ঘটনাবহুল অসমে কি তাহা হইলে ঐতিহাসিক তারিখের তালিকায় আরও একটি দিন যুক্ত হইল— বারো ডিসেম্বর? তেমনই দাবি করিয়াছে অসম ছাত্র সংগঠনের নেতারা। নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ হইয়া, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর লইয়া, আইনে পরিণত হইবার ঘটনা আক্ষরিক অর্থে আগুন জ্বালাইয়া দিয়াছে অসমে। সর্বাধিক হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া অসমেই, যদিও অশান্তি কেবল সেখানেই সীমাবদ্ধ নহে। ক্যাব-বিরোধিতায় আপাতত সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল উত্তাল— এবং যে সব রাজ্যে বিজেপিই শাসক দলের ভূমিকায়, সেখানে ক্যাব-বিরোধিতা দ্রুত রূপ পাইতেছে অসহযোগ ও সরকারবিরোধিতায়। রাস্তায় ব্যারিকেড, দোকানপাট স্কুলকলেজ সপাট বন্ধ, বাঙালিবিরোধী হুঙ্কারে কাঁপিতেছে জনপদ, সহস্র মানুষের মারমুখী জনতার মধ্যে নামিয়া আসিতেছে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস, কতিপয় ইতিমধ্যেই সংঘর্ষে নিহত। গত কিছু কাল ধরিয়া এনআরসি-র কারণে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি এমনিতেই অগ্নিগর্ভ হইয়াছিল। ‘ক্যাব’ পাশ হইতে সেই আগুন রাস্তায় রাস্তায় জ্বলিয়া উঠিয়াছে। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখিতে হইতেছে। অসম ও ত্রিপুরা যেন এখন দ্বিতীয় কাশ্মীর। দিল্লির নেতা-মন্ত্রীরা অবশ্য সাফল্যপ্রফুল্লতায় বিধৌত। তাঁহারা জানাইতেছেন, কোনও চিন্তা নাই, এ সবই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। ইন্টারনেট বন্ধ অবস্থাতেই প্রধানমন্ত্রী টুইট করিয়াছেন, হিংসা বন্ধ করিবার আহ্বানে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করিতে ডাক দিয়াছেন অসমের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সোনোয়াল। কেবল মোদীর টুইট-কাণ্ড দেখিয়াই স্বাভাবিকতা ফিরাইবার ‘আন্তরিকতা’ বুঝিতে অসুবিধা হয় না। কাশ্মীরের দৃষ্টান্ত দেখিয়া আন্দাজ করিতে কষ্ট হয় না, স্বাভাবিকতা বলিতে মোদী ও শাহ আজকাল কী বুঝেন।
আশ্চর্য, ইহার জন্য কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার এবং অসম বিজেপি সরকার এতখানি অপ্রস্তুত ছিল। অসম সঙ্কটের মূলটিই রহিয়াছে বহিরাগত-বিরোধী আবেগে। সেই আবেগে ইন্ধন দিয়া এনআরসি প্রক্রিয়া চালু হইয়াছিল। কিন্তু অসম অভিজ্ঞতা দেখাইয়া দিল মুসলিম বাঙালির সঙ্গে হিন্দু বাঙালিও বাদ পড়িতেছে বিপুল সংখ্যায়, বস্তুত মুসলিমদের অপেক্ষা বেশি সংখ্যায়। হিন্দুমানস জয়ের লক্ষ্যে তাই কেন্দ্রীয় বিজেপির দ্বিতীয় ব্রহ্মাস্ত্র: ক্যাব। কিন্তু ক্যাব-এর মাধ্যমে হিন্দুদের অঢেল ছাড়পত্র দিলে বিজেপির সুবিধা হইতে পারে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার ভূমিপুত্রদের তো তাহা হইবার কথা নয়! সুতরাং যে বাঙালিবিরোধিতা হইতে অসম আন্দোলনের শুরু, সেই বিরোধিতা তীব্রতর আকার ধারণ করিল। উনিশশো আশির দশকের পরে সম্ভবত আর কখনও তিনসুকিয়া হইতে গুয়াহাটি এমন চূড়ান্ত বিপন্ন হইয়া পড়ে নাই। আগুন জ্বলিবার এই সম্ভাবনা বিজেপি কি ভাবে নাই?
বিজেপি নেতারা মানুষকে ধৈর্য ধরিতে বলিতেছেন। কিন্তু এত বড় সম্প্রদায়-বিভাজক ও আবেগ-উৎপাদক অস্ত্র এক বার তূণ হইতে বাহির হইয়া গেলে সন্ত্রস্ত উদ্বিগ্ন বিপন্ন সাধারণ মানুষকে ধৈর্য ধরিতে বলিয়া কী লাভ? রাজনৈতিক নেতারা বলিতেছেন, মানুষের স্বতোৎসারিত আবেগ বেশি দিন স্থায়ী হইবে না। যুক্তি কিন্তু বলে, বিপরীতটিও ঘটা সম্ভব। স্বতোৎসারিত জনাবেগ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যাইবার দৃষ্টান্ত ইতিহাস বিলক্ষণ জানে। আসল কথা, উত্তরপূর্ব ভারতেই যে সমস্যার শুরু, কেবল বিজেপির নিজের দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করিতে তাহা সমগ্র ভারতের মঞ্চকেন্দ্রে টানিয়া আনিয়া যে ভয়ানক অন্যায় সাধিত হইল, তাহার মূল্য মানুষকে প্রাণ দিয়া চুকাইতে হইতেছে। এই রক্তরঞ্জিত আইন এ বার মানুষকে বন্দিশিবিরে টানিয়া লইয়া যাইবে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে ভারতীয় সমাজ নিশ্চয়ই ভাবিতেছে, নাগরিকত্ব প্রতিষ্ঠার মহান যুদ্ধে রক্ত ও বন্দিত্ব তো ‘স্বাভাবিক’ই বটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy