Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
International women's day 2020

ভারতের সব নিপীড়িত গোষ্ঠীকে সাহস জোগাচ্ছে শাহিনবাগ-পার্কসার্কাসের মেয়েমুখেরা

মনে রাখতে হবে, মেয়েরা প্রান্তিকদের মধ্যেও বেশি প্রান্তিক। কেননা মেয়েদের নামে জমি জায়গা থাকে না, অনেক সময় মেয়েদের অতি অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় | স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে রেজাল্ট কোনটাই তাদের কাছে থাকে না। এখানেই শেষ নয়, ভোটার লিস্টে তাঁদের নামের পাশে বাবা-মায়ের নাম থাকেনা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামীর নাম থাকে।

আন্দোলনের মেয়েমুখেরা।

আন্দোলনের মেয়েমুখেরা।

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ১৬:০৬
Share: Save:

৭ই মার্চ, ঠিক দু’মাস পূর্ণ হল, পার্ক সার্কাসে মেয়েদের অবস্থানের এবং নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনের। ৮ই মার্চের দিনেও এই যে অভূতপূর্ব আন্দোলন আমরা দেখছি, দিল্লির শাহিনবাগ থেকে শুরু হয়ে যা দেশের অন্যান্য শহরে এবং জেলা গুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে, আমাদের কলকাতায় তা শুরু হয় পার্ক সার্কাস ময়দান থেকে। দু'মাস আগের কথায় ফিরে যাচ্ছি না...

সাম্প্রতিক যে ঘটনাগুলি আমার নজরে এসেছে, সেই দু-একটি দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি পাঠক পাঠিকার।

এক হল, কত নতুন নতুন দিক খুলে যাচ্ছে মেয়েদের এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কয়েক দিন আগে এই মার্চের শুরুতেই পার্ক সার্কাস ময়দানে একটি আর্ট ক্যাম্প হয়ে গেল। ক্যাম্পটির নাম দেওয়া হয় ‘আর্ট অ্যাটাক ক্যাম্প’। সেখানে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও বিভিন্ন বয়সী মহিলারা অংশ নিলেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিছু পেশাদার শিল্পীরাও। মধ্য বয়সী এমন কিছু মহিলারা এই আর্ট ক্যাম্পে অংশ নিলেন, যাঁরা হয়তো চোদ্দো-পনেরো বছরের পর আর কোনও দিনই রং তুলি হাতে নেননি | অল্প বয়সে বিয়ে, তার পর সংসার এ সব দায়িত্বের মধ্যে রং তুলি হাতে নেওয়ার আর ফুরসতই হয়নি তাদের। ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি এমন অনেক মহিলারাই এই আর্ট অ্যাটাক ক্যাম্পে ছবি আঁকলেন সে দিন।

কি রকম ছবি আঁকলেন তাঁরা? শাহিনবাগে যে মহিলা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যিনি এখন ‘দাবাং দাদি’ নামে সুপরিচিত, কোনও এক মহিলা এঁকেছেন তাঁর ছবি। এনপিআর থেকে শুরু করে এনআরসি, সিএএ এই তিনটি ধাপের মধ্য দিয়ে যে তিন ধরনের ছাঁকনি ব্যবহার করা হচ্ছে, যাকে রাষ্ট্র ব্যবহার করছে, নাগরিকদের ছেঁকে ছেঁকে বের করে দেওয়ার জন্য সেই ছবিও ধরা পড়েছে কারও কারও রেখায় | এ থেকেই উঠে আসছে একটা আন্দোলনের কত রকম ভাষা | কত নতুন দিক খুলে যাচ্ছে।

কোনও দিন রাজনীতি নিয়ে ভাবেননি যারা, তারাই আজ শক্তি জোগাচ্ছে এই আন্দোলনে

এ তো গেল মার্চের শুরুর ঘটনা। ফেব্রুয়ারির শুরুতে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা অনেকেই জানতে পেরেছিলাম পার্ক সার্কাসের একটি মেয়ের কথা, যিনি রাষ্ট্র বিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, নাম নওসিন বেবা খান | যাঁর নেতৃত্বে একটি বুক কর্নার শুরু করা হয় পার্ক সার্কাসে। প্রত্যেকদিন সন্ধে বেলা এক কোণে কিছু বই নিয়ে নওসিনরা কয়েক জন বসেন। শুরুর দিকে তাঁরা একটা ওপেন কল দিয়েছিলেন যে, কোনও নাগরিক স্বেচ্ছায় সেই বুক কর্নারে তার পছন্দ মতো বই দিয়েও আসতে পারেন। আমিও গিয়েছিলাম, এ ছাড়াও অনেকেই গিয়েছিলেন। অনেকে অনেক বই দিয়েছেন। কবিতার বই থেকে শুরু করে প্রবন্ধ, ইংরেজি,বাংলা উপন্যাস নানা ধরনের বই সেখানে রয়েছে। এই যে উদ্যোগ, প্রতিবাদ মঞ্চের এক পাশে বই সংগ্রহ করে বুক কর্নার গড়ে তোলা, এটাও সূচনা করেছেন কিন্তু মেয়েরাই। আমরা এতদিন ধরে দেখে এসেছি বই সংগ্রহ বা বইয়ের স্টল দেওয়া, সেই স্টল সামলানো এবং জন সম্মুখে বই নিয়ে বসা এগুলো চিরকাল ছেলেরাই করে এসেছে। অথচ এখানে যে মেয়েরা পার্ক সার্কাসে নিয়মিত আন্দোলন করছেন বা তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরাই আবার বুক কর্নার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছেন--এই ভাবে কিছু জেন্ডার স্টিরিওটাইপ এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভাঙতে শুরু করেছে।

মনে রাখতে হবে, মেয়েরা প্রান্তিকদের মধ্যেও বেশি প্রান্তিক। কেননা মেয়েদের নামে জমি জায়গা থাকে না, অনেক সময় মেয়েদের অতি অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় | স্কুল কলেজের সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে রেজাল্ট কোনটাই তাদের কাছে থাকে না। এখানেই শেষ নয়, ভোটার লিস্টে তাঁদের নামের পাশে বাবা-মায়ের নাম থাকেনা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামীর নাম থাকে। কাজেই যে সব নথিপত্র, কাগজ চাওয়া হচ্ছে, যা না দেখতে পারলে রাষ্ট্র নাকি তাকে একজন নাগরিক হিসাবে গণ্য করবে না বা মান্যতা দেবে না সেগুলো মেয়েদের কাছে থাকার সম্ভাবনা অনেক অনেক কম । বিশেষ করে আমাদের দেশের অধিকাংশ মেয়েরা যাঁরা নাকি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দুটি দিক থেকেই প্রান্তিক, তেমনই শিক্ষার দিক থেকে, জাত পাতের দিক থেকে, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া, বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়ি চলে যাওয়ার কারণে অনেক সময়ই এ সব কাগজপত্র তাদের হাতে থাকা এবং সেই প্রমাণ দেখানো তাদের পক্ষে অনেক কঠিন। এই কারণেই হয়তো আমরা দেখতে পাচ্ছি এই আন্দোলনে নানা বয়সী মেয়েরাই আসছে। বেশি বয়সের দাবাং দাদিরাও যেমন আসছে, তেমনই অনেক অল্প বয়সী কোলে বাচ্চা নেওয়া মেয়েরাও আসছে। সেখানেই তাদের বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছেন, ঘুম পাড়াচ্ছেন| শত অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আন্দোলনে যোগদান করছে অনেক মেয়েরাই। কারণ তারা বুঝেছেন যে তাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে এবং এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তারা প্রাণপণ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। শুধু নিজেদের জন্য নয়, ভারতের সব নিপীড়িত গোষ্ঠীকে এই আন্দোলন শক্তি জোগাচ্ছে। তাদের এই প্রান্তিকতাকে হাতিয়ার করেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।

ভারতের সব নিপীড়িত গোষ্ঠীকে এই আন্দোলন শক্তি জোগাচ্ছে

আবার দেখুন পার্ক সার্কাস, নবাব আলি পার্ক, খিদিরপুর, রাজাবাজার, জাকারিয়া স্ট্রিটে যে মেয়েরা অংশ নিচ্ছে, এরা কিন্তু অনেকে বাড়িতে সারা দিন ঘরের কাজ সেরে বিকেলের দিকে ধর্না মঞ্চে আসছেন | এরা কিন্তু সাধারণ ভাবে সন্ধেবেলাতে এমন কিছু অর্থকরী কাজ বাড়িতে বসেই করেন যার ফলে সংসারে দুটো বাড়তি পয়সা আসে| যেমন ধরুন শাড়ি, সালোয়ার কামিজে জরির কাজ বা সেলাই ইত্যাদি কিছু কাজের মধ্যে দিয়ে সংসারে দুটো পয়সা যাতে আয় করা যায় সেভাবে তাদের অবসর সময়ে সংসারের কাজ সামলে যেটুকু বাড়তি সময় পান তারা কাটান | কিন্তু সেই সময়টুকু এখন তারা দিচ্ছেন এই বিভিন্ন প্রতিবাদী মঞ্চে অবস্থানে অংশ নিয়ে | এরা কোনও দিন রাজনীতি নিয়ে ভাবেননি, কোনও দিন কোনও আন্দোলনে যোগ দেবেন তা স্বপ্নেও ভাবেননি | কিন্তু তারাই এই প্রতিবাদ মঞ্চগুলোতে যোগ দিয়ে নতুন ভাবে রাজনীতি সচেতন হচ্ছেন এবং এই আন্দোলনের এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক তৈরি হচ্ছে।

শহরে নয় জেলাতেও দেখা যাচ্ছে যেমন কিছু দিন আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে মুর্শিদাবাদ, নদিয়াতেও মেয়েরা ধর্না মঞ্চে শুরু করেছিল | আমাদের বন্ধু লাবনী জঙ্গির বলা কথা এবং লেখা থেকে জানতে পারি সে বহরমপুরের ধর্না মঞ্চে জানুয়ারির শেষে গিয়েছিল কিন্তু জানুয়ারির শেষে বেশিদিন বহরমপুরের মেয়েরা ধর্না চালাতে পারেনি | কারণ সে সময়টা ছিল সর্ষে ওঠা এবং ধান বোনার সময় | ওই সময় বাড়ির প্রতিদিনের কাজগুলো ফেলে মেয়েদের আসতে হয়েছিল শুধু তাই নয় এই যে ক্ষেতের কাজ মেয়েরা করে এবং গ্রাম থেকে এসে সারাদিন তাদের যাতায়াতেও এতটা সময় ও অর্থ খরচ হয়ে এবং ক্ষেতের কাজ, ধান তোলার কাজ বা বিড়ি বেঁধে যে রোজগারটা তারা করে, সময় মতো তাদের বিড়ি বেঁধে জমা দিতে হয় মহাজনের কাছে সেগুলো বেশিদিন বন্ধ রাখা তাদের আর্থিক অবস্থার পক্ষে সম্ভব নয় বলে তারা হয়তো খুব বেশিদিন ধর্নাটা চালাতে পারেননি। কিন্তু যে কদিন তারা চালিয়েছিলেন সেখানেই কিন্তু তারা সম্পূর্ণভাবে স্লোগান দিয়ে , গান গেয়ে , আসর সরগরম করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই প্রতিবাদে অংশ নেন |

প্রতিবাদের সম্পূর্ণ নতুন ভাষা

আমি আরেকটা জিনিস দেখি, কলকাতায় একদিন আমাদের ‘মৈত্রী’ বলে যে মেয়েদের সংগঠনের একটি নেটওয়ার্ক আছে সেখান থেকে আমরা কয়েকজন মিলে একদিন খিদিরপুরের নবাব আলি পার্কে যে অবস্থান হয়েছিল সেখানে গিয়েছিলাম, প্রায় রাত দশটার দিকে| তখন দেখলাম যদিও ছেলেরাই সেখানে স্লোগান দিচ্ছিলেন , নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, মাইকে তারাই বেশি বলছিলেন কিন্তু মাঠ ভর্তি করে বসেছিলেন নানা বয়সি অনেক মেয়ে | তারা কিন্তু সমানে স্লোগানে গলা মেলাচ্ছিলেন এবং আমাদের মৈত্রী নেটওয়ার্কের বন্ধুরা যখন মাইক হাতে নিয়ে উঠে “মন্দির মসজিদ গির্জা ঘর মে, বাঁট লিয়া ভগবন কো” গাইতে শুরু করে তখন আমি লক্ষ করি মাঠ জুড়ে সমস্ত মেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুরে সুরে সুর মেলাচ্ছেন | এদের মধ্যে নব্বই শতাংশ মেয়ে কিন্তু কখনও এ ধরনের কোনও প্রকাশ্য সমাবেশ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি | তাই গভীর রাত পর্যন্ত তারা যে এ ধরনের সভায় উপস্থিত থেকে গলা মেলাচ্ছেন, প্রতিবাদের এই সম্পূর্ণ নতুন ভাষা এর মধ্যে দিয়ে সূচিত হচ্ছে | শেষে আমি বলব এই ২৬ শে জানুয়ারি আমি খবরে পড়েছিলাম খিদিরপুরের নবাব আলি পার্কের কাছেই যে ইকবালপুর , সেখানে এক গির্জায় সকালবেলা চার্চের ফাদাররা প্রার্থনা করেছেন। সেই প্রতিবেশী বিপন্ন মানুষের জন্য, যাঁদের ঘর বাড়ি, জমি জায়গা সব কিছু কেড়ে দেশ ছাড়া করে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে নাগরিকত্ব আইনের জন্য!

তারা যাতে বিপন্ন না হন- এই ছিল তাঁদের প্রার্থনা | সে খবর পেয়ে সে দিনই বিকেলে তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাতে যান এই নবাব আলি পার্কের সমাবেশ থেকে বেশ কিছু নারী ও পুরুষ | কাজেই এই নতুন নতুন যোগসূত্র এইগুলোও এই আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত হচ্ছে আর এই সমস্ত কিছুতেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন মেয়েরা বা নেতৃত্বে না থাকলেও তারা নানা ভাবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করছেন | সেই সব মেয়েরা যাদের বাড়িতে এখনও হয়তো পর্দাপ্রথা মেনে চলতে হয়, যারা কখনো ঘরের বাইরে বেরিয়ে এ ধরনের কোনও সভা, সমাবেশ, আন্দোলনে অংশ নেননি। আজ তাঁরা অনেকেই আমাদের মনে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখছেন।

লেখক পরিচিত: লেখক, গবেষক, নারী আন্দোলনের কর্মী

অন্য বিষয়গুলি:

International women's day 2020 Shaheen Bagh protests women empowerment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy