈশাচিকতায় অভিযুক্ত অপরাধীদের সম্বন্ধে আমার মনে বিন্দুমাত্র সহানুভূতির স্থান আছে। আমার ঐকান্তিক আর্তি, যাতে প্রকৃত অপরাধীরা অতি দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। কিন্তু তা অবশ্যই পুলিশের দেওয়া শাস্তির বিধান মোতাবেক নয়, সংবিধান প্রদত্ত বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই। আমরা, গণতন্ত্রপ্রিয় অগণিত আমজনতা, নিশ্চয়ই নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতার ঘেরাটোপে অবরুদ্ধ থাকতে চাইব না। আর সেই ভাবনাগুলোর থেকে নিঃসৃত চেতনাই আদতে এই সংশয়ের অবকাশের গর্ভগৃহ।
পুলিশের এই ‘এনকাউন্টার তত্ত্ব’ আসলে কোনও গণতান্ত্রিক আবহকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার পক্ষে একটা মোক্ষম অস্ত্র। এ কথা ইতিহাস বারেবারে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে বিশ্ব জুড়ে। এমন ভুরিভুরি উদাহরণ আছে আমাদের দেশ এবং আমাদের রাজ্যের প্রেক্ষিতে। সাম্প্রতিক অতিতে মাওবাদী মধ্যস্থতাকারী আজাদের কথা অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে। বর্তমান প্রজন্মের নাগালের বাইরে হলেও, বর্ষীয়ান মানুষেরা বোধহয় এত দিনেও ভুলে যাননি কলকাতার গড়ের মাঠে ভোররাতে মহানায়ক উত্তমকুমারের চোখের সামনে নকশাল নেতা সরোজ দত্তকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার পুলিশের সেই ‘এনকাউন্টার তত্ত্ব’! ৬ই ডিসেম্বরের ভোররাতে পুলিশের এই এনকাউন্টার সাজানো ঘটনা ছিল কিনা, তা বোধগম্য হওয়ার জন্য কোন ফেলুদার মগজাস্ত্রের বোধহয় প্রয়োজন পড়ে না। পুলিশ যদি ঘটনার পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে অভিযুক্তদের নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে থাকে, তা হলে সে ক্ষেত্রে অনেকগুলো সাধারণ প্রশ্ন অতি সাধারণ মস্তিষ্ককেও ফাঁকি দিতে পারে না। যেমন, ঘটনার পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে কাকভোরকেই বা কেন বেছে নেওয়া হল? আসামীরা অত্যন্ত নৃশংস অপরাধে অভিযুক্ত হওয়া সত্বেও কেন যথোচিত নিরাপত্তার বলয়ে মুড়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করা হয়নি? অভিযুক্তরা এমন পাষণ্ড জানা সত্ত্বেও তাদের হাতে হাতকড়া পরানো ছিল না কেন? যদি পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে চারজন অপরাধীই পালাতে চেষ্টা করে থাকে, তবে পুলিশের ছোঁড়া গুলিগুলোর মধ্যে কোনটা তাঁদের হাতে বা পায়ে না লেগে কেনই বা শুধু তাঁদের বুকে বা মাথায় লাগল? তাই আপাতদৃষ্টিতে পুলিশের এই ‘এনকাউন্টারকে’ আদতে একটি কাঁচা ‘ফেক এনকাউন্টার’ বলে যদি কারও মনে শঙ্কা জাগে, তা কি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায়?
শিক্ষক, এসআর ফতেপুরিয়া কলেজ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy