Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
International Women's Day

কোন দিনটা নারীর দিন নয়?

তাকে আমরা রান্নাঘরে দেখি দেশের অর্থমন্ত্রীর চেয়েও বেশি চাতুর্যে সামান্য আয়ের টাকায় সন্তানের পাতে এক টুকরো মাছের ব্যবস্থা করতে।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২০ ০০:০৫
Share: Save:

দারুণ কিছু করেনি। পরীক্ষায় রেকর্ড মার্কস, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা অলিম্পিক্সে মেডেল, কোনওটা নেই। তবু সেই মেয়েটাই চ্যাম্পিয়ন। সেই মেয়েটা, যাকে আমরা চার পাশে দেখি, নিজের মধ্যে দেখি, নিজের বিপরীতেও দেখি। প্রত্যহ আমাদের যাপন-বৃত্তান্তে যার বারোমাস্যা লেখা হচ্ছে, সে-ই ‘নারী দিবস’-এর আসল আয়োজক। সে ধর্মঘট করতে পারে, মিছিলে নামতে পারে, রাস্তায় বসে থাকতে পারে মাসের পর মাস। সে কাঁদতে পারে, চিৎকার করতে পারে, আবেদন করতে পারে, দাবি জানাতে পারে, হেরে যেতে পারে, ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়েও নিতে পারে। পুরুষের মতো করে নয়, তার নিজের নিয়মে, মানুষের নিজের স্টাইলে।

তাকে আমরা রান্নাঘরে দেখি দেশের অর্থমন্ত্রীর চেয়েও বেশি চাতুর্যে সামান্য আয়ের টাকায় সন্তানের পাতে এক টুকরো মাছের ব্যবস্থা করতে। আর নিজের প্রায় শূন্য খাওয়ার থালায় সে বাকিদের হাসিমুখ দেখে হাত ধুয়ে ফেলে। সে নোটবন্দির কষ্ট-কালে স্বামীর সামনে আঁচল পেতে দাঁড়ায়। সেখানে জীর্ণ দোমড়ানো নোটে হাজার কয়েক টাকা। ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে সেই মেয়েটাই পাশের বাড়ির ছাদে জোগাড় করে নেয় এক বন্ধু। যার কষ্ট বা সুখ একই রকম। গল্পটা কেবল আলাদা। বাবুর বাড়ির দামি মেঝেয় ন্যাতা বোলাতে বোলাতে সেই মেয়েটা ভাবে, সন্তানের কাশি কী করে সারানো যাবে? তার হাতে মাতাল স্বামীর মারের ব্যথা। তবু সেই হাতেই সে বাজারে গিয়ে বাড়ির জন্য সস্তার সব্জি কেনে। ‘নারী দিবস’ কী, সে জানেই না। তবে এক দিন ছুটি পেলে গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ মা’কে দেখে আসবে।

পরিসংখ্যান দরকার নেই। পাড়ার বা গ্রামের গৃহকোণে চাপা কান্নার আওয়াজ বলে দেবে, তাকে অপমান করা হয়। নির্যাতন করা হয়। হত্যা করা হয়। শুধুমাত্র জন্মালেই তাকে মরতে হয় না, জন্মের আগে ভ্রূণাবস্থাতেও মরতে হয়। কিছু গ্রামে মাসের পর মাস কন্যাশিশু পৃথিবীর আলোই দেখে না। সেই মেয়েটা কিশোরী থাকতেই তার বিয়ে হতে পারে, তাকে বেচে দেওয়াও হতে পারে। আবার ইস্কুলের দিদিমণিদের নিয়ে সেই মেয়েটাই থানায় গিয়ে নিজের বিয়ে আটকেও দেয়। লেখাপড়া করে গাড়িঘোড়া

চড়া তার হতেও পারে, কলেজে যাওয়ার পথে সে ধর্ষিতা এবং খুন হয়েও যেতে পারে। তার পুড়ে কাবাব হয়ে যাওয়া শরীর অথবা যৌনাঙ্গে ঢোকানো লোহার রড সারা দেশে দিন কয়েকের আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে। প্রজাতন্ত্র দিবসে মেয়েদের নেতৃত্বে ছেলেদের প্যারেড দেখে, হলুদ মাখা হাত আঁচলে মুছে সে তার নিজের মেয়ের দিকে এক বুক আশা নিয়ে তাকাতেও পারে।

এমন অনেকের আশাই বুকে নিয়ে একটা মেয়ে চাকরি করতে যায়। যাতায়াতের পথে শুধু নয়, অফিসের চৌহদ্দির মধ্যেও তার নিরাপত্তা নেই। সহকর্মী থেকে বস, সকলেই তার উপদেষ্টা। কারও আড়চোখ, কারও লোভাতুর হাত তাকে কল্পনায় বা বাস্তবেই ছোঁয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও স্পর্শই তার ভাল লাগে না। রাতের বিছানায় ধর্মসিদ্ধ বা আইনসিদ্ধ স্বামীর ‘অধিকার’-স্পর্শও নয়। তাই সে নীরবে চোখের জল ফেলে। দারুণ তেজে উঠে গিয়ে বারান্দাতেও দাঁড়ায়। এই তেজেই বাসের ভিড়ে হাত লুকানো লোভীর গালে সে সপাটে থাপ্পড় কষায়। অফিসে বসের টেবিলে ফেলে আসে প্রতিবাদ। রাস্তার মোড়ে টিজ়ারদের দিকে আগুনদৃষ্টি হেনে ঘুরে দাঁড়ায়। এই তেজেই বাচ্চা কোলে মা স্বামীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, ‘স্ত্রীর পত্র’ লিখে ফেলে, জোন অব আর্কের মতো রুখেও দাঁড়ায়। আজ ভারতের পথঘাটে কান পাতলে স্লোগানের নেতৃত্বে শোনা যায় তারই কণ্ঠ।

তার জন্য, দিন কি বদলাচ্ছে?

ভ্রূণহত্যা, শিশুমৃত্যু, গার্হস্থ্য হিংসা, ধর্ষণের রেকর্ড বলে: না। সেই অগ্নিপরীক্ষার বা বনবাসের যুগ থেকে একই রকম চলছে। আবার অন্য রকম দৃশ্যও আছে। পরিসংখ্যানে দুর্বল, তবু আছে। প্রতিরোধের মঞ্চে, প্রতিবাদের স্লোগানে, স্যানিটারি প্যাডের প্রচারে, নির্ভয়া বা কামদুনি কাণ্ডের বিক্ষোভে, মেয়ের জন্য অনুভব করা বাবার গর্বে, স্ত্রীকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়া জীবনসঙ্গীর ঘর্মাক্ত শরীরে, বান্ধবীর স্কুটির পিছনে নির্দ্বিধায় বসে থাকা বন্ধুর হাসিতে নারীর তথা মনুষ্যত্বের বিজয় কেতন ওড়ে। ‘নারী দিবস’ এই উল্টো দিকের কাহিনিটাকেই দীর্ঘতর করতে চায়। জীবনের ‘ভিক্ট্রি স্ট্যান্ড’-এ মেয়েদের প্রত্যেক মুহূর্তকে দাঁড় করাতে চায়।

সেমিনার, আলোচনা, প্রবন্ধ সবই চলে।

কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা শ্রম করা গৃহবধূর কাজের অর্থনৈতিক মূল্য জন্মায় না। কারখানায় নাইট শিফটে নারী শ্রমিকের কাজের নিরাপত্তা হয় না। রাস্তায়, বাস স্টপে, রেল স্টেশনে পর্যাপ্ত এবং পরিষ্কার শৌচাগার পাওয়া যায় না। বাড়িতে বা কর্মস্থলে সমমর্যাদাও নয়।

এই বাধাগুলো প্রত্যেক দিন একটু একটু করে টপকানোই হল ‘নারী দিবস’। আর তার উদ্‌যাপন চলে জীবননাট্যের প্রত্যেক দৃশ্যে। আসলে সেই মেয়েটা সেই প্রশ্ন তো সেই কবে থেকেই করছে—কোন দিনটা আমার দিন নয়?

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy