Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Digital Revolution

অন্যান্য প্রযুক্তির মতো, ইন্টারনেটও তার নিজস্ব বিপদ সঙ্গে নিয়ে এসেছে

হে বাঙালি, বিশ্বগ্রামে স্বাগত। লিখছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:০০
Share: Save:

মা আমি আর পড়তে চাই না— ক্লাস টেনের পড়ুয়া সৌরভের এই কথা শুনে তার কলেজ শিক্ষিকা মায়ের তো মূর্ছা যাবার অবস্থা। বললেন— পাগল হয়ে গেছিস নাকি ? সৌরভের দ্বিধাহীন উত্তর— আমি সব ভেবেই বলছি মা। আমার পড়াশোনা ভাল্লাগে না। আমি স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হতে চাই। তুমি তো আর দেখ না, আমার ইউটিউব চ্যানেলে মাত্র এক বছরেই প্রায় এক লক্ষ ফলোয়ার। এটাকে কাল্টিভেট করতে পারলে আমার কেরিয়ার মেড। তুমি জানো, শুধু খেলনার রিভিউ করে রায়ান নামে একটা সাত বছরের বাচ্চা এক বছরে ২২ মিলিয়ন ডলার রোজগার করেছে?

হে বাঙালি, বিশ্বগ্রামে স্বাগত। আপনি আর সিটিজেন নন, চান বা না চান আপনি এখন নেটিজেন হয়ে গেছেন। বিশ্বব্যাপী অন্তর্জালের নাগরিক। আপনার অজান্তেই ইন্টারনেট তার প্রভাব বিস্তার করেছে আপনার জীবনে, বদলে দিয়েছে দৈনন্দিন জীবনধারা।

গত শতাব্দীর আশির দশকে যে রক্তপাতহীন নিঃশব্দ বিপ্লব দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়েছে, তার প্রভাব ভারতে আসতে একটু দেরি হয়েছে। সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য ইন্টারনেট ভারতে চালু হয় ১৯৯৫ সালে। মাত্র এক দশকেই তার সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে গোটা বিশ্বে। প্রকৃত অর্থেই দুনিয়া মেরি মুট্ঠি মে। যেমন ধরা যাক সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা। ইন্টারনেট যুগের আগে আমাদের কাছে লৌহ যবনিকার আড়ালে থাকা ওই দেশ সম্বন্ধে জানার একমাত্র উপায় ছিল ওদেশে ছাপা ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকা এবং অন্যান্য প্রোপাগান্ডা বই। সে সব বইয়ের মূল বক্তব্য ছিল— ‘স্বর্গ যদি থেকে থাকে, তা এখানে’। তার পর এল ইন্টারনেট। এর মধ্যেই ভেঙ্গে পড়ল লৌহ প্রাচীর। আমরা জানতে শুরু করলাম যে স্বর্গ নয়, রাশিয়া অন্যান্য দেশের মতোই ভালমন্দ মেশানো এক দেশ। বাকিটা ইতিহাস। আজকাল তো উত্তর কোরিয়ার অন্দরমহলের ছবিও ইন্টারনেটের দৌলতে আমাদের ফোনবন্দি।

আরও পড়ুন: আমরা কি গণতন্ত্র মুছে ফেলতে চাই?​

ইন্টারনেটের প্রথম যুগে যেটা ছিল না, তা হল— প্রাণ। এ প্রাণটা এনে দিয়েছে ফেসবুক-সহ বিভিন্ন নেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুকের আবির্ভাবের আগেও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল। তবে চলছিল ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে। ফেসবুকের জন্ম পুরো প্রেক্ষাপটেই আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। ঠিক কতটা পরিবর্তন হয়েছে ? দেখা যাক।

সকালে উঠে এখন খবরের কাগজের বদলে, আগে খোঁজ পড়ে মোবাইলের। এক ঝলক ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপের পোস্টগুলোতে চোখ বুলিয়ে তার পর আনন্দবাজার। কাগজের খবরগুলো অবশ্য অনেকটাই বাসি, গত রাতেই আপনি টুইটার আর ফেসবুকের কল্যাণে অনেকগুলোই জেনে গেছেন। টিভিও দেখতে হয় না। খবরের কাগজ তো শুধু অভ্যাসবশত পড়া।

সংবাদ প্রচারের তাৎক্ষণিকতায় সোশ্যাল মিডিয়া সবার আগে। ঘটনা ঘটার অপেক্ষা শুধু। মুহূর্তে তা টুইটার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবের কল্যাণে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি সাংবাদিকেরও প্রয়োজন হয় না। উপস্থিত মানুষজনের মধ্যে কেউ না কেউ ছবি বা ভিডিও তুলে শেয়ার করে দেন। অনেক ক্ষেত্রে লাইভ সম্প্রচার হয়। কেউ আর টিভির সংবাদের অপেক্ষা করে না। সবই ইন্টারনেটের কামাল।

পছন্দের সিরিয়াল, লাইভ খেলা ইত্যাদি দেখার জন্য আর তাড়াহুড়া করে বাড়ি ফিরতে হয় না। এমনকি টিভিরও দরকার নেই। যখন খুশি, যেখানে খুশি স্মার্টফোনে দেখে নেওয়া যায়। শুধু তাই নয়, পছন্দের অংশ ডাউনলোড করে শেয়ার করাও সহজ। সৌজন্য- ইন্টারনেট।

বই কিনতে কি আর কলেজ স্ট্রিটে যান ? বাড়ি বসেই তো প্রচুর ডিসকাউন্টে বই কেনা যায়। শুধু কি বই, যাবতীয় কেনাকাটা, রেলের বা প্লেনের টিকিট থেকে শুরু করে, সংসারের মাসকাবারি বাজার আজকাল ফোনেই হচ্ছে। অ্যাপ খুলে কয়েকটা ক্লিক করলেই দোরগোড়ায় হাজির ট্যাক্সি। আর কী চাই?

তবে ইন্টারনেটের আগমনে কিছু জিনিস আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। হাতঘড়ি আর প্রয়োজনীয় বস্তু নয়, ফ্যাশান সামগ্রী। টেলিফোন ডিরেক্টরি ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা টেলিগ্রাম করা ভুলেই গেছি। পোস্ট কার্ড, ইনল্যান্ড লেটার শেষ কবে ব্যবহার করেছেন মনেই করতে পারবেন না। এনসাইক্লোপিডিয়া শুধুমাত্র পুরনো বইয়ের দোকানে পাওয়া যায়। মানুষ তা কেনে সাজিয়ে রাখার জন্য। কলেজ পড়ুয়াদের বই কিনতে হয় না বললেই চলে, সব কিছু পাওয়া যায় ই-বুকে। ডিভিডি প্লেয়ার আর মিউজিক সিস্টেম ব্যবহার প্রায় উঠেই গেছে। নিখরচায় গান শুনতে বা সিনেমা দেখতে একটা স্মার্টফোনই যথেষ্ট।

অন্যান্য প্রযুক্তির মতোই, ইন্টারনেটও তার নিজস্ব বিপদ সঙ্গে নিয়ে এসেছে। সমস্যা অবশ্যই প্রযুক্তিতে কম, তার ব্যবহারে বেশি। ইন্টারনেট আপন করে নিতে গিয়ে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বস্তুটি আমরা হারিয়েছি তা হল ব্যক্তিগত গোপনীয়তা। ‘রাইট টু প্রাইভেসি’ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু ইন্টারনেট আমাদের উলঙ্গ করে দিয়েছে। কে কখন কোথায় আপনার কোন ছবি তুলে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে তা আপনার জানার উপায় নেই। যখন জানতে পারেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া-সহ ইন্টারনেটের অন্যান্য সুযোগ নিতে গিয়ে বহু ব্যক্তিগত তথ্য বিনিময় করতে হয় আমাদের। ছবি, নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর আর ই-মেল তো বটেই, ব্যাঙ্কের সঙ্গে লেনদেনের গোপন তথ্য সবই শেয়ারিত হয়। সেগুলো থেকে যায় ইন্টারনেট জগতেই। ভুল হাতে পড়লে কি বিপদ হতে পারে, তার উদাহরণ আমরা হরদম দেখছি সংবাদমাধ্যমে। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে আধার। আমাদের দশ আঙুলের ছাপ, চোখের মণির ছবি রয়েছে ইন্টারনেট ভুবনে।

আরও আছে সমস্যা। ‘ডাক্তারবাবু, আপনি সার্ট্রালিন হাইড্রোক্লোরাইড দিয়েছেন। ওটা তো এ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট, খাওয়া উচিত হবে কি...’ কিংবা ‘ডাক্তারবাবু, আমার তো গণ্ডগোল পেটে, থাইরয়েড টেস্ট করাব কেন? অ্যান্টিবায়োটিক তো খেলাম কিছু দিন।’ হামেশাই এমন ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় ডাক্তারদের আজকাল। কারণ, ইন্টারনেটের দৌলতে আমরা সবাই হাফ ডাক্তার। দরকার শুধু একটা স্মার্টফোন। নিজের চিকিৎসা নিজেই করি। বিপাকে পড়লে তখন ডাক্তার। তামিলনাডুর তিরুপুর শহরের এক ব্যক্তি তো ইন্টারনেটের সাহায্যে স্ত্রীর প্রসব করাতে গিয়েছিলেন। ইউটিউব দেখে বাচ্চা ডেলিভারি ! গা শিউরে উঠছে। কিন্তু এমনই অবিবেচক কাজের ফলে মর্মান্তিক ভাবে মৃত্যু হয়েছে তাঁর স্ত্রীর। ইন্টারনেট আসার আগে এমন দুঃসাহস কেউ দেখিয়েছে কি?

ইন্টারনেট জীবনে আমরা মামুলী বিষয়েই আঘাতপ্রাপ্ত হই। ধরুন আপনি আপনার বেড়ালের ছবি বা ভিডিও শেয়ার করেছেন ফেসবুক বা টুইটারে। কোনও অত্যুৎসাহি বন্ধু কমেন্ট করবেন যে বেড়াল স্বার্থপর প্রাণী, তাই কুকুর পোষা ভাল। তর্ক বিতর্কের পর আনফ্রেন্ড বা ব্লক করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কেউ ঢেঁড়সের গুণাগুণ নিয়ে পোস্ট করলে আপনি করলার হয়ে লড়ে যাবেন। ধর্ম বা রাজনৈতিক পোস্ট হলে তো অতি সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হয়। কখন কার সুক্ষ্ম অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এসব নিয়ে ট্রল করা এমনকি হত্যার হুমকি দেওয়া এখন জলভাত। রামচন্দ্র গুহ সম্প্রতি তাঁরই বিফ খাওয়ার একটি ছবি পোস্ট করে তার ঠেলা টের পাচ্ছেন।

আরও পড়ুন: স্বাস্থ্য পরিষেবা সরকারেরই দায়​

সোশ্যাল মিডিয়া হল ক্যাঙ্গারু কোর্ট। কোনও ঘটনার সত্যাসত্য বিচার না করেই নেটিজেনকূল বিচার করে রায় দিতে অভ্যস্ত। কানহাইয়া কুমার এবং উমর খলিদের জীবন প্রায় নষ্ট করে দিয়েছিলাম আমরা। ভুয়ো খবর প্রচার আর একটা বিপজ্জনক দিক। না বুঝেই কত কী-ই না আমরা শেয়ার করি। সারা দেশে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে গোহত্যার গুজব ছড়ানোর বলি হয়েছেন অনেক মানুষ। এ সবের প্রত্যেকটির প্রভাব কোনও না কোনও ভাবে পড়েছে আপনার আমার জীবনে।

ইন্টারনেটের আশীর্বাদে পৃথিবীতে আজ সত্যিই মার্শাল ম্যাকলুহানের প্রবর্তিত গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রামের ধারণা বাস্তবতা পেয়েছে। দেশ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে যুক্ত এখন বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ। অর্থাৎ আড়াইশ কোটি মানুষ যদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত থেকে থাকেন, তবে অন্তর্জালে ভেসে বেড়াচ্ছে আড়াইশ কোটি পরিপ্রেক্ষণ। ইন্টারনেট যে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে আমাদের, তাতে আমরা এখন আর শুধুমাত্র তথ্যের উপভোক্তা হয়ে থাকতে রাজি নই, নিজেরাই কন্টেন্ট স্রষ্ঠা। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি ওরিজিনাল কন্টেন্ট ছেঁকে প্রয়োজনীয় এবং সঠিক পোস্টটি খুঁজে বের করা এক দুরূহ কাজ। নেট দুনিয়ার সুফল উপভোগ করতে বেশি সময় তাতেই যায়।

আমরা আজকাল ঘুমাই কম, মেলামেশা করি কম। তথ্যের প্লাবন আমাদের মস্তিষ্কে প্রতি নিয়ত আঘাত করে চলেছে। অতএব ইনফরমেশন ওভারলোড, উচ্চ রক্তচাপ, সুগার আরও কত কী। তা বলে কি ইন্টারনেটকে দূরে ঠেলে দেবেন? অবশ্যই নয়। একজন দায়িত্ববান নেটিজেন হয়ে এর সঠিক ব্যবহার করবেন।

ইউটিউবে একবার এক ভিডিও দেখেছিলাম। ভূমিষ্ঠ হয়েই শিশু নার্সের পকেট থেকে মোবাইল ফোন তুলে নেয়। গুগল ঘেঁটে, নির্দেশিকা দেখে, নিজেই নিজের আমবিলিক্যাল কর্ড কেটে ফেলে। এরপর সেলফি তোলে। কম্পিউটার চালায়। আবার জিপিএএস দেখে দেখে পথ চিনে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। আর তা দেখে মূর্ছা যান ডাক্তার। নিন, অনেক্ষণ হয়েছে ফোন নিয়ে, এবার বন্ধ করুন।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE