মেয়েদের জন্য কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, কত প্রকল্প। তবু কেন মেয়েরা স্কুল ছাড়ছে? প্রশ্নটা তুলল ক্লাস নাইনের অহনা। উত্তরও বার করেছে ভেবে। মেয়েদের পড়ার শত্রু— ভাল পাত্র। ‘‘ভাল ছেলে পেলেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। কেন? কাল আরও ভাল জুটতে পারত।’’ আর এক ছাত্রী সানিয়ার নালিশ, ‘‘আমার এক বন্ধু পড়াশোনায় কত ভাল ছিল। মায়ের মৃত্যুর পর মাতাল বাবা বিয়ে দিয়ে দিল, মেয়েটা আত্মহত্যা করল।’’ বীরভূমের নানা ব্লক থেকে আসা এই মেয়েদের নালিশ, তাদের ইচ্ছে, স্বপ্ন, প্রতিভার গলা টিপে মারা হচ্ছে। এ বছরও অন্তত দু’লক্ষ মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার কেন্দ্রগুলো থেকে ‘মিসিং’ ছিল। স্কুলের পড়া শেষ করার আগেই তারা ঝরে গিয়েছে স্কুলশিক্ষা থেকে। ছেলেদের চাইতে বেশি মেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে, এই ধুয়ো তুলে সেই সত্যটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে প্রতি বছর।
বোলপুরে প্রতীচী ট্রাস্টের বার্ষিক সভা এ বার হল নবনীতা দেব সেনের স্মরণে, বিষয় কন্যাদের শিক্ষা। ছাত্রীরা এই প্রথম বলছে মাইকের সামনে, দু’চার কথার পরেই কেটে যাচ্ছে জড়তা। বাক্যগুলো উঠে আসছে যেন বুক থেকে। সামান্য দূরে বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাসে রামকিঙ্করের ভাস্কর্য, সাঁওতাল নারীর আঁচল উড়ছে হাওয়ায়। আর আজকের আদিবাসী কন্যা মাইকে বলছে, ‘‘সাঁওতালদের মধ্যে মেয়েদের সম্মান নেই। সরকার সবই দিচ্ছে, তবু আমার মতো মেয়েদের মাঠের কাজে লাগানো হচ্ছে। বিয়ে দিচ্ছে।’’ সভা-ভর্তি শিক্ষকদের মধ্যে নৈঃশব্দ্য নেমে আসে যখন এই ‘ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার’ প্রশ্ন করে, ‘‘স্কুলে যা পড়ানো হয়, তার সঙ্গে কি জীবনের কোনও মিল আছে?’’
থাকবে কী করে? মেয়েদের স্বাধিকার, সক্ষমতার পাঠ কি সমাজ গ্রহণ করেছে? স্বয়ং সরকার কি পাত্তা দেয় তাকে? যখন কন্যাশ্রী বাহিনী কিংবা এনজিও কর্মীকে নাবালিকার বিয়ে রুখতে এগিয়ে দিয়ে ওসি থানায় বসে দাঁত খোঁটেন, যখন চাইল্ড হেল্পলাইনে ফোন করলে কর্মীরা দাবি করেন, ‘‘মেয়ের বয়সের সার্টিফিকেট জেরক্স করে পাঠান’’, যখন পঞ্চায়েত প্রধান নাবালিকার বিয়েতে নেমন্তন্ন খেয়ে আসেন, তখন মেয়েরা বুঝে যায়, ‘উৎসাহ’ দিয়ে ওদের উচ্চাশার গাছে তুলে মই কাড়তে হাত কাঁপে না সরকারের। আজ সাইকেল, কাল হেঁশেল, এই অবিচারে মেয়েদের বুক ভেঙে গেলেও নেতা-আধিকারিকদের কিস্যু যায়-আসে না।
আরও পড়ুন:
ওরা তোমার লোক? অ মা, আমরা কার লোক তবে?
নারী-পুরুষ এবং বিভাজনের বোধ রোজ ভাঙছে-গড়ছে বলিউড
কত নগ্ন, নির্লজ্জ পুরুষতন্ত্র কাজ করছে পুলিশ-প্রশাসনে, আন্দাজ হয় এক মাদ্রাসার প্রধানশিক্ষিকার কথায়। মাধ্যমিক পরীক্ষার সকালে কয়েকটি মেয়ে খবর নিয়ে এল, ক্লাস নাইনের এক সহপাঠীর বিয়ে হচ্ছে। পাত্র তারই ভাই। তাই কখনও হয়? শিক্ষিকাকে এক ভয়াবহ গল্প বলল মেয়েরা। পালক পিতার উপর্যুপরি ধর্ষণে মেয়েটি গর্ভবতী, বাড়িরই একটি ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে সব দিক ‘রক্ষা করা’ হচ্ছে। শিক্ষিকা ফোন করলেন পুলিশ, বিডিওকে। নাবালিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এখনই যান। কর্তারা সবাই মাধ্যমিকে ব্যস্ত। অনেক তাগাদার পর ‘খোঁজ’ নিয়ে পুলিশকর্তা ফোন করলেন, ‘আপনি তো আসল ব্যাপারটা জানেন না ম্যাডাম। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট।’
হ্যাঁ, এ বছরেরই ঘটনা। না, সে বিয়ে রুখতে কেউ যায়নি পুলিশ-প্রশাসন থেকে। পর দিন স্কুলে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল ধর্ষিতা-বিবাহিতা নাবালিকার বন্ধুরা। প্রধানশিক্ষিকা ওদের জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘‘অপেক্ষা কর। এক দিন তোদের সময় আসবে, সে দিন তোরা বদলাবি দেশকে।’’ উপায় কি? এখন প্রতিবাদ করলে তো এই মেয়েদেরই বাড়ি থেকে বার করে দেবে।
এই হল বই-সাইকেল বিতরণকারী সরকারের মুখ। কন্যাশ্রীর পঁচিশ হাজার টাকা যে মেয়ের বাপ-মা আঠারো বছরে বিয়ের ‘লাইসেন্স’ বলে ধরে নিয়েছে, সরকার কি তা জানে না? বিলক্ষণ জানে, এবং সেই ভুল ধারণা নস্যাৎ করতে কড়ে আঙুলটিও নাড়ে না। মেয়েরাও ধরে নিয়েছে, টাকাটা পণের জন্য। হিঙ্গলগঞ্জের এক প্রধানশিক্ষককে তাঁর ছাত্রীরা প্রশ্ন করেছে, স্যর, ওই টাকায় কি ব্যবসাও করা যায়? হিঙ্গলগঞ্জ কলেজে ভর্তির বছরখানেকের মধ্যে ষাট শতাংশ মেয়ে ‘ড্রপ আউট’ হয়ে যায়। অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকে গিয়েছে, আর মেয়েকে পড়িয়ে কী হবে? প্রতীচীর সভায় এক শিক্ষক প্রশ্ন করলেন, শিক্ষার জন্য ‘কন্যাশ্রী’ আর বিয়ের জন্য ‘রূপশ্রী’, এ কি পরস্পরবিরোধী নয়?
মেয়েদের কাছে ‘সক্ষমতা’ মানে, নিজের ইচ্ছেয় বাঁচা। মাথা উঁচু করে, আনন্দে বাঁচা। সরকারের কাছে ‘সক্ষমতা’ মানে, কোনওক্রমে আঠারো পার করে দেওয়া, যাতে নাবালিকা বিয়ে উন্নয়নের সূচক নামিয়ে সরকারকে ঝামেলায় না ফেলে। ‘কন্যাশ্রী’রা অবাক হয়ে দেখে, আঠারো পূর্ণ হওয়ার আগে বাপ-মা জোর করে বিয়ে দিলে যদি বা পুলিশ নালিশ শোনে, আঠারো বছর এক দিন বয়স হলে কানেই তোলে না। বারুইপুরের একটি মেয়ে এক বার এমনই এক সভায় প্রশ্ন করেছিল, ‘‘আঠারো বছর বয়স হলে মেয়েদের কী হয়, বলতে পারেন?’’ পুলিশ-প্রশাসনের কাছে অন্তত তা স্পষ্ট— আঠারো হয়ে গেলে মেয়ের বিয়ে আর তাদের মাথাব্যথা নয়। তখন মেয়ের অনিচ্ছায় বিয়ে ‘ফ্যামিলির ব্যাপার।’ যার ইচ্ছে-অনিচ্ছের দাম নেই, তার জীবনের দাম কী? সভায় দাঁড়িয়ে এক ছাত্রী বলে যাচ্ছিল তার দেখা খুন-আত্মহত্যার ঘটনা— পিসির মেয়ে, পড়শি বন্ধু, গ্রামের দিদি, স্কুলের সহপাঠী। কারও ষোলো, কারও একুশে শেষ হয়েছে জীবন। বছর চোদ্দোর বালিকা চার-পাঁচ মিনিটে চারটি অপমৃত্যুর উল্লেখ করল। এত মৃত্যু তোমরা দেখেছ? পাশে-বসা পঞ্চদশী নিচু গলায় বলল, ‘‘আমিই তো মরতে গিয়েছিলাম।’’ প্রেম জানাজানি হতে ঘরে আটক, মারধর, বিষ খাওয়া। ‘‘বাড়ি, স্কুল, টিউশন, সবাই মনটা ভেঙে দিয়েছিল। শেষে নিজের সঙ্গে নিজেই লড়াই করলাম।’’ এই লড়াই চলছে ঘরে ঘরে।
‘‘স্কুল ক্যাম্পাসে এত ভয়ানক ঘটনা দেখছি। নিজেদের সহ্যশক্তি দেখে নিজেরাই অবাক হই’’, বললেন প্রধানশিক্ষিকা বিদিশা ঘোষ। ‘‘আমরাও যেন বাদবাকি ভারতবর্ষের মতো হয়ে গিয়েছি।’’ বাকি ভারত, যেখানে শহরের একাংশে আগুন জ্বলে, অন্য অংশ অফিস করে। মেয়েদের জীবনে নিত্যই এমন ‘দাঙ্গা-পরিস্থিতি’। যে কারণে দাঙ্গা করাতে হয়, সেই কারণেই বাপ-শ্বশুর, স্বামী-ভাই মেয়েদের পুড়িয়ে দেয়, তাড়িয়ে দেয়। ‘পূর্ণ নাগরিক’ হওয়ার দাবি যেন ওরা না করে। স্কুলে সমান শিক্ষা, রেশনে সমান চাল, নির্বাচনে সমান ভোট দিতে পেয়ে না ভেবে বসে, ওরা সমান। এখানে বাঁচতে হলে চলতে হবে কথা শুনে, মাথা নিচু করে।
‘‘সরকার না চাহি তো দাঙ্গা না হোই।’’ সরকার চাইলে একটা মেয়েরও অনিচ্ছায় বিয়ে হত না, এক জনও পাচারকারী ছাড়া পেত না। যে ব্যবস্থার দ্বারা একই রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একদল ছেলে দিনের পর দিন ছাত্রীদের বিরক্ত করতে পারে, কেউ তাদের নিরস্ত করে না, বরং মেয়েরাই অপমান-নির্যাতনের ভয়ে স্কুল-কোচিং-টিউশন ছেড়ে দেয়, এ দেশে তার নাম ‘আইনশৃঙ্খলা’। নির্যাতনের মাধ্যমে আধিপত্য কায়েম করার ‘সিস্টেম’ রাষ্ট্র ছাড়া কাজ করতে পারে না। শিক্ষকেরা তা বোঝেন বলেই অনেকে স্কুলে ‘মেয়ে’ হওয়ার পাঠ পড়াতে চান— এমন জামা পরবে না যাতে ছেলেরা তাকায়। নো মোবাইল, নো প্রেম। হিংসা এড়ানোর ‘শিক্ষা’ দেন। এঁরাই সংখ্যায় বেশি। অল্প ক’জন মনে করেন, হিংসাকে পরাহত করে বাঁচার কৌশল রপ্ত করাই ‘শিক্ষা’। এক শিক্ষিকার আক্ষেপ, ‘‘স্কুলে কম্পিউটার শিখিয়ে কী হবে, ক্যারাটে শেখালে কাজ হত।’’
যা কিছু শেখানোর, স্কুলেই শেখাতে হবে। হিংসার অবিরল বর্ষণে গিরি গোবর্ধনের মতো, মেয়েদের ওই একটি আশ্রয়। এক তরুণী সভায় বললেন, পাঁচ বছর বয়সে পরিবারে নিষ্ঠুর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তিনি। স্কুলের এক দিদিমণিই তাকে ডেকে বলেন, ‘‘তুই চুপচাপ কেন?’’ সহৃদয় ব্যবহারে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন শিক্ষিকারা। ‘‘আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছি আমার টিচারদের জন্য।’’ সভায় নানা বক্তার কথায় এল সেই মেয়েদের কথা, যারা বাড়ি পালিয়ে স্কুলে আসে পাচার হয়ে উদ্ধার-হওয়া মেয়ে, বিয়ের পর বিতাড়িত মেয়ে, প্রেমে ঘা খেয়ে দিশাহারা মেয়ে, বিয়ে করার চাপের সঙ্গে লড়াইরত মেয়ে, অন্তহীন গৃহকাজ-বন্দি মেয়ে। স্কুলকে জড়িয়ে ওরা উঠে দাঁড়াতে চায়। সেখানেও যারা ‘ছি ছি দূর দূর’ শুনছে, সেই মেয়েরা হারিয়ে যাচ্ছে।
শত ত্রুটি, সহস্র অভাব, নেতার রক্তচক্ষু, জেলা অফিসের হুমকি সত্ত্বেও সরকারি স্কুলের একটি মর্যাদা রয়েছে, যা কেউ সহসা অতিক্রম করতে পারে না। ওইটুকু অবলম্বন করে গ্রাম-মফস্সলের কিছু সরকারি স্কুল অতিক্রম করছে সরকারকে। স্যর-দিদিমণি ছাত্রীকে বলছেন, ‘‘মেয়ে হয়েছিস তো কী হয়েছে? সব পারবি!’’ সেই মুহূর্তটাই নারী দিবস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy