Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

কাদা-মাঠা জীবনের কবি

ভেসে বেড়ানো জীবন। কিন্তু মাটিটা ছিল মানভূমের আঞ্চলিক ভাষা অঞ্চলেই। সেই ভাষাই তাঁর কবিতা-গানের চিত্রকল্প নির্মাণ করবে। জীবন দেখার অভিজ্ঞতায় বঞ্চনা, অপমানের প্রকাশ হয়ে যায় শ্লেষধর্মী। কবি, গীতিকার, গল্পকার দেবাশিস দণ্ডের কথা শুনলেন কিংশুক গুপ্ত

অনুষ্ঠানে: ভক্তদের সঙ্গে দেবাশিস দণ্ড। নিজস্ব চিত্র

অনুষ্ঠানে: ভক্তদের সঙ্গে দেবাশিস দণ্ড। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৩৭
Share: Save:

প্রশ্ন: অনেকগুলো ‘কার’ আপনার শিরোপা। ছড়াকার, গল্পকার লেখক, নাট্যকার, গীতিকার।

উত্তর: এর সঙ্গে যোগ হবে কবি, অভিনেতা, কৌতুকশিল্পী।

প্রশ্ন: সোশ্যাল মিডিয়ায় তো জনপ্রিয়?

উত্তর: মানভূমের আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লিখে যত না পরিচিতি পেয়েছি তার চেয়েও বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছি ওই সব কবিতা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে। ফেসবুকে আমার আঞ্চলিক কবিতাগুলি খুবই জনপ্রিয়। পাঠক, থুড়ি দর্শকরা অপেক্ষায় থাকেন, নতুন কী কবিতা পড়লাম। আসলে কিছুটা অভিনয় করে কবিতার ভিডিয়ো পোস্ট করি।

প্রশ্ন: ঝাড়গ্রামের ভূমিপুত্র?

উত্তর: ভূমি তো পেয়েছিলাম বাঁকুড়া সম্মিলনী কলেজ হাসপাতালের বেডে। ১৯৬৭ সালের ২০ অগস্ট। মামার বাড়ি বাঁকুড়ায়।

প্রশ্ন: সেখানেই বড় হওয়া?

উত্তর: ভেসে ভেসে। এখানে ওখানে। বাবা নারায়ণচন্দ্র দণ্ডের রেলের চাকরির সুবাদে ছোটবেলা কেটেছে বার্নপুরে। বার্নপুর বয়েজ প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। থাকতাম আমবাগান এলাকায়। পাঁচ বছর বয়সে একা হেঁটে স্কুলে যাতায়াত করতাম। কোনওদিন হারাইনি। ছোটবেলা থেকেই রাস্তা চেনার সহজাত অভ্যাসটা রয়েছে। তাই এখনও হারিয়ে যাইনি। বার্নপুরের স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। বাবা বদলি হয়ে এলেন বাঁকুড়ায়। তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলাম দশেরবাঁধ প্রাথমিক স্কুলে। চতুর্থ শ্রেণিতে রামকৃষ্ণ মিশন বুনিয়াদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। বাবা ফের বদলি হয়ে আদ্রায়। আমাকে পাঠিয়ে দিলেন ঝাড়গ্রামে। ঠাকুর্দা চিকিৎসক শচীন্দ্রনাথ দণ্ড ও ঠাকুমা স্নেহলতা দণ্ডের স্নেহচ্ছায়ায় ১৯৭৭-৭৮ সালে ঝাড়গ্রাম কুমুদকুমারী ইনস্টিটিউশনে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েছি। ঝাড়গ্রামের প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব হল।

প্রশ্ন: সেই সময়ের কথা বলুন?

উত্তর: পড়াশোনার চেয়ে ঘোরাফেরাটাই বেশি হতো। তখনকার দিনে পড়ুয়াদের বাসে চাপার জন্য পয়লা লাগত না। হেঁটে সুভাষচকে এসে বাসে চেপে স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ রেখে ফের বনে-বাদাড়ে চক্কর। পরীক্ষার ফল ফেল করিনি। তবে টেনেটুনে পাসের উপর আর ভরসা করতে পারলেন বাবা। ফেরত আদ্রায়। রেলের স্কুলে সপ্তম শ্রেণি। সেখানেই মাধ্যমিক পাস।

প্রশ্ন: এবার নিশ্চয় থিতু?

উত্তর: কোথায়! একাদশে একটু বড় হয়েছি, বুঝতে শিখেছি ভেবে বাবা ফের পাঠালেন ঝাড়গ্রামে। সেবায়তন শিল্প বিদ্যালয়ে ভোকেশনাল ইলেকট্রিক্যাল ট্রেডে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হলাম। এরপর ফের চলে গেলাম আদ্রায় বাবা-মায়ের কাছে। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর কলেজে ভর্তি হলাম। কলাবিভাগের স্নাতক হলাম ডিস্টিংশন পেয়ে।

প্রশ্ন: এর পর নানা ‘কার’ চর্চা?

উত্তর: চাকরির খোঁজ। প্রথমে রঘুনাথপুরেই একটি বেসরকারি সংস্থায় করণিকের কাজ করেছি কিছুদিন। মন টেকেনি। কলকাতার একটি বাংলা সংবাদপত্রে শিক্ষানবিশ সাংবাদিক পদে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলাম। ইন্টারভিউয়ে ডাক এল। এক বিখ্যাত সাংবাদিক ইন্টারভিউ নিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ মনোনীত করলেন না। সাংবাদিক হওয়া হল না। ভাগ্যিস সাংবাদিক হইনি। যাই হোক, কিছুদিন ছোটখাট ব্যবসা শুরু করলাম। কিন্তু মন ছিল না ব্যবসায়। ততদিনে আদ্রায় বাবা বাড়ি করে ফেলেছেন। আদ্রা স্কুলের শিক্ষক শ্যামল দাস ঘটকালি করলেন। ১৯৯৭ সালে মিতার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পরে বছর দু’য়েক আদ্রায় ছিলাম। ১৯৯৯ সালে ঝাড়গ্রামে এলাম। প্রচুর টিউশনি করে সংসার চালাতাম। ছাপাখানা খুলে স্ক্রিন প্রিন্টিংয়ের কাজও করেছি। ২০০৮ সালে ঝাড়গ্রাম নেতাজি আদর্শ হাইস্কুলে বাংলা শিক্ষক পদে যোগ।

প্রশ্ন: বিয়ে হয়ে গেল। লেখালেখি?

উত্তর: শুরু হল। আমার প্রথম লেখাটা কিন্তু আমি লিখিনি। সাহিত্যিক তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পত্রিকা ছিল ঝলমল। পত্রিকার শারদ সংখ্যায় আমার নামে ছাপা কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন বাবা। ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমি কাউকে বলিনি। বাবা নীরবে নিজের মতো করে সাহিত্যচর্চা করতেন। আমার লেখা শেখার গুরু বাবা। কয়েকজন আত্মীয় ধরে ফেলেন। ঠিক করলাম নিজে লিখব।

প্রশ্ন: লেখা প্রকাশ হতে শুরু করল?

উত্তর: অনেকগুলো ছড়া লিখে ফেললাম। আদ্রার ‘টুকলু’ পত্রিকার সম্পাদক অমল ত্রিবেদী প্রথম আমার লেখা ছাপেন। অমলদা ছিলেন ‘খেলার আসর’ পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক। রোজ তিনটে-চারটে করে ছড়া জমা দিয়ে আসতাম অমলদার কাছে। শেষে এমন হল, যে অমলদার বাড়ির লোকজন দরজা খুলতে ভয় পেত। একটা-দু’টো করে প্রকাশিত হতে শুরু করল। পড়াশোনার খাতায় সিলেবাসের বিশেষ কিছু থাকত না। ছড়া-কবিতা-গল্প লিখতাম। ‘টুকলু’ পত্রিকায় লেখার সূত্রেই দুই বাংলার বিভিন্ন পত্রিকায় আমার গল্প, ছড়া ও কবিতা প্রকাশিত হতে থাকল। মাধ্যমিক পাসের পরে পাকতে শুরু করলাম। কবিতা লেখার পরে পড়ে মনে হত আমার কবিতা অন্য কবিদের কবিতার মতো নয়। গুরুগম্ভীর ব্যাপারটাই নেই। আসলে জীবনটা আমার কাদা-মাটির মতো। সাদামাঠা নয়, আমি ‘কাদা-মাঠা’ লিখি। যে ভাষাটা সর্বসাধারণ বুঝতে পারেন।

প্রশ্ন: আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখার চর্চার শুরু?

উত্তর: শুরুটা বেশ মজার। আদ্রায় এক মেলায় ঘুরছি। এক খুদে তার মামার কাছে আবদার করছে, ‘অ মামু বেলুম (বেলুন) লিব’। ভালবেসে ফেললাম মানভূমের আঞ্চলিক ভাষাকে। মনে হল এই একটা কথাই যেন কবিতা। বাড়ি ফিরে লিখে ফেললাম ‘অ মামু বেলুম লিব’। ’৯৯ সালে ঝাড়গ্রামে ‘কদমকানন পৌরপল্লি কল্যাণ মঞ্চ’-এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই কবিতাটা শোনালাম। শ্রোতাদের ভীষণ সাড়া পেলাম। ২০০০ সালে দ্বিতীয় আঞ্চলিক কবিতা লিখলাম---‘শনিঠাকুর-রবিঠাকুর’। শনিঠাকুরের চেয়ে রবিঠাকুর জীবন গড়ার পক্ষে কত ‘জরুরি ঠাকুর’ সেটাই লিখেছিলাম।

প্রশ্ন: আঞ্চলিক ভাষায় লেখা শুরু?

উত্তর: হ্যাঁ। দীর্ঘ ২০ বছর ঝাড়গ্রামে থাকার সুবাদে এখানকার আঞ্চলিক ভাষায় লেখার চেষ্টা করে চলেছি। সেটা কিন্তু আঞ্চলিক কুড়মালি নয়। মানুষের বিপুল ভালবাসা পেয়েছি। মহুল আমার কবিতা-সংকলনের সিডি প্রকাশ করেছিল, ‘বইল্যে হবেক’। ২০০৮ সালে ‘মহুল’-এর উদ্যোগে কবিতার দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘শনিঠাকুর-রবিঠাকুর’ প্রকাশিত হয়েছে। এই তো কয়েকদিন আগে গত ১৫ জানুয়ারি ‘মহুল’ প্রযোজিত কবিতার তৃতীয় সিডি ‘আমরা দু’জন একটি গাঁয়ে থাকি’ প্রকাশিত হল। তাতে বাচিকশিল্পী স্মৃতিলেখা ভুঁইয়াও আছেন।

প্রশ্ন: কবিতার সিডি? বই নয় কেন?

উত্তর: কবিতার বই সহজে কেউ কেনে না। তাই বই ছাপাতে আগ্রহী ছিলাম না। ২০১৭ সালে মহুল প্রকাশ করল আমার ২৫টি আঞ্চলিক কবিতার সংকলন ‘ঝাড়ের বাঁশ’। এটিই আমার একমাত্র কবিতার বই। ২০১৬ সালে অণুগল্পের বই ‘এক মিনিটের গল্প’ প্রকাশ করেছিল আবাদভূমি প্রকাশন। ভাই শিবাশিস দণ্ডর সঙ্গে ‘ঠোঁটকাটার নোটবুক’-এ আমার ছড়া ছিল।

প্রশ্ন: এবার গীতিকার দেবাশিস?

উত্তর: ‘মারাংবুরু তুরুরুরু’ গানটি লিখেছিলাম ২০০২ সালে। পার্থ আর আমি ঝাড়গ্রামে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছি। পার্থ সুরটা শুনিয়ে বলল কথা বসিয়ে গান লিখে দে। একটি সর্বভারতীয় প্রকাশন সংস্থার বিচারে একশো বছরের সেরা গানের তালিকায় এই গানটা রয়েছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝুমুর নিয়ে গবেষণাপত্রে ‘মারংবুরু তুরুরুরু’ গানটির উল্লেখ রয়েছে। মহুলের ‘ভূতের কীর্তন’ অ্যালবামে আমার লেখা অনেকগুলি গান আছে। এবার পুজোয় মহুল-এর ‘দুর্গা রে দুর্গা শহর থেকে দূর গাঁ’, জনপ্রিয় হয়েছে। আমার লেখা ‘টিঙ্কি টিপির, টিঙ্কি টিপির’ মহুল-এর জনপ্রিয় গান।

প্রশ্ন: বারবার সোশ্যা‌ল মিডিয়ার কথা বলছেন। এতে কি সাহিত্যকে পৌঁছে দেওয়া যায়?

উত্তর: আঞ্চলিক কবিতার সুর-স্বর-শৈলী লিখে বোঝানো যায় না। যখন বলছি, তখন শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে ভাললাগার জায়গাটা তৈরি হয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘বাঁইচতে আমার মন করে নাই খুড়া’ কবিতাটা সুপার হিট। পুরুষরা লাঞ্ছিত হলে বলতে মানা। পুরুষদের যন্ত্রণার কথা ‌লিখেছি। মা আর বউয়ের ঘুসি নাকে পড়ছে। এটা হয়তো অনেকের জীবনে সত্যি। আর একটি কবিতা ‘পইসা নাইকো পকোটে, লাইফ কাটাই ফকোটে’ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। হালফিলের নানা ব্যাধি, ঘটনা নিয়ে স্যাটায়ার লিখি।

প্রশ্ন: নিজেকে কোন ‘কার’ হিসেবে দেখতে চান?

উত্তর: নিজেকে কবি বলি না। আবৃত্তিকার বলা পছন্দ নয়। কারণ কবির পরিচয় দিয়ে কবিতা বলতে গিয়ে বহুবার ঠকেছি। আমি কবিতা বলছি, কেউ মাইকে ঘোষণা করছেন, একটি লালটুপি পাওয়া গিয়েছে, অনুগ্রহ করে নিয়ে যান। এই তো পরশুদিন সেলুনে গিয়েছিল। ভিড়ে ঠাসা। পরিচিত ক্ষৌরকারকে বললাম, আরে লাইন পাব কখন? বিরক্ত ক্ষৌরকারের জবাব, ‘‘মাথাটা রেখে চলে যান। কামিয়ে রেখে দেব। ঘণ্টা খানেক পরে নিয়ে যাবেন।’’ সত্যিই তো এই ব্যস্ততার যুগে মাথা দেওয়া ছাড়া আর উপায় কী!

প্রশ্ন: বন্ধু, অণুপ্রেরণা?

উত্তর: ঝাড়গ্রামের বাসিন্দা শ্রদ্ধেয় কবি শাশ্বতী হোসেন। আমার বহু পুরনো পাণ্ডুলিপি থেকে কপি করে উনি পত্র পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন। তাঁর জন্যই বহু লেখা সময় মতো পত্রিকায় যায়। মহুলের পার্থ ভৌমিক, স্কুলের প্রধান শিক্ষক অপর্ণেশ মিশ্র, কলেজ-শিক্ষক সুদীপ দাস উৎসাহিত করেন।

প্রশ্ন: এক লাইনে জীবন বোধ?

উত্তর: দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সেই গানের লাইন, ‘হেসে নাও দু’দিন বইতো নয়’!

অন্য বিষয়গুলি:

Interview Poet Debasis Danda
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy