ফাইল চিত্র।
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চমৎকার খেলে রানার্স হয়েছিল। ফাইনালে ঘরের মাঠে অজি মেয়েরা বাজিমাত করে। ভারত কিন্তু গ্রুপলিগে অজিদের হারিয়েছিল। মিতালি রাজের নেতৃত্বাধীন ভারতের মহিলা ক্রিকেট দল ২০১৭-র ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে রানার্স হয়েছিল। ২০১৮-র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের মেয়েরা সেমিফাইনালে উঠেছিলেন। তা ছাড়া, ২০০৫-এ ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের ফাইনালে মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামীদের লড়াই মন জিতেছিল। মিতালি-ঝুলনরা কিন্তু বিরাট-রোহিতদের মতো প্রচার, আর্থিক আনুকূল্য, স্পনসরশিপ পান না। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভারতীয় মেয়েরা সেরাটুকু দিচ্ছেন। তাঁরা বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সমীহ জাগানো শক্তি।
বর্তমানে ভারতীয় মেয়েদের ক্রিকেট সত্যিই শক্তপোক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে। এই মাঠ তৈরির কাজটা কিন্তু শুরু হয়েছিল প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে। সত্তরের দশক তখন সবে শুরু হয়েছে। শোভা পণ্ডিত, শান্তা রঙ্গস্বামীর মতো মহিলা ক্রিকেটাররা নিজেদের ক্রীড়াশৈলীকে ফুটিয়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ১৯৭৩ সালে পুণেতে মেয়েদের প্রথম আন্তঃরাজ্য ক্রিকেট প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় মুম্বই, মহারাষ্ট্র এবং উত্তরপ্রদেশ— মাত্র তিনটি দল অংশগ্রহণ করেছিল। পরিকাঠামো থেকে আর্থিক বিষয়— সব কিছুতেই মেয়েদের ক্রিকেট তখন চূড়ান্ত ‘রক্তাল্পতা’-য় আক্রান্ত। তবু ১৯৭৬-এ ভারতীয় মেয়েরা পটনাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে হারিয়ে প্রথম বার টেস্টে জয়লাভ করে চমকে দেন। এর পর শান্তা রঙ্গস্বামী ১৯৭৭ সালে নিউ জ়িল্যান্ডের ডুনেডিনে কিউয়িদের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করলেন। শান্তাই প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি টেস্টে শতরানের ইতিহাস গড়েন। তাঁদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ডায়ানা এডুলজি, শুভাঙ্গী কুলকার্নি, সুধা শাহের মতো প্রতিভাশালীরা ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করলেন।
তবু সমস্যা ছিলই। মহিলা ক্রিকেটারদের টুর্নামেন্ট খেলতে যেতে হলে প্রায়ই অসংরক্ষিত ট্রেনের কামরায় উঠতে হত। ভিড়ে যাতায়াত করতে করতে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে, অথচ সহ-খেলোয়াড়দের ট্রেনে তুলতে হবে— এই পরিস্থিতিতে রেল কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে তাঁদের কখনও ট্রেনের চেনও টানতে হত।
তখন মেয়ে-ক্রিকেটাররা ক’টাকাই বা পেতেন। বরং, অনেক সময়ই ক্রিকেট প্রশাসকদের তরফে ঔদাসীন্য জুটত বিনামূল্যেই। তবু ফোকাসটা নড়ে যায়নি। শান্তা, ডায়ানা বা শুভাঙ্গীরা লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন। তার পর মহিলা ক্রিকেটের আকাশে সন্ধ্যা আগরওয়াল, পূর্ণিমা রাও, অঞ্জু জৈন এবং অঞ্জুম চোপড়ার মতো নক্ষত্ররা উদিত হয়েছেন। ১৯৮৬ সালে বিলেতের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে সন্ধ্যার অনবদ্য ১৯০ রানের ইনিংস ভারতীয় ক্রিকেটকে দৃঢ়তা প্রদান করেছিল। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি নিউ জ়িল্যান্ডে ভারতীয় মেয়েদের ত্রিদেশীয় সিরিজ় জয়ও প্রশংসার দাবি রাখে। লোকজন যত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছে, মেয়েরা ততই অটল মনোভাব দেখিয়েছেন। ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ময়দানে ব্যাট হাতে আবির্ভূত হলেন মিতালি রাজ। ২০০২-এর আবির্ভাবেই ঝুলন গোস্বামী বল হাতে মাতিয়ে দিলেন। নদিয়ার চাকদহ থেকে যে (ঝুলন) এক্সপ্রেস ছোটা শুরু করেছিল, তা ২০২০-তেও আশ্চর্য গতিশীল।
বর্তমানে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটে হরমনপ্রীত কৌর, স্মৃতি মন্ধানা, পূজা বস্ত্রকর, শেফালি বর্মার মতো যে খেলোয়াড়রা উঠে এসেছেন, তাঁরা কিন্তু মিতালি এবং ঝুলনকে দেখেই অনুপ্রাণিত। পরিসংখ্যান বলছে, মিতালি এবং ঝুলন এক দিনের আন্তর্জাতিকে যথাক্রমে সর্বোচ্চ রান এবং সর্বোচ্চ উইকেটের অধিকারিণী। টি-টোয়েন্টি অধিনায়িকা হরমনপ্রীত কৌর বিশ্ব ক্রিকেটের এক অপার বিস্ময়। এমন ‘ক্লিন স্ট্রাইকার’ বিরল। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে তাঁর ১১৫ বলে অপরাজিত ১৭১ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস হট ফেভারিট অস্ট্রেলিয়াকেই ছিটকে দিয়েছিল। ওই ইনিংস ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট লোকগাথার অংশ।
প্রতিভায় ঘাটতি নেই। তবু ঝুলন-হরমনপ্রীতরা কয়েক বার ফাইনালে উঠলেও বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। আসলে ফাইনালে, বিশেষত ‘মোমেন্ট অব ট্রুথ’-এ বাজিমাত করতে গেলে মনকে ইস্পাত-কঠিন করতে হবে। ‘মানসিক দৃঢ়তা’ নামক ভান্ডার থেকেই নকআউট পাঞ্চ মারার শক্তি আহরণ করতে হয়। কামড় দেওয়ার এই সময়টা রীতিমতো কঠিন। ক্রীড়া-মনোবিদ প্রিয়ঙ্কা প্রভাকর, সৌম্যা অবস্থি এবং কোভিড মনোবিদরা ভারতীয় মহিলা হকি দলকে সাফল্য পেতে সাহায্য করেছেন। মহিলা ক্রিকেট দলেও মনোবিদ নিযুক্ত করা উচিত। উপযুক্ত পরিকাঠামো, তৃণমূল স্তর পর্যন্ত প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক আনুকূল্য পেলে মেয়েরা সাফল্যের মাউন্ট এভারেস্ট নিশ্চিত স্পর্শ করতে পারবেন।
মেয়েদের জন্য আইপিএল আয়োজন করতে পারলেও অনেকেই আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ হবেন। অনেকেই ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে বেছে নেবেন। প্রতিভাময়ী নতুন খেলোয়াড়রা উঠে আসবেন। ইতিমধ্যেই আশার আলো দেখা গিয়েছে। এ বারও মহিলাদের টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হবে, নভেম্বর মাসে।আর দরকার, আমাদের অর্থাৎ ক্রিকেটানুরাগীদের দৃষ্টিভঙ্গির বদল। বিরাটদের মতোই হরমনপ্রীতরা দেশের জন্য নিজেদের নিংড়ে দেন। যেমন বিরাট-রোহিতদের জন্য গলা ফাটাই, তেমনই মিতালি-হরমনপ্রীতদেরও স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জোগাতে হবে। তাঁদেরও প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দেওয়া জরুরি। না হলে যে আমরা নিজেদেরই অসম্মানিত করে ফেলব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy