আধুনিকতা গিলে খেয়েছে আমাদের পুরনো ঐতিহ্যকে।
বর্ষার শেষ হতেই বাজার জুড়ে থাকত জলাশয়ে জন্মানো শোলা। আমাদের শৈশবে দেখেছি, এই শোলা কিনে নিয়ে যেতেন গ্রামীণ শোলা শিল্পীরা। তার পরে সেটি দিয়ে প্রতিমার নানা উপকরণ তৈরি করে বিক্রি করতেন। উত্তরবঙ্গের নানা প্রান্তে বসবাসকারী এই শোলা শিল্পীদের জীবিকার অনেকটাই এই প্রতিমার শোলার তৈরি সাজসজ্জার জিনিসপত্র বিক্রি করে আসত। কেউ কেউ আংশিক সময়ে এই কাজ করতেন আবার কেউ পূর্ণ সময়ের শিল্পী ছিলেন।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে আমন ধান রোপণের পর যে সময়টা তাঁরা হাতে পেতেন, সেই সময়ে এই শোলা বাজার থেকে কিনে এনে তৈরি করতেন শোলার নানা রকম সাজ। এই সময়ে এই কাজ করে তাঁরা বাড়তি পয়সা রোজগার করতে পারতেন।
দশমীর দিন যাত্রার সময় বাড়িতে যে কদমফুল টাঙানো হয়, তা এই শোলা দিয়েই তৈরি। ছোটবেলায় ষষ্টির দিনই বাজারে যখন এই ফুল দেখতে পেতাম, মনটা খারাপ হয়ে যেত। কেননা, এই তো চারটি দিন পরেই মায়ের বিসর্জন! আর সেই শোলার কদমফুল বাড়ির দরজায়, ঠাকুরঘরে, তুলসীপাটে।
আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বেরিয়ে গিয়েছে মেশিনে তৈরি প্রতিমা সজ্জার অলঙ্কার। প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রতিমার মালা, চূড়া এবং যাবতীয় সজ্জার অলঙ্কার। বাজার ছেয়ে গিয়েছে সে সব আধুনিক অলঙ্কারে।
উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জলপাইগুড়ি এবং দুই দিনাজপুরে এই শোলা শিল্পীরা থাকেন। তবে এই শিল্পের মন্দা অবস্থায় অনেকেই এখন অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন রুটিরুজির তাগিদে। যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা অন্য কাজের ফাঁকে এই শোলার কাজ করেন।
কথা হচ্ছিল কোচবিহার জেলার ভেটাগুড়ি অঞ্চলের রতন দাসের সঙ্গে। তিনি জানালেন, এখন আর শোলার কাজের বাজার নেই। অথচ এই অঞ্চলেই এক সময় জীবিকার একটা বড় অংশ ছিল এই শোলা শিল্প। তাঁর কথায় অভিযোগের সুর পাওয়া গেল। এই শিল্পের জন্য কোনও সরকারি সাহায্য মেলে না। এমনকি, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ চাইতে গেলেও অনেক কথা চলে আসে। শুধু রতন দাসও নন, তাঁর মতো বহু শোলা শিল্পীরই এই একই কথা।
এই শোলা জলাশয়ে হয়। মূলত বর্ষাকালে এই শোলা জলাশয় থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো শুকিয়ে তারপর কাজে লাগে। কিন্তু এখন গ্রামের অধিকাংশ জলাশয়ই আর আগের মতো জলের আধার নয়, ফলে সেই জলাশয়গুলোয় শোলাও উৎপন্ন হয় না তেমন। আগে জলপাইগুড়ির বেরুবাড়ি হাট, দোমোহনী হাটে এই পুজো মরসুমে শোলা উঠত, কিন্তু আজ আর সে সব হাটে শোলা ওঠে না। ফলে, যে দু’চার জন এই কাজ করেন, তাঁদের শোলা সংগ্রহ করে এনে কাজ করতে হয়। এতে সময় লাগে এবং ঝামেলা পোয়াতে হয়। একে তো এই শিল্পের বাজার নেই, তার উপর এত কষ্ট করে দ্রব্য বানিয়ে উপযুক্ত মূল্য মেলে না।
পাশের রাজ্য বিহারে এই শোলা বেশি জন্মায়, কিন্তু এই রাজ্যে শোলার তৈরি অলঙ্কারের চাহিদা আগের মতো না থাকায় আমদানি করতে সাহস পান না শোলা শিল্পীরা। অন্য শিল্পের জন্য রাজ্য সরকার ভাবনাচিন্তা করলেও এই শিল্প নিয়ে কোনও হেলদোল যে নেই, তা শোলা শিল্পীদের অবস্থাই বলে দেয়। আমাদের সংস্কৃতির এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে গেলে সরকারি সাহায্য জরুরি। কেননা, এই শোলা শিল্প প্রাচীন বঙ্গসংস্কৃতির এক অনন্য ধারা। এক সময় আমাদের এই বঙ্গদেশের প্রায় সব রকম আচার অনুষ্ঠানেই শোলার ব্যবহার ছিল। সারা বছর শিল্পীরা ব্যস্ত থাকতেন তাঁদের এই শোলা শিল্পের কাজে। এই কাজ করেই একেকটি পরিবার চলত অনায়াসে। কিন্তু আজ এই শিল্পের চরম দুর্দশা। তাই শিল্পীরা তাঁদের নিজের নিজের পেশা ছেড়ে অন্য নানা পেশায় যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ঠিকই, কিন্তু প্রতিযোগিতার ভরা বাজারে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠছেন না । কৃত্রিম সাজসজ্জার উপকরণ বাজারে ছেয়ে গিয়েছে। আধুনিকতা গিলে খেয়েছে আমাদের পুরনো ঐতিহ্যকে।
তবু পুজো আসে। একরাশ প্রত্যাশা জাগে বুকে। কৃত্রিম সাজের অলঙ্কারের পাশে অল্প হলেও শোভা পায় শোলার তৈরি সাজও। কেননা, এখনও প্রতিমার ডাকের সাজ করতে লাগে শোলার তৈরি অলঙ্কার। কিন্তু ডাকের সাজের প্রতিমার খরচ বেশি হওয়ায় পুজোর উদ্যোক্তারাও আগ্রহ হারাচ্ছেন। হতাশা এলেও কেউ কেউ বাঁচিয়ে রেখেছেন এই শিল্পকে ভালবাসার টানে। যদি দিন ফেরে, সেই আশায়।
পড়ে রয়েছে ছোটবেলার স্মৃতিও। সে স্মৃতিতে ধরা রয়েছে ভরভরন্ত আশ্বিন। মাথার উপর উজ্জ্বল ঝকঝকে নীল আকাশ আর নীচে টলটলে জলাশয়। নদীর জল বইছে পাড় পর্যন্ত। তখনই আসত মহালয়া। আর তার পরে নানা জায়গায় দুর্গা প্রতিমা সেজে উঠতেন শোলার কাজ করা অলঙ্কারে। এক এক করে ফিরতেন প্রবাসে থাকা মানুষজন। চারিদিকে বইত খুশির হাওয়া। সে দিন গিয়েছে। অনেকটা বদলে গিয়েছে উৎসবের ছবিটাও।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy