সত্যিই স্বদেশী ভাষা বা মাতৃভাষা ছাড়া মনের কথা বা মনের ভাব প্রকাশ করে আশা মেটে না। বাংলাদেশ-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাতৃভাষার জন্য বহু মানুষ শহিদ হয়েছেন হাসি মুখে।
সম্প্রতি ভারতবর্ষ-সহ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপিত হল। নানা অনুষ্ঠানে উঠে এল মাতৃভাষার বিকাশ ও তাকে কী ভাবে আরও ঋদ্ধ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা। এই বিষয়ে বিস্তর উদ্যোগ ও চিন্তাভাবনা দেখা গেল সরকারি ও বেসরকারি স্তরে।
কিন্তু সমগ্র পৃথিবী জুড়েই কয়েক কোটি মানুষ আছেন যাঁদের নিজেদের মনের কথা বলার জন্য আইন স্বীকৃত ভাষা নেই। তাঁরা ভাষা ও শ্রবণ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ। তাঁরা মনের ভাব প্রকাশ করেন সাঙ্কেতিক ভাষার মাধ্যমে। ভারতবর্ষে বর্তমানে ২ কোটি ৫০ লক্ষ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি ভাষা ও শ্রবণ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ রয়েছেন। প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এঁরা কথা বলেন নিজেদের মতো করে। তাঁদেরও একটা নিজস্ব ভাষা আছে। যাকে আমরা ‘সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা ‘সাঙ্কেতিক ভাষা’ বলি।
অস্ট্রেলিয়া, নিউজ়িল্যান্ড, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, লাতিন আমেরিকার বহু দেশ-সহ আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা, নেপাল সাঙ্কেতিক ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘আধুনিক’ ভারতবর্ষ এখনও এই ভারতীয় সাঙ্কেতিক ভাষা বা ISL কে আইনি স্বীকৃতি দিতে পারেনি।
একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষকে দৈনন্দিন জীবনে প্রতি মুহূর্তে তাঁর পরিবারে এবং বৃহত্তর সমাজে ‘কথা বলা’ মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময় বা ‘কমিউনিকেট’ করতে হয়। এঁদেরও সাধারণ মানুষের মতো সুখ, দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি সমস্ত অনুভূতিই থাকে। তিনি যদি পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে না পারেন বা পরিবারের কথা বলা মানুষেরা তাঁদের অব্যক্ত অনুভূতিগুলোকে উপলব্ধি করতে না পারেন, তবে তিনি ক্রমেই অসহায় ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সুভা’ নামক ছোট গল্পে অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তারপরে শতাব্দী অতিবাহিত হয়ে গেলেও অবস্থার পরিবর্তন বিশেষ কিছু হয়নি।
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘বোবার শত্রু নেই’। আসলে শত্রু থাক বা না থাক মিত্র যে নেই সে কথা বিলক্ষণ বলা যায়।
১৯৯৫ সালে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষদের সমানাধিকার, অধিকার রক্ষা ও পূর্ণ অংশগ্রহণ আইনে শ্রবণ ও বাক্্ প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য শুধুমাত্র মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কথা বলা হয়। পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তা আমরা কার্যকর করে তুলতে পারিনি। কারণ, শব্দের থেকেই ভাষার উৎপত্তি। যে শিশুর কানে শব্দটাই প্রবেশ করেনি, কোনও ভাষাই তার মধ্যে গড়ে ওঠেনি, তাকে এখনও আমরা তিনটে ভাষা চর্চা করতে বাধ্য করছি। ফলে পঠনপাঠনটাই তার কাছে একটা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা সাঙ্কেতিক ভাষা বাক্্ প্রতিবন্ধীদের জন্য যতটা প্রয়োজন, বাঙ্ময় মানুষদের জন্যও সমান ভাবে প্রয়োজন। আমরা যখন সমগ্র শিক্ষা বা ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি, তখন এই বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ বিদ্যালয়ের শিক্ষক যদি শ্রবণ ও বাক্্ প্রতিবন্ধী শিশুর সাঙ্কেতিক ভাষা বুঝতে না পারেন, তা হলে সমগ্র শিক্ষার উদ্দেশ্যেটাই মাটি হবে। কারণ, এক্ষেত্রে শিক্ষকদের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া হয় না। আমাদের দেশে যদি একটি সংবিধান স্বীকৃত সাঙ্কেতিক ভাষা থাকত, তাহলে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান সম্ভব হত। শিক্ষক প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রমে এই বিষয়ে পাঠ থাকলে সমগ্র শিক্ষা অনেকাংশেই সফল হতে পারত।
শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রেই নয়, একজন মূক মানুষকে তার দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব সমস্যারই একলা মোকাবিলা করতে হয়। কলকাতার মতো বড় শহরে কর্পোরেট বা সরকারি হাসপাতালে কোনও প্রশিক্ষিত ইন্টারপ্রেটার নেই। ফলে কী ভাবে একজন বাক্্ প্রতিবন্ধী মানুষ তার সমস্যার কথা চিকিৎসকের কাছে বলতে পারবেন তা অজানা। এক্ষেত্রে চিকিৎসা বিভ্রাটের যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে এবং তা হয়েও থাকে। আমরা কেউ তার খবর রাখি না। আজও আমাদের দেশে বাক্্ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মহিলারা শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে ‘সফ্ট টার্গেট’। কারণ বিচারালয়ে এদের বয়ান দিতে হয় ইন্টারপ্রেটারের মাধ্যমে। সেখানে বাস্তব আর ব্যাখ্যার ফারাক থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। তাই বাক্্ প্রতিবন্ধকতা যুক্ত মহিলারা নির্যাতিত হলে অপরাধীর সাজার ঘটনা হয় না বললেই চলে। আবার প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে অনেক অভিভাবকই থানা পুলিশ করতে চান না। অনেকক্ষেত্রে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে লোক জানাজানির ভয়ে অভিভাবকরা বিষয়টি চেপে রাখেন। থানা বা আদালতে তাঁদের সাঙ্কেতিক ভাষা জানা বা বোঝার বিশেষজ্ঞ থাকলে এঁরা ন্যায় বিচার পেতেন। দেশের বড় বড় রেল স্টেশন বা বিমান বন্দরে সাধারণ মানুষের জন্য অনুসন্ধান কেন্দ্র থাকে কিন্তু এই ধরনের ব্যক্তিরা সমস্যায় পড়লে বা কোনও অনুসন্ধানের প্রয়োজন হলে কোনও সাঙ্কেতিক ভাষায় প্রশিক্ষিত কর্মীর সাহায্য মেলে না। বরং সহযোগিতার নামে প্রতারণা বা নির্যাতনের শিকার হন অনেকে।
ভারতবর্ষ নানা ভাষার দেশ। তাই জাতীয় সাঙ্কেতিক ভাষা গড়ে তোলা কঠিন কাজ নিশ্চয়ই। ভারতীয় সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ভারতীয় সাঙ্কেতিক ভাষাকে কয়েকবার আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি।
আশার কথা, দেরিতে হলেও মুম্বইয়ের ‘আলি জবরজং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং ডিজ়াবিলিটিস’ ও অধুনা প্রতিষ্ঠিত নতুন দিল্লির ‘ইন্ডিয়ান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার’ বাক্্ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের জন্য একটি সাঙ্কেতিক ভাষা গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে। কিন্তু যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে প্রান্তিক ভারতবর্ষের লাখ লাখ ‘সুভা’র জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে, সেই দৃষ্টিভঙ্গি এখনও গড়ে ওঠেনি। এই মানুষদের মুখে ‘ভাষা’ দেওয়ার জন্য দলমত নির্বিশেষে সকলকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে এই কঠিন কাজ সফল হবে। একটি জাতীয় সাঙ্কেতিক ভাষা স্বীকৃতি পেলে দেড় কোটি ভাষাহীন মানুষ এক নিঃশব্দ ভাষার বাঁধনে যুক্ত হতে পারবেন। সেটাই হবে বাক্্ প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষের কাছে নিঃশব্দ বিপ্লব।
লেখক: শিক্ষক, আনন্দ ভবন ডেফ অ্যান্ড ব্লাইন্ড স্কুল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy