স্যর সি ভি রমন বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তাঁর ছাত্র কে এস কৃষ্ণণের সঙ্গে যখন কলকাতায় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, ভবিষ্যতে যে কাজের জন্য তিনি নোবেল পাবেন, তখন সেই কাজের কথা কলকাতায় খুব কম লোকই জানতেন। বেশি লোককে যে জানানোর দরকার আছে, সেটা ওঁদের মনে হয়নি। তখনকার দিনে, এখনকার মতো যোগাযোগ ছিল না। এখন আমরা ইন্টারনেটের দয়ায় এক মুহূর্তে জানি জেনিভার সার্ন-এ কী হচ্ছে। মুখোমুখি দেখা না হলেও বৈজ্ঞানিকদের এখন একটা নতুন জগৎজোড়া সংসার গড়ে উঠেছে। আমার কোনও কাজ সম্বন্ধে অন্যদের মতামত জানতে তাঁদের কাছে ছুটে যেতে হবে না, ঘরে বসেই কম্পিউটারের মাধ্যমে কথা বলা যেতে পারে। তাঁদের সঙ্গে আমার গবেষণার ফল অনায়াসে মিলিয়ে নিতে পারি।
কিন্তু অনেক যখন একসঙ্গে একটি বিরাট আকারের ‘অ্যাক্সেলারেটর’ মেশিন ব্যবহার করে মৌলিক গবেষণা করেন তখন ব্যাপারটা একটা অন্য আকার নেয়। আমার অভিজ্ঞতা থেকে দুটি উদাহরণ দেব। একটা হল জেনিভায় সার্ন গবেষণা কেন্দ্র, আর একটি হল ‘ফেয়ার’ গবেষণাগার, জার্মানিতে।
শুরুর দিকে ইউরোপের দেশগুলিই সার্ন-এর সদস্য হতে পারত। আমরা যারা ভারতীয়, তারা কেবল বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকতাম। এই যুক্ত থাকার ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এর কর্ণধার পি কে মলহোত্র’র উদ্যোগে। পরে কলকাতার ভিইসিসি-র নেতৃত্বে জয়পুর, মুম্বই, সাহা ইনস্টিটিউট, ভুবনেশ্বরের ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স এবং আরও অনেকে এই পরীক্ষায় যোগ দেয়।
১৯৯০-এর দশকে সার্ন-এর জন্য আমরা ভারতীয়রা একটা বড় ডিটেক্টর বানিয়েছিলাম। ছেলেরা খুব মেতে ছিল। আমাদের ডিটেক্টরের নাম ছিল ফোটন মাল্টিপ্লিসিটি ডিটেক্টর। শুরু থেকে চূড়ান্ত রূপদান আমরাই করেছিলাম। এই উদ্যোগ অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছিল। গোটা ইউরোপের উন্নত দেশগুলি, আমেরিকা, জাপান, আরও কিছু দেশের বৈজ্ঞানিকেরা যুক্ত ছিলেন। এই ডিটেক্টরটিই পরে ‘অ্যালিস’ ডিটেক্টরে রূপায়িত হয় সার্ন-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে। এর সঙ্গেই সাহা ইনস্টিটিউটের ‘ম্যুওন’ ডিটেক্টর তৈরি হয়েছিল। আর তারই সঙ্গে ছিল ‘মানস’ ডিটেক্টর। ভারতে যে এমন একটা ডিটেক্টর হতে পারে, আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। এক জন অধ্যাপক খুব উত্তেজিত হয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার মধ্যে যে এই মেধা ছিল আমি কোনও দিন ভাবিনি।’
এর বেশি আর বিজ্ঞানের কচকচিতে যেতে চাই না। কিন্তু একটা ব্যাপার দেখুন— সারা পৃথিবীর লোক একসঙ্গে সার্ন-এ কাজ করেন, তাঁদের ভাষা, রুচি, ইতিহাস ছাড়াও নিজেদের মধ্যে পার্থক্য যথেষ্ট। কিন্তু বিজ্ঞানের এমনই জাদু যে মানুষগুলি সব ভুলে গিয়ে এমন ভাবে কাজ করেন, মনে হয় গোটা পৃথিবীটাই কাজ করছে, নতুন ধরনের পদ্ধতি শিখছে, বুঝছে— এক কথায় বিজ্ঞানের নতুন রাস্তায় হুহু করে এগিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক কালে পর পর কয়েক বছর ভারত আশি কোটি টাকা করে সার্নকে দিয়েছে। ভারত এত দিন ছিল কেবল অবজারভার, এখন হল অ্যাসোসিয়েট মেম্বার। সার্ন-এর আগের ডিরেক্টর জেনারেল রলফ হ্যয়ার আমায় বলেছিলেন যে, ‘এই আশি কোটি টাকার মতো ব্যবসা তোমরা (ভারত) করতে পারো, মানে আশি কোটি টাকা ভারত রোজগার করতে পারবে। এই পদ্ধতিতে নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করতে পারব— দেশে যে সব জিনিস বা বৈজ্ঞানিক মেশিন তৈরি হচ্ছে সেগুলিতে কাজে লাগাব।’ বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে কেবল এক জন দু’জনের নাম কেনাটা বড় কথা নয়, দেশ হিসেবে ভারতকে বিজ্ঞানের জগতে প্রথম সারিতে নিয়ে আসাটাই জরুরি।
দ্বিতীয় উদাহরণ জার্মানির ফেসিলিটি ফর অ্যান্টি প্রোটন অ্যান্ড আয়ন রিসার্চ (ফেয়ার)। ফেয়ার এখন কেবল গবেষণাগার নয়, একটা সংস্থা। যে কোনও দেশ সেখানে শেয়ার কিনতে পারে। ভারতও শেয়ার হোল্ডার (৩.২ মিলিয়ন ইউরো, আপাতত)। এখানে শেয়ারের অনুপাতে কাজের সুযোগ দেওয়া হয় না, ভাল কাজ করলে, ভাল আইডিয়া থাকলেই সে দেশ, অন্য দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে যাবে। এখন আমরা সার্ন-এ এটা করতে পারি, অ্যাসোসিয়েট মেম্বার হওয়ার পর।
ভারত বড় দেশ, ভাল ছাত্রের অভাব এখনও তেমন হয়নি। তবে ভাল ছাত্রদের মধ্যে ভারতের বাইরে গিয়ে কাজ করার একটা অসম্ভব স্পৃহা। টাকা তো বেশিই, কিন্তু সুবিধা এবং স্বাধীনতাও প্রচুর। ভারতের বিজ্ঞানীরা এখন ভালই টাকা পাচ্ছেন, কিন্তু স্বাধীনতা আছে কি? আমলাদের খপ্পর থেকে একটা কাজ বের করে নিয়ে আসা সোজা কথা নয়। খুবই সময়সাপেক্ষ। কিন্তু বিজ্ঞান তো বসে নেই। যত দিন টাকার ব্যবহার বা কী ভাবে ব্যবহার করবে, সেই বিষয়টা আমলাদের হাতে থাকবে, তত দিনই ভারত পিছিয়ে থাকবে। স্যর আশুতোষ বা হোমি ভাবা প্রথমে লোক ঠিক করতেন, তার পর প্রজেক্ট শুরু করতেন। হোমি ভাবা গোবিন্দ স্বরূপকে বলেছিলেন, ‘তুমি কাজ করে যাও, টাকাপয়সার কথা ভাবতে হবে না।’ সেই টেলিস্কোপ (গোবিন্দ স্বরূপের তৈরি) ভারতের একমাত্র কেন্দ্র যেখানে বহু লোক পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে এসে কাজ করে যায়। অধ্যাপক সি এন আর রাও-এর জওহরলাল নেহরু সেন্টারে বিদেশিদের ছড়াছড়ি।
এই আনাগোনা, যাতায়াত সকলের সঙ্গে প্রাণ খুলে আলোচনা আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। এই সুযোগ সে যদি না পায় তা হলে বড় মাপের বিজ্ঞান গবেষণা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়। সুযোগ ও স্বাধীনতা খুব বেশি করে প্রয়োজন, আর এখানে সুযোগ যদিও আসে, তা আমলাদের ফাইল থেকে এত দেরিতে আসে, তত দিনে তা আবিষ্কার হয়ে বসে আছে। আর স্বাধীনতা? সেটা তো আমলাদের ফাইলে আটকে গিয়েছে। ভারতে মেধা আছে, কিন্তু মেধা বুঝবার মেধা খুব কম লোকেরই আছে, এবং তা আরও কমে চলেছে।
ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ হোমি ভাবা চেয়ার প্রফেসর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy