লকডাউন সম্পূর্ণত ওঠার পর কেমন হবে স্কুলজীবন? প্রায় তিন মাস হল, গৃহবন্দি থাকতে থাকতে এই প্রশ্নটাই আমাদের সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। শিক্ষকরা স্বপ্নেও ভাবেননি যে এমন একটা দিন আসতে চলেছে, যখন স্কুলে ফেরার আর বাস্তবের ক্লাসরুমে পড়ানোর জন্য তাঁদের এমন আকুল অপেক্ষা করতে হবে। কখনও ভাবতেও পারেননি লকডাউনের আগে যে স্কুলজীবনকে তাঁরা জানতেন, চিনতেন, হয়তো চিরতরেই তাকে হারিয়ে ফেলতে হবে।
প্রত্যেকেই জানতেন যে, একুশ শতকে আমাদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে প্রযুক্তির হাতে। বাচ্চাদেরও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছিল কৃত্রিম মেধা, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিক্স সম্পর্কে জানার জন্য। কিন্তু কেউই এই অদ্ভুত বিশ্ব-পরিস্থিতির কথা কল্পনা করতে পারেননি, যেখানে মাসের পর মাস স্কুল ক্যাম্পাসে কারও পা পড়বে না আর পড়ুয়ারা, যাদের সুযোগ আছে, বাড়িবন্দি হয়ে অনলাইন ক্লাস করবে।
গত কয়েক মাস ধরে আমরা চেষ্টা করছি আমাদের স্কুলটাকে “ভার্চুয়ালি” চালাতে। শিক্ষিকারাও নতুন উদ্যমে নিজেদের গড়ে নিয়েছেন। দ্রুত শিখে নিয়েছেন কী ভাবে বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে অনলাইন ক্লাস চালাতে হয়, মেল, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ওয়ার্কশিট, ছোট শিক্ষামূলক ভিডিয়ো বা প্রশ্নপত্র পাঠাতে হয়। ট্যাবলেটের সাহায্যে বিভিন্ন বিষয় শেখা ছাড়াও বাচ্চারা নানা রকম শিল্পকর্ম, গানবাজনার বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইন্টারনেটে তুলে ধরছে, অভিভাবকরাও বাচ্চাদের নানা রকম অ্যাক্টিভিটি-র ভিডিয়ো বানিয়ে শিক্ষকদের কাছে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা হল, নতুনত্বের এই স্বাদও দ্রুত উবে যাওয়ার পথে। অনেকেই স্ক্রিন-ক্লান্তির শিকার। পাশাপাশি, খুব কষ্টের সঙ্গে আমরা উপলব্ধি করছি সেই সব শিশুদের অবস্থা, যাদের এই সুবিধে নেই। তাদের শিক্ষার প্রক্রিয়াটা যেন আচমকা থেমে গিয়েছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
আসলে, গোটা দুনিয়াটাই এখন ভয়ানক অস্থির। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে যদি আগের স্বাভাবিকত্বের কিছুটাও অন্তত ফিরে পাওয়া যায়। এই আগ্রহের মধ্যে মিশে আছে ভবিষ্যৎ নিয়ে এক বিরাট অনিশ্চয়তাও। এই ‘নিউ নর্মাল’ নিশ্চিত ভাবেই একদম অন্য রকম। সেই কারণেই বিভিন্ন পরীক্ষা নিয়ামক পর্ষদগুলো যখন ঘোষণা করেছিল যে, ১ জুলাই থেকে অসমাপ্ত পরীক্ষা নেওয়া শুরু হবে, অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পারস্পরিক দূরত্ব যদি বাধ্যতামূলক ভাবে মানতেই হয়, তা হলে একটা পরীক্ষাকেন্দ্রে কয়েকশো পরীক্ষার্থীর জায়গা হবে কী ভাবে? একই রকম ভাবে, স্কুল খোলার পর সব পড়ুয়া একই সঙ্গে স্কুল করতে পারবে কি না, সে ব্যাপারেও আমরা খুব একটা নিশ্চিত নই। হয়তো স্কুলগুলো চলবে কয়েকটি শিফটে, পড়ুয়ারাও সপ্তাহের প্রতি দিন স্কুলে আসতে পারবে না। অনেক স্কুল ইতিমধ্যেই ‘ভার্চুয়াল’ শিক্ষাদান এবং গ্রহণের পথে পা বাড়িয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতেও এই ধারাই প্রচলিত হবে। পারস্পরিক সংযোগ এবং অনলাইন শিক্ষার এক চমৎকার মেলবন্ধন রচিত হয়েছে এই ধারায়।
আসল চাবিকাঠিটি হল, এক উপযুক্ত ভারসাম্যে আসা, যাতে শিক্ষাদান এবং জানার প্রক্রিয়াটি সাফল্যের সঙ্গে চলতে পারে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কোনও বড় ধরনের ঝুঁকি ছাড়াই।
এ বার ভবিষ্যতের স্কুলশিক্ষার খুঁটিনাটির দিকে তাকানো যাক। আমাদের যাতায়াতের কথা ভাবতে হবে, পড়ুয়াদের দেহের তাপমাত্রা মাপতে হবে, স্কুলে ঢোকার সময় তাদের হাত এবং জুতোকে স্যানিটাইজ় করতে হবে, স্কুলের মধ্যে তাদের ঘোরাফেরা, খাওয়া, আউটডোর অ্যাক্টিভিটির দিকে নজর রাখতে হবে— লম্বা তালিকা। তা ছাড়া, স্কুল খোলার গোড়ার দিকে অভিভাবকরা আদৌ কতটা ভরসা করে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবেন, সেই ব্যাপারেও সন্দেহ আছে। বেশির ভাগ স্কুল স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই অভিভাবকদের অতিরিক্ত উৎকণ্ঠার বিষয়টি ভাল ভাবে জানে। শীতের কলকাতায় তাপমাত্রার পারদ নামলেই তাঁরা ছেলেমেয়েকে মেরুপ্রদেশের পোশাক পরান, আর ডেঙ্গির মরশুমে অদ্ভুতদর্শন গা-ঢাকা জামাকাপড়। এই বার হয়তো তাঁরা সন্তানকে কোভিড হাসপাতালের চিকিৎসকদের মতো অতিমারি-রোধক পিপিই পরিয়ে পাঠাবেন।
এত ক্ষণ আলোচনা করলাম করোনা-উত্তর বিশ্বে শিক্ষাদান-গ্রহণের পদ্ধতি কেমন হতে চলেছে, তা নিয়ে। কিন্তু শিক্ষার আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক হল— স্কুলজীবন। কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না, বড় হয়ে ওঠার দিনগুলিতে নিজেদের বাড়ি আর স্কুল আমাদের কতটা প্রভাবিত করেছিল। স্কুলের মাঠে আমরা যে খেলতাম, বন্ধু বানাতাম, শিক্ষকদের কাছে বকুনি খেতাম, দুষ্টুমি করতাম, স্কুলের বিভিন্ন ফাংশন, ‘ফেস্ট’-এ অংশ নিতাম— সব কিছুই আমাদের গড়ে ওঠার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। এখন সেগুলোর কী হবে?
শিক্ষকরা আন্তরিক ভাবে চাইছেন সশরীরে তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উপস্থিত হতে, ল্যাপটপ স্ক্রিনে শুধুমাত্র তাদের মুখটা দেখতে নয়। ছোটদের হাসি, এমনকি অনর্গল বকবক, যার জন্য তাদের হামেশাই বকুনি খেতে হত, সেগুলোকে খুব ‘মিস’ করছেন শিক্ষকরা। স্বীকার করছি, শহরের ঝকঝকে নীল আকাশ আর পাখির কলতান সত্ত্বেও আমি নিজে এই ‘নিউ নর্মাল’-এর প্রতি বিন্দুমাত্র আকৃষ্ট হচ্ছি না। প্রথমত, সাধারণ বা ডিজ়াইনার মাস্কে ঢাকা শিশুমুখের ছবি মনে করলেই নিজেকে কেমন যেন অসুস্থ বোধ হচ্ছে। এখনও মনে আছে ক্লাসে আমার প্রথম চশমা পরে আসার দিনটির কথা। ছাত্রছাত্রীরা তুমুল চেঁচামেচি করে অনুরোধ করেছিল চশমা খুলে ফেলার জন্য। যখন জিজ্ঞাসা করলাম, কেন, “আপনাকে আরও কড়া মনে হচ্ছে” বা “আপনাকে এতে ভাল দেখাচ্ছে না” গোছের একটাও প্রত্যাশিত উত্তর পেলাম না। ওরা বলেছিল, “আপনি কী ভাবছেন, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না।” খুব অবাক হয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু বুঝেছিলাম ওরা কী বোঝাতে চাইছে। আজ, নিজেকে ঠিক সেই পড়ুয়াদের মতোই মনে হচ্ছে। শিশুমুখের অর্ধেকটাই যদি ঢাকা থাকে, তা হলে তার অনুভূতিগুলো পড়া বা তার মনের অবস্থা বা মুড বোঝা যাবে কী করে? শিশুদের পড়াতে হলে তাদের মনকেও বোঝা চাই।
যখনই আমি স্যানিটাইজ়ড ক্লাস, দূরে দূরে সরে থাকা শিশু, বিল্ডিংয়ের এক ভূতুড়ে, অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা, আলাদা বসে লাঞ্চ খাওয়া, আর পরিত্যক্ত খেলার মাঠটার কথা ভাবি, ভিতরে এক প্রচণ্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আর কি কখনও আমরা শিশুদের স্কুলজীবনের অভিজ্ঞতা ফিরিয়ে দিতে পারব? ফিরিয়ে দিতে পারব টিফিন ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ, বন্ধুর হাত ধরে হাঁটার খুশি, টান টান লড়াইয়ের টিম গেম-এর উত্তেজনা বা বই দেওয়া-নেওয়া? কেউ কি চাইবে এমন একটা পৃথিবীতে কাজ করে যেতে যেখানে কোনও স্বতঃস্ফূর্ততা নেই, যেখানে প্রত্যেকে একটা আতঙ্কের মধ্যে বেঁচে থাকে? মানুষের বেঁচে থাকতে হলে বন্ধুত্বের উষ্ণতার বড় প্রয়োজন।
লেখাটা যখন লিখছি, আশ্বস্ত হওয়ার মতো কিছু সঙ্কেত চোখে পড়ছে। কোভিড-১৯-এর সংখ্যাবৃদ্ধি সত্ত্বেও ভারতের অনেক জায়গা আবার খুলে দেওয়া হচ্ছে। জীবন ও জীবিকা নিয়ে আলোচনা বেশ কিছু কাল যাবৎই চলছে। এবং এটাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে যে, আর্থিক কারণেই আমাদের দেশকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে রাখা সম্ভব হবে না। তাই, আন্দাজ করছি এই ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের যতটা সম্ভব ভাল ভাবে বাঁচার উপায় শিখতে হবে। আর প্রার্থনা করতে হবে যেন দ্রুত বাজারে প্রতিষেধক এসে যায়।
মানব ইতিহাস জুড়ে দেখা গিয়েছে, যারা পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পেরেছে, তারাই শেষ পর্যন্ত টিকে গিয়েছে, উন্নতিও করেছে। তাই, স্কুলের অস্তিত্ব যত দিন থাকবে, তত দিন আমাদের শুধুমাত্র তাকে সুরক্ষিত রাখলেই চলবে না, একই সঙ্গে দেখতে হবে, শিক্ষার এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি যেন সদা আনন্দময় আর গতিশীল থাকে। তাই আমাদের স্লোগানটাকেও অবশ্যই পাল্টে নিতে হবে, “সাবধানে থাকো, বাড়িতে থাকো”-র বদলে “আনন্দে থাকো, সুস্থ থাকো”।
ডিরেক্টর, মডার্ন হাই স্কুল ফর গার্লস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy