প্রতিষ্ঠান বনাম পড়ুয়া?’ শীর্ষক উত্তর-সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে (আবাপ, ১৭-১) বিশ্বভারতীর সংসদ (কোর্ট) সদস্য, রাজ্যসভার সাংসদ এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রীস্বপন দাশগুপ্তের বিশ্বভারতীতে প্রদত্ত সাম্প্রতিক একটি বক্তৃতা নিয়ে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু পর্যবেক্ষণ উত্থাপিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পূর্বনির্ধারিত বক্তৃতাটি, বিশ্বভারতীর ‘লেকচার-সিরিজ়’-এর অন্তর্গত। এই সিরিজ়-এ নানা ভিন্ন মত এবং আদর্শে বিশ্বাসী গুণিজন এ-যাবৎ বিশ্বভারতীতে আমন্ত্রিত হয়েছেন। সামাজিক, সাংবিধানিক বা আইনগত বিষয় এর আগেও আলোচিত হয়েছে।
যে বক্তৃতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তার বিষয় সংসদে সম্প্রতি প্রণীত নাগরিকত্ব আইন। বক্তৃতাটির বিষয়ের সঙ্গে বা এই আইনের সঙ্গে অনেকে একমত নাও হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই এই নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কের অবকাশ আছে। লেখক বক্তৃতার শেষে কঠিন ও অস্বস্তিকর প্রশ্ন করার এবং মতবিনিময়ের সুযোগ ও স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। আলোচনা শুনতে আগ্রহী কাউকেই বাধা দেওয়া হয়নি। আলোচনার ঘোষিত বাধাপ্রদানকারী শক্তিকে সভা থেকে দূরত্বে রাখা হয়েছে।
তিনি লিখেছেন, ঘরের বাইরে থাকা প্রতিবাদী ছাত্রেরা তাঁকে বলেন, “আমরা কোনও দলের নই, আমরা স্টুডেন্ট।” প্রবন্ধের সঙ্গে প্রকাশিত ‘প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের ভিড়’ বোঝাতে যে ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে তিনটি লাল পতাকা দেখা যাচ্ছে। লাল পতাকা ভারতের রাজনীতিতে কোন পরিচিতি বহন করে, তা অজানা নয়। আলোচ্য সভাটি বয়কটের জন্য কিছু বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ডাক দেয়, বিদ্বেষমূলক প্রচার চালায়, ‘লিপিকা’ সভাগৃহের সামনে জমায়েত হয়ে সভা ভন্ডুল করার উদ্যোগও নেয়। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কোনও সংঘাতে না গিয়ে অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে সভার স্থান বদল করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়।
লেখক লিখছেন, সভায় উপস্থিত থাকতে দেখে প্রতিবাদী ছাত্রেরা তাঁকে প্রশ্ন করেছেন, “যে কারও কথা আপনি শুনবেন?” স্পষ্টতই, এই প্রতিবাদীরা সকলকে সমান ভাবে কথা বলতে দিতে অপারগ, সকলের কথা শুনতেও উৎসাহী নয়। সভা অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার পরেও তারা সভাস্থলে বিশাল বাহিনী নিয়ে হাজির হয়ে হামলা চালায়। আলোচনা শুনতে আসা ছাত্রছাত্রীরা দৃশ্যত আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সেই সংগঠিত হামলার একটা ছবি প্রতিবেদকের লেখায় ধরা পড়েছে, যেখানে আশ্রমসঙ্গীতকেও অবজ্ঞা করে তারা ‘উপাচার্য ছি ছি’ স্লোগান দিচ্ছে। উপাচার্যকে ‘এখানেই কবর দেব’ গোত্রের মন্তব্যসহ তাদের প্রতিবাদের অশালীন ভাষা অবশ্য তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন। প্রতিবাদীদের সঙ্গে উপস্থিত শ্রোতৃবৃন্দের সংঘাত এড়াবার জন্যই গেটে তালা দিয়ে রাখা হয়। অনুষ্ঠান সমাপ্তির পাঁচ ঘণ্টা পরেও প্রতিবাদীর দল সভাস্থলে প্রধান বক্তা এবং উপাচার্যসহ উপস্থিত সমস্ত শ্রোতাদের আটক করে রাখে, যার মধ্যে প্রতিবেদক নিজেও ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে উপাচার্য সকলকে সংযত থাকার পরামর্শ দেন। কোনও প্ররোচনায় পা না দিয়ে, তিনি বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীদের পুলিশ ডেকে দমন না করার সিদ্ধান্ত নেন। এক সময় আন্দোলনকারীরা ফিরে যান, যার মধ্যে বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী ছাড়াও অনেক অজ্ঞাতপরিচয় মুখও ছিল। ঘটনার প্রকৃত তথ্য যাচাইয়ের জন্য বিশ্বভারতী এক প্রাক্তন বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
প্রসঙ্গত, সুদীর্ঘকাল বিশ্বভারতীর অভ্যন্তরীণ অনিয়ম-বেনিয়ম, প্রশাসনিক পক্ষপাত ও অকর্মণ্যতার যে সব অভিযোগ বার বার শিরোনামে উঠে এসেছে, সেই সব সমস্যা দূর করার জন্য সাম্প্রতিক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গত এক বছরে বিশ্বভারতীতে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করা হয়েছে। পরিবেশ-বান্ধব পৌষমেলা, উচ্ছৃঙ্খলতাহীন বসন্তোৎসব, ছাত্র-শিক্ষক এবং কর্মীদের মধ্যে শ্রদ্ধার সম্পর্কের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মুক্ত ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলা, দলমত নির্বিশেষে আলোচনার মাধ্যমে সকলকে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কর্মী এবং অধ্যাপকদের সময়ানুবর্তিতা এবং পূর্ণ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করা, চিকিৎসা এবং ভ্রমণ খাতে বরাদ্দ অর্থের তছরুপ বন্ধ করা— যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ।
কিছু দিন আগেও, প্রয়োজন ও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ফি-বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে পঁচিশ ঘণ্টা ঘেরাও থাকতে হয় বিশ্বভারতীর উপাচার্যসহ শিক্ষক এবং কর্মীদের। অন্য কয়েকটি সিদ্ধান্তে যাঁদের স্বার্থ আহত হয়েছে, তেমন কিছু কর্মী উপাচার্যকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করে তাঁর দফতরে তালা দিয়ে তাঁকে বন্দি করে রাখে। কোনও প্রতিবাদী স্বর এই সব ঘটনায় শোনা যায়নি। আদালতের নির্দেশকে মান্যতা দিতে পৌষমেলা নির্ধারিত সময়ে ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নিলে উপাচার্যসহ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে পুলিশে অভিযোগ করা হয়। কেন?
বিশ্বভারতী স্বাধীন আলোচনা, বিতর্ক, যুক্তিচর্চায় বিশ্বাসী। শুধু আমন্ত্রিত বক্তাই নয়, শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য কাউকে যাতে অশ্রাব্য গালমন্দ এবং হেনস্থার শিকার হতে না হয়, আলোচনার তেমনই এক সুস্থ পরিবেশ রচনা করতে বিশ্বভারতী বদ্ধপরিকর। ভিন্ন মত, ভিন্ন স্বর শান্তিনিকেতন আশ্রমকে নির্মাণ করেছে। আড়ম্বরহীন আশ্রমজীবনে, বিশিষ্ট জ্ঞানতাপসদের নিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছাত্রছাত্রীদের পরিচিত করতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর সংস্কৃতি, দর্শন, ভাবনা এবং সৃজনের শ্রেষ্ঠ ধারাগুলির সঙ্গে। একই সঙ্গে চেয়েছিলেন এক অনুপম, নান্দনিক পরিবেশ রচনা করে তুলতে। সাম্প্রতিক দেওয়াল লিখনগুলির কদর্যতা যেমন সেই ধারার পরিপন্থী, তেমনই ভয়াবহ ‘যে কারও কথা’ অন্যকে শুনতে না দেওয়ার প্রবণতা, হিংসাশ্রয়ী প্রতিরোধ। বিশ্বভারতী ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সৌজন্য ও সংযম নিয়ে এই সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টাকে ব্যাহত করবে।
ভারপ্রাপ্ত জনসংযোগ আধিকারিক, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy