Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
এত দিনের পরিচিত গণতন্ত্রের রাজনীতির এক বিপুল পরিবর্তন ঘটছে

স্বার্থচিন্তা ছেড়ে এ বার ঘৃণা

বামপন্থী রাজনীতি শ্রেণিস্বার্থের কথা বলে। অন্য দিকে পরিচয়ের রাজনীতি প্রায়শই একটি কৌমস্বার্থ রক্ষা করতে চায়।

বৈদিক ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

আধুনিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা পরিচিতির পিছনে কাজ করে সুনির্দিষ্ট স্বার্থচিন্তা। স্বার্থ বা স্বার্থচিন্তা বলতে স্বভাবতই যে নেতিবাচক ভাবনাটি মাথায় আসে, বা যে অর্থে শব্দগুলো রোজকার জীবনে ব্যবহার হয়, সেই অর্থ এখানে প্রযোজ্য নয়। এখানে সদর্থেই স্বার্থচিন্তা ব্যবহৃত— ব্যক্তি বা সমষ্টির স্বার্থ পূরণের জন্য যে রাজনীতি, তা বোঝাতে। গণতন্ত্রের একটি মূল ভিত্তি হল এই সদর্থক স্বার্থসাধনা, বা বিভিন্ন স্বার্থ আর তার বহুবিধ সমন্বয়। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয় নির্বাচনের সময়। ধরেই নেওয়া হয় যে ভোট দেওয়ার সময় যে কোনও নাগরিক প্রথমেই ভেবে দেখবেন কিসে তাঁর ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত স্বার্থসিদ্ধি হয়, আর তার পর যে প্রার্থী সেই স্বার্থপূরণের সবচেয়ে বেশি আশ্বাস দেবেন তাঁকে নিজের মূল্যবান ভোটটি দেবেন। এই স্বার্থচিন্তার পিছনে দলীয় পরিচিতি থাকতে পারে, কৌম বা শ্রেণিগত স্বার্থচিন্তা থাকতে পারে, বা যাকে আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা পরিচয়ের রাজনীতি বলা হয়, তাও থাকতে পারে। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই স্বার্থের প্রাথমিক শর্তটি অস্বীকৃত হয় না, বা স্বার্থচিন্তা অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে পড়ে না।

বামপন্থী রাজনীতি শ্রেণিস্বার্থের কথা বলে। অন্য দিকে পরিচয়ের রাজনীতি প্রায়শই একটি কৌমস্বার্থ রক্ষা করতে চায়। যে ভাবেই দেখা হোক না কেন, এই স্বার্থের কাঠামোটি আছে বলেই রাজনীতির একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা হয়। ভোটের আগে রাজনৈতিক দল বা পণ্ডিতরা যে ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে অমুক জনগোষ্ঠী বা ব্যক্তি অমুক দলকে ভোট দেবেন বা তমুক প্রার্থী এই অঞ্চল থেকে জিততে পারেন, তার মূলে রয়েছে এই স্বার্থের অঙ্ক। এক দিকে একটি দল বা প্রার্থী এবং তাদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি, আর অন্য দিকে ভোটারদের স্বার্থ— ধরেই নেওয়া হয় যে এই দুয়ের মেলবন্ধন হবে ইভিএম মেশিনে। আমাদের দেশে অঞ্চলগত, জাতিগত, শ্রেণিগত, ভাষাভিত্তিক বা আরও নানা স্বার্থচিন্তার অনেকগুলো চেহারা রাজনীতির এই ধারণাকে পুষ্ট করে এসেছে ঐতিহাসিক ভাবে।

অথচ সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে কিন্তু এই স্বার্থভাবনা একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। একটা ছোট উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ভাবা যাক। সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের যাদব পরিচিতিভিত্তিক দুটো দল, অর্থাৎ মুলায়ম-অখিলেশের বিএসপি এবং লালুপ্রসাদের আরজেডি, প্রায় ধুয়েমুছে গিয়েছে। প্রাক্‌নির্বাচনী ইস্তাহারে এই দুটো দলই যাদবদের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বা যাদব প্রার্থীদের নির্বাচনের টিকিট দিয়েছিল। তাতে বিশেষ লাভ হয়নি, যাদবরা এঁদের ভোট দেননি। কিন্তু এই নির্বাচনেই ওই একই অঞ্চল থেকে বিজেপির হয়ে প্রায় চল্লিশ জনের বেশি যাদব প্রার্থী ভোটে জিতে লোকসভায় গিয়েছেন। মনে রাখা দরকার যে বিজেপি কিন্তু যাদবদের জন্য আলাদা কোনও প্রতিশ্রুতি সে ভাবে দেয়নি, বা ঐতিহাসিক ভাবে বিজেপি যাদবদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বলেও পরিচিত নয়। পাঁচ বছর আগের লোকসভা নির্বাচনেও ছবিটা মোটামুটি একই ছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে উত্তর ভারতের যাদব ভোটারদের একটা বড় অংশ কি তা হলে আর তাঁদের স্বার্থচিন্তা করছেন না? তাঁরা কি আর জনপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সময় নিজেদের জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের অগ্রাধিকার দিচ্ছেন না? না কি তাঁরা ভাবছেন তাঁদের জনগোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতির বাইরের দল বলে পরিচিত বিজেপিই তাঁদের স্বার্থরক্ষায় সহায় হবে?

প্রশ্নটা স্বভাবতই শুধু যাদবদের নিয়ে নয়। নির্বাচনোত্তর বিভিন্ন সমীক্ষায় বার বার উঠে এসেছে যে এমন অনেক ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী বা দল এ বারে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন যাঁদের সঙ্গে আপাত ভাবে বিজেপির ঘোষিত রাজনৈতিক স্বার্থের কোনও মিল তো নেই-ই, বরং সরাসরি বিরোধ আছে। দলিত বা অতি-দলিত সম্প্রদায়ের একটি বাহ্মণ্যবাদী দলকে ভোট দেওয়া বা পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের একটি অতি-দক্ষিণ দলকে সমর্থন জানানো, তালিকাটি সত্যিই দীর্ঘ এবং চমকপ্রদ। এর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে জিনিসটি সবার আগে চোখে পড়ে,

তা হল চিরাচরিত স্বার্থচিন্তার বাইরের এক নতুন রাজনীতি, যার চেহারা বা চরিত্র নিয়ে এখনও কোনও সম্যক আলোচনা হয়নি, আর তাই তার ভবিষ্যৎও কিছুটা অনির্দিষ্ট।

একটু ঘুরিয়ে বললে, সাম্প্রতিক কিছু নির্বাচনে এমন একটা ইঙ্গিত উঠে আসছে— যে যে ভাবে, বা যে যে কাঠামোর মধ্য দিয়ে, আমরা আধুনিক রাজনৈতিক পরিচিতি বা পরিকল্পনা বুঝি বা বোঝাতে পারি, তার বাইরে এমন একটা কিছু ঘটছে, যার জন্য আমাদের পরিচিত রাজনৈতিক ধারণাগুলো যথেষ্ট নয়। সে ক্ষেত্রে আমরা যে শুধু একটা অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, শুধু তা-ই নয়, সম্ভবত আমরা আমাদের চেনা অর্থের রাজনীতির মৃত্যুও প্রত্যক্ষ করছি।

এই নতুন রাজনীতির ভরকেন্দ্রটি স্বার্থ থেকে সরে গিয়েছে ঘৃণায়। বহু দিন অবধি মনে করা হত, হিন্দুত্ব রাজনীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিন্দুধর্মেরই ভিতরের একটি কাঠামো, যাকে অম্বেডকর হিন্দুধর্মের প্রাক্শর্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ বহু শতাব্দী ধরে চলে-আসা জাত-ব্যবস্থা। এই জাত-ব্যবস্থা (কাস্ট এবং বর্ণ, দুই অর্থেই) হিন্দুধর্মের কদর্য গুণলক্ষণ, আবার এই শতধা বিভক্ত হিন্দুসমাজই আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী হিন্দুত্বের সবচেয়ে বড় শত্রু। এই ধারণা সম্পূর্ণ অলীক ছিল না। নিকট অতীতের অনেক নির্বাচনেই উত্তর ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল জাতিসত্তা-ভিত্তিক রাজনৈতিক পরিচিতি। এই রাজনৈতিক কৌশলের মূলে ছিল পূর্ববর্ণিত স্বার্থচিন্তা, যা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নিজের নিজের রাজনৈতিক পরিচিতি তৈরি করতে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে সেই ধারণাটি ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র ঘৃণাকে সম্বল করে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি সত্যিই এমন একটি প্রকল্পের জন্ম দিতে পেরেছে, যেখানে জাত-ব্যবস্থার শিকার যাঁরা, তাঁরাও নিজেদের হিন্দু ভেবে নিয়েছেন।

গত কয়েক বছর ধরে, এবং বিশেষত নির্বাচনের প্রাক্কালে, এই অখণ্ড হিন্দুত্বের বয়ানটি বোনা হয়েছে একটিই মাত্র চরিত্রকে প্রতিপক্ষ হিসেবে কল্পনা করে— দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে দেশের মুসলিম জনসমাজ। শুধুই ধর্মপরিচয়ে মুসলমান হওয়াকেই অবৈধ বা ঘৃণ্য বলে প্রমাণের একটা রাজনৈতিক প্রকল্প আমাদের চার পাশে গজিয়ে উঠে ডালপালা মেলে প্রায় পুরো আকাশটাকেই ঢেকে ফেলার মতলব করছে। এই তথাকথিত অবৈধ পরিচিতির বিরুদ্ধে এমন একটি সংখ্যাগুরুকে কল্পনা করা হচ্ছে, যা কোনও স্বার্থচিন্তা নয়, বরং ঘৃণা দিয়ে তৈরি। যে বেকার তরুণ বা তরুণীটি চাকরি পাননি, যে চাষি ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করবেন ভাবছেন, যে দলিতেরা প্রত্যহ জাতপাতের জাঁতাকলে চাপা পড়ছেন, বা যে সব ছোট ব্যবসায়ীর নোটবন্দির ফলে ঘটিবাটি চাটি হয়েছে, তাঁদের একটা বড় অংশ নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সোৎসাহে এই ঘৃণার জোয়ারে ভাসতে শুরু করেছেন। এবং ভাসতে ভাসতে নিজেদের সংখ্যাগুরুত্বকেই একমাত্র সত্যি বলে ভেবে নিয়েছেন। অন্য সব পরিচয় বা স্বার্থ এই প্রবল ঘৃণার কাছে হেরে ভূত হয়ে গিয়েছে।

এখানেই এই নতুন রাজনৈতিক ভাষা নিয়ে কিছু প্রশ্নের জন্ম হয়। স্বার্থ যে অর্থে একটি রাজনৈতিক তাগিদ, স্বার্থবর্জিত ঘৃণা কি সেই অর্থে একটি রাজনৈতিক আবেগ? স্বার্থচেতনা যে ভাবে গণতন্ত্রের হাতিয়ার, অন্ধ ঘৃণাও কি তা-ই? বা আদৌ তা কি হতে পারে? যে নতুন রাজনীতি গত কয়েক বছরে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে গণতন্ত্রের এই সঙ্কট নিয়ে না ভেবে আর উপায় নেই।

নয়াদিল্লিতে সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজ়-এ শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

অন্য বিষয়গুলি:

Democracy Politics Indian Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy