পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের মৃত্যুর ত্রিশ বৎসরের পুরানো একটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হইল প্রাক্তন আইপিএস সঞ্জীব ভট্টের। সঞ্জীব ভট্টের নামটি রাজনীতি-মহলে যথেষ্ট পরিচিত। ২০০২ সালে গুজরাতের ভয়াবহ দাঙ্গার পর তিনি বার বার সংবাদে আসিয়াছেন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত বিশেষ অনুসন্ধানকারী দলের নিকট গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়াছিলেন সঞ্জীব। তাঁহার দাবি ছিল, নরেন্দ্র মোদীর আহ্বানে সরকারি কর্তাদের একটি বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন— যে বৈঠকে মোদী পুলিশকে হিন্দুদের ক্ষোভের প্রকাশে বাধা না দিবার নির্দেশ দিয়াছিলেন। অতঃপর যে ঘটনাগুলি ঘটিয়া চলে, বলিউডের সিনেমার দর্শকরা তাহার সহিত আশ্চর্য মিল খুঁজিয়া পাইতে পারেন। প্রতিবেশীর অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁহার বাড়ির একটি অংশ ‘বেআইনি’ বলিয়া ভাঙিয়া দিয়াছে আমদাবাদ পুরসভা। সম্প্রতি তাঁহার স্ত্রীর গাড়িতে ধাক্কা দিয়াছে পুরসভারই একটি ট্রাক। গুজরাত সরকার প্রশাসনিক নিয়মভঙ্গের অভিযোগে সঞ্জীবকে সাসপেন্ড এবং শেষ অবধি বরখাস্ত করিয়াছে। পুলিশ ও প্রশাসনে কর্মরত বিবিধ ব্যক্তিরা একের পর এক অভিযোগ দায়ের করিয়াছেন। ২০১১ সাল হইতে বিভিন্ন মামলায় তাঁহার জীবনে কারাবাস ও জামিনে মুক্তির মধ্যে ঘোরাফেরা করিয়াছে। অভিযোগ, এক দীর্ঘ সামাজিক ও রাজনৈতিক নির্যাতনের লক্ষ্য থাকিয়াছেন তিনি।
আদালতের সাম্প্রতিক রায়টি লইয়া অতএব কিছু উদ্বেগ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। ভট্টের বিরুদ্ধে অভিযোগটির গুরুত্বকে কোনও মতেই লঘু করিয়া দেখা চলে না। পুলিশ এবং জেল হেফাজতে বন্দির মৃত্যুর সংখ্যায় ভারত আপাতত অধিকাংশ দেশকে ছাড়াইয়া গিয়াছে। বহু উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তার গাফিলতির ফলে মানবাধিকার ভঙ্গের এক দীর্ঘ ধারা এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ২০০৮ হইতে ২০১৬, এই আট বৎসরের মধ্যে পুলিশি হেফাজতে অন্তত তিনশত মৃত্যু ঘটিয়াছে। কিন্তু এই ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সাধারণত কোনও নিষ্পত্তি হইতে দেখা যায় না, শাস্তিও ঘটে না। ১৯৯৭ সাল হইতে হিসাব করিলে পুলিশ হেফাজতে প্রায় ৭৯৬টি মৃত্যু ঘটিয়াছে, শাস্তি পাইয়াছেন মাত্র আট জন পুলিশ। এক দিকে এমন এক পুলিশকর্তার শাস্তি যেমন সুখবর, তেমনই সেই খবর প্রশ্ন উঠাইয়া দেয়, এত পুলিশকর্তার মধ্যে হঠাৎ সঞ্জীব ভট্ট কেন। বিচারবিভাগ তাহার কাজ দায়িত্বসহকারে করিবে, ধরিয়া লইয়া কি রাজনীতির রোষ ভট্টকে বিচারবিভাগ অবধি তাড়া করিয়া ফিরিয়াছে?
বাস্তবিক, সম্প্রতি পুলিশকর্মীদের যে এমন রাজনীতির রোষে পড়িতে হইয়াছে, ইতিহাসই তাহা বলিয়া দেয়। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির বিরুদ্ধে সরব হইবার পর বহু সরকারি কর্তার উপর ক্রমাগত শাস্তির খাঁড়া নামিয়া আসিয়াছে। পুলিশের সহিত ‘সংঘর্ষ’-এ মহম্মদ সোহরাবুদ্দিন-কৌসরবি-তুলসীরাম প্রজাপতি হত্যা মামলার তদন্ত করিয়াছিলেন রজনীশ রাই। গুজরাত পুলিশের তিনি সাজানো সংঘর্ষের অভিযোগ আনিয়াছিলেন। তাহার ফলে তিনি বিলক্ষণ বিপাকে পড়িয়াছিলেন। সোহরাবুদ্দিন মামলায় গুজরাতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ স্বয়ং অভিযুক্ত হইয়াছিলেন। বিচারপতি লোয়ার আদালতে তাঁহার উপস্থিত হইবার ঠিক পূর্বে লোয়ার রহস্যমৃত্যু গোটা দেশকে আলোড়িত করিয়াছিল। ভুয়া সংঘর্ষের সংবাদ যিনি দিয়াছিলেন, সেই সাংবাদিক প্রশান্ত দয়ালের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা আনিয়াছিল গুজরাত সরকার। অপরাধের বিরুদ্ধে দুর্বলের অস্ত্র ন্যায়বিচার। কিন্তু প্রবলতর রাজনৈতিক পক্ষ সেই পথে বিরাট বাধা হইয়া দাঁড়ায়। সঞ্জীব ভট্টের কারাবাসের সংবাদ তাই স্বস্তি আনিতে পারিল না।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy