Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
India Lockdown

ওরা না বাঁচলে, বাঁচব না আমরাও

খবর রাখতে হবে সরকারি হাসপাতালের অবস্থা কেমন, স্বাস্থ্যের জন্য খরচ বাড়ছে কি না, সরকারি শিক্ষার কী হাল, শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন কী হল, তাদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থাটুকু হল কি না। তবেই যদি আমাদের এই সাময়িক ‘আনন্দ’ একটু স্থায়ী হয়, আর ভবিষ্যৎ পৃথিবী শুধু শিশুদের নয়, সকলের বাসযোগ্য হয়। অনেকে যাঁরা নিত্যদিন অন্য পার্টির নেতানেত্রীদের গালাগাল দিতেন, তাঁরা এখন রাজনীতি করবেন না বলে, কাউকে না পেয়ে, নোবেল প্রাপকদের গালাগাল দিয়ে সাধ মেটাচ্ছেন। 

বাড়ির পথে। ছবি: পিটিআই

বাড়ির পথে। ছবি: পিটিআই

গোপা সামন্ত
শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০২০ ০৬:২৬
Share: Save:

করোনা সংক্রান্ত ভয় ও দুঃখের মধ্যেও আমরা এক রকম আশায় আছি। ভাবছি প্রকৃতি একটু সেরে উঠছে। সে আমাদের শেখাল কী কী করা চলবে না। এত সম্পদ ধ্বংস করা যাবে না, শুধু আমাদের আরও চাই এর খিদে মেটাতে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বালির বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে সারা পৃথিবী জুড়ে। আমরা ভাবছি বোধ হয়, বাজার অর্থনীতির দিন গেল। তা হলে, এ বার সব দেশের সরকারই হয়তো বা একটু বাজার ছেড়ে মানুষের কথা ভাববে। দিনের পর দিন আমেরিকা, ব্রিটেন থেকে ভারতবর্ষ— বেশির ভাগ দেশই সরকারি স্বাস্থ্যকে শিকেয় তুলে কর্পোরেট হাসপাতাল আর কর্পোরেট বিমার বাড়বাড়ন্ত করেছে। এখন তো উচ্চ ও মধ্যবিত্ত লোকজন, যাঁরা কোনও দিন ভাবেননি, তাঁদের সরকারি হাসপাতালে যেতে হবে, তাঁরাও চিন্তায় পড়েছেন, গরিবদের হাসপাতালে তাঁরা যান কী ভাবে! আর সে জন্যই তো লুকিয়ে থাকা বা পালিয়ে বেড়ানো। এখন যখন আমাদের যেতেই হচ্ছে তা হলে, নিশ্চয়ই পরের বার থেকে বাজেটে খেয়াল রাখব স্বাস্থ্য খাতে সরকার টাকা বাড়াচ্ছে কি না, নতুন নতুন হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে কি না, হাসপাতালে পর্যাপ্ত ডাক্তার ও যন্ত্রপাতি এল কি না, ওষুধের দাম আকাশছোঁয়া হচ্ছে কি না।

ঠিক এ ভাবেই নোটবন্দির সময় আমরা তিন ঘণ্টার লাইনে দাঁড়িয়েও আনন্দ পেয়েছিলাম। কারণ, প্রতি দিন বেশ কিছু ভুয়ো খবর তৈরি করে আমাদের দেখানো হত বড়লোকেরা কেমন জব্দ হয়েছেন। ভেবেছিলাম দুর্নীতি চলে গেল দেশ থেকে। কিন্তু গেল কি! কয়েক হাজার কোটি টাকা দিয়ে যখন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি কেনা হয় (যার আবার কথিত নাম ‘ঘোড়া কেনা’), তখন নিশ্চয়ই সে টাকা ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে যায় না! আমরা কি ভেবেছি তা হলে কী লাভ হল আমাদের! না, কারণ, আমরা ভুলে গিয়েছি। ঠিক তেমনই এই কঠিন সময়েও আমরা আনন্দে আছি, কারণ, কিছু শত্রু খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট দাঁড় করিয়েছেন চিনা ভাইরাসকে। তিনি এক বারও উল্লেখ করছেন না, সে দেশের ২৭ কোটি ৫ লক্ষ (জনসংখ্যার ৮.৫ শতাংশ) লোকের চিকিৎসা বিমা নেই, তাঁদের কী হবে? আমরা চিন ছাড়াও এ দেশে পেয়েছি, যাঁরা বিদেশে গিয়েছিলেন আর সেই গরিবেরা যাঁরা অন্য রাজ্য থেকে ফিরে এসেছেন তাঁদের। বিলেত ফেরত নিয়ে মজা করতে গিয়ে প্যারিস আর লন্ডনের বিপরীতে অপমান করার জন্য খুঁজে পেয়েছি বাঁকুড়া, হাওড়া কিংবা চন্দননগরকে। আর ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঘরের ভিতরে বসে থাকলেও, তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছি শাস্তি দেওয়ার জন্য। নেহাত এখন তাদের ছোঁয়া যাবে না, তাই তাঁরা প্রাণে বাঁচছেন। অনেকে যাঁরা নিত্যদিন অন্য পার্টির নেতানেত্রীদের গালাগাল দিতেন, তাঁরা এখন রাজনীতি করবেন না বলে, কাউকে না পেয়ে, নোবেল প্রাপকদের গালাগাল দিয়ে সাধ মেটাচ্ছেন।

অথচ তাঁরাই যদি একটু পড়াশোনা বা খোঁজখবর রাখতেন, তা হলে জানতে পারতেন যে নোবেল প্রাপক মানুষগুলিই বহুদিন ধরে বার বার বলছিলেন এ কথা। একটি দেশের সরকার কখনও সরকারি স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থাকে এ ভাবে ‘নষ্ট’ করে দায়িত্বটা বেসরকারি হাতে তুলে দিতে পারে না। এই দু’টি ক্ষেত্রই হল একটা জাতির বা দেশের আসল ভবিষ্যৎ। ডাক্তার দেবী শেঠী সে দিন এক আলোচনায় বলছিলেন, আমাদের দেশের ডাক্তারি শিক্ষাব্যবস্থাটা ‘এলিটিস্ট’ হয়ে গিয়েছে। গরিব ছেলেমেয়েরা আর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে না, অথচ তাঁরাই না কি সবচেয়ে পরিশ্রমী ও ভাল ডাক্তার হতে পারতেন। কেন হতে দিলাম আমরা সেটা? আমরা ঠিক সময়ে সেই প্রশ্নগুলি তুলিনি কেন? আসলে তখন কি আর জানতাম যে করোনা আসবে আর আমাদের সরকারি হাসপাতালে যেতে হবে। গরিবের চিকিৎসার দায়িত্বটুকুও সরকার হাত থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছে বিমার সাহায্য নিয়ে। অথচ তার ঠিক উল্টোদিকেই রয়েছে জার্মানি, ভিয়েতনাম, কোরিয়া আর স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলি। যাঁরা কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নষ্ট করেনি আমাদের মতো, তাই তারা এই দুর্দিনেও বেশ সামলে নিতে পেরেছে তাড়াতাড়ি।

ঠিক একই ভাবে গবেষক ও কিছু মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ বলে আসছিলেন, এই হতদরিদ্র ঘরছাড়া স্থানান্তরী শ্রমিকদের কথা, যাঁদের পরিবার বাঁচাতে এক রাজ্য থেকে পাড়ি দিয়ে (পড়ুন ট্রেনের সাধারণ বগিতে গাদাগাদি করে বসে) যেতে হয় অন্য রাজ্যে। থাকতে হয় অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি জায়গায়, এক বেলা খাবার না খেয়ে পয়সাটা জমিয়ে নিতে পারলে বাড়িতে পাঠানো যায় সামান্য বেশি টাকা। তাঁরা যে রাজ্যে থাকেন, সেখানে তাঁদের কোনওরকম সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করেনি সরকার। তাঁরা সে রাজ্যের বাসিন্দা নন। তাঁদের না আছে সেই রাজ্যে চিকিৎসার সুযোগ, না আছে রেশনের খাবারের যোগান। কেন এমন হবে! তাঁরা তো কাঁটাতার পেরিয়ে যাননি কোথাও! একটি দেশের মধ্যেই তো থেকে গিয়েছেন, এ-দিক থেকে ও-দিক, পেটের টানে। অসুস্থ হয়ে কয়েক দিন পড়ে থাকলে খেতে পাবেন না, তা তাঁরা জানেন। প্রতি বারই ফিরে এসেছেন একই ভাবে, বহু কষ্টে অসুস্থ শরীরে ট্রেনের মেঝেতে বসে। তাঁরা কী ভাবে ভরসা করে থেকে যেতে চাইবেন এই দুর্দিনে স্বজনহীন দেশে। তাঁরা জীবন দিয়ে জানেন, যে রাজ্যে তাঁরা থাকেন সেটা তাঁদের নয়। কাজ ফুরলে তাঁরা কেবলই ‘পাজি’। তাই তাঁরা আজ রাস্তায় দলে দলে হাঁটছেন। তাঁরা তো আর সামাজিক গণমাধ্যমে ঝড় তোলা বা কষ্টের ভিডিও পোষ্ট করা শিক্ষিত বড়লোক নাগরিক নন, যে তাঁদের বিমানে চড়িয়ে ফিরিয়ে আনা হবে! নিদেন পক্ষে বাস বা ট্রেনে করে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কি করে দিতে পারত না সরকার, লকডাউন ঘোষণা করার আগে! না, আসলে তাঁরা গরিব। তাঁদের কথা কেবল ভোটের সময় একটু ভাবতে হয়। তাঁদের অনেকে হয়ত আবার ‘নাগরিক’ পদবাচ্যও নন। তা প্রমাণ করে দেবে সরকার ক’দিন পরেই এনআরসি করে। এগুলিও আমরা ভুলেই যাব করোনার একাকিত্ব কেটে গেলেই। আমরা আবার ব্যস্ত হয়ে যাব নানা কাজে ও নানা ‘অকাজে’। সময় পাব না দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ঘরছাড়া অসহায় গরিবের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান বা আর পাঁচটা সামাজিক সুরক্ষার কথা ভাবার।

তাই এখন আমরা যাঁরা ভাবছি যে করোনা সাম্য নিয়ে আসবে তাঁরা হয়তো বা ভুলই ভাবছি। আবার হয়তো দেশে দেশে বাজারের হাত ধরে গড়ে উঠবে অসাম্যের পাহাড়, আর আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে যাব। অথবা আবার মেতে উঠব হিন্দু-মুসলমান, স্বদেশি-বহিরাগত, নাগরিক-অনাগরিক, ভারত-পাকিস্তান নিয়ে। আর সরকার বাহাদুর অর্থনীতি বাঁচাতে পয়সা ঢালবেন কর্পোরেট সেক্টরে। না, সেটা করলে আমাদের স্বপ্নগুলি অধরাই থেকে যাবে। আমরা ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না, আমরা এই সঙ্কটের কথা ভুলে গেলে আর চলবে না। কারণ বিজ্ঞানীরা তো আবার বলছেন, এটাই শেষ নয়, এটা নাকি শেষের শুরু। তাই আমাদের আর শুধু নিজেদের কথা ভাবলে হবে না। করোনা আমাদের বুঝিয়ে ছেড়েছে ওরা না বাঁচলে, আমরাও বাঁচব না। আমাদের সজাগ থেকে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যেতে হবে। আগে হয়তো যেটুকু করতাম তা ছিল মানবিকতার খাতিরে, আর এখন সেটাই করে যেতে হবে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে। খবর রাখতে হবে সরকারি হাসপাতালের অবস্থা কেমন, স্বাস্থ্যের জন্য খরচ বাড়ছে কি না, সরকারি শিক্ষার কী হাল, শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন কী হল, তাদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থাটুকু হল কি না। তবেই যদি আমাদের এই সাময়িক আশা একটু স্থায়ী হয়, আর ভবিষ্যৎ পৃথিবী শুধু শিশুদের নয়, সকলের বাসযোগ্য হয়!

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

India Lockdown Migrant Labourers Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy