লাদাখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লাদাখ সীমান্তে দাঁড়িয়ে শুক্রবার সারা পৃথিবীকে একটি বার্তা দিয়েছেন। সমতল থেকে ১১ হাজার ফুট ওপরে, জনস্কার পর্বতমালায় ঘেরা এক রুক্ষ পাথুরে মালভূমিতে, প্রবাহমান সিন্ধু নদের তটে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রের দু’টি ভিন্ন দিকের কথা উল্লেখ করেছেন, বজ্রের চেয়েও কঠিন সুদর্শনচক্রধারী রূপ আর পুষ্পের চেয়েও কোমল বংশীধারী রূপ। এই ভারতের মাটিতেই কয়েক হাজার বছর আগে বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণ তাঁর আত্মীয় চেদিরাজ শিশুপালের জন্য অপমানের একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকের সময়ে চেদিরাজ শিশুপাল সেই অষ্টোত্তর শততম কটূক্তির গণ্ডি অতিক্রম করার ফলে শ্রীকৃষ্ণ সুদর্শনচক্রের দ্বারা তাঁকে বধ করেন। এখানে ক্ষমা, সহ্যশক্তি এবং শাস্তির ক্রমটি বোঝা অত্যন্ত জরুরি। এটি বুঝতে পারলেই প্রধানমন্ত্রীর গতকালের বক্তব্যের সারমর্ম স্পষ্ট হয়ে যাবে।
লাদাখে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ভারতের সৃষ্টি করা নয়, সেই বিষয়টি প্রথমেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়া প্রয়োজন। ২০১৩ সালে এই সেক্টরেই চিন প্রায় ৬৫০ বর্গ কিলোমিটার জমি দখল করার পর আজকের মতন পরিস্থিতিই সৃষ্টি হতে পারত। কিন্তু সে বার ভারত সামরিক পদক্ষেপ করেনি। সামনে পাক অধিকৃত গিলগিটে পাক সেনা, বাম দিকে পাক অধিকৃত কাশ্মীরেও পাক সেনা আর ডান দিকে চিনা সেনা, একসঙ্গে তিন দিক দিয়ে ঘিরে থাকা শত্রুর বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহার করার পরিবর্তে তৎকালীন সরকার সহ্যশক্তি প্রয়োগ করা বেশি সমীচীন মনে করেছিলেন। বস্তুত, চিনে কমিউনিস্ট শাসন লাগু হওয়ার পর থেকেই ওরা তিব্বতকে গ্রাস করা শুরু করে এবং সীমান্ত জুড়ে ভারত-তিব্বতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ক্রমশঃ চিন-ভারত সীমান্ত বিবাদে পরিণত হয়।
প্রধানমন্ত্রীকে পরিস্থিতি বোঝাচ্ছেন সেনা অফিসাররা। ছবি: পিটিআই
এই মুহূর্তে ভারতের মোট ৪৩ হাজার ১৮০ বর্গমাইল জমি চিন দখল করে বসে আছে, যে হিসাবের মধ্যে পাকিস্তানের দখলে থাকা ভারতীয় জমির ৫ হাজার ১৮০ বর্গমাইল চিনকে ভেট দেওয়া জমিও ধরা আছে। সহ্যের সীমা ঠিক কতটা সেটা যে ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত থাকে না, সে ক্ষেত্রে দেশের মনোবৃত্তি, সরকারের নির্ণয়ক্ষমতা আর সামগ্রিক ভাবে দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক শক্তির ওপর সিদ্ধান্ত নির্ভর করে। অবশেষে এ বার শান্তিপ্রিয় বংশীধারী তাঁর সুদর্শনচক্রকে আহ্বান করেছেন এবং এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় ১০ এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে চিনের প্রতিনিধিদলের তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা দেং জিয়াও পেং বলেছিলেন, চিন যদি কোনও দিন স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে, যদি অন্যান্য দেশে গিয়ে শক্তিপ্রদর্শন করে, আগ্রাসন দেখায় বা তাদের শোষণ করতে শুরু করে, তা হলে বুঝতে হবে যে চিন সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের দোষে দুষ্ট হয়ে পড়েছে এবং সে ক্ষেত্রে সমগ্র মানবজাতির কর্তব্য সেই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উৎখাত করতে চিনের জনগণকে সাহায্য করা।
লেহ্ হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী। ছবি: পিটিআই
গতকাল প্রধানমন্ত্রী তাঁর লাদাখ সফরের মাধ্যমে আসলে একাধিক বার্তা দিয়েছেন। প্রথম বার্তাটি নিজের সেনাবাহিনীর প্রতি। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা শব্দবন্ধটির প্রয়োগ কোনও সামান্য ঘটনা নয়, এর দ্যোতনা অপরিসীম। ভারতের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ভারতের আমজনতার প্রতিনিধিরূপেই লাদাখ গিয়েছিলেন। ওঁর প্রতিটি বক্তব্যের মধ্যে তাই সেনার প্রতি সম্মান, তাঁদের ত্যাগ ও শৌর্য্যের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা আর তাঁদের অটল নিশ্চয়তার প্রতি দেশবাসীর অটুট বিশ্বাস ঝরে ঝরে পড়ছিল। এই সফরের ফলে সীমান্তে এবং সারা দেশ জুড়ে সেনাবাহিনীর মনোবল যে এখন গগনচুম্বী, সে কথা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও পড়ুন: আপনি চিনকে চিন বলতে পারলেন না?
প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় বার্তাটি ছিল দেশবাসীর প্রতি। অস্মিতার প্রশ্নে, সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে এবং অন্যায়কে আর প্রশ্রয় না দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশ দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, সেটা স্পষ্ট। এই লড়াইয়ে দেশের মুখিয়া সোজাসুজি জমিতে নেমে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত, তিনি রাজধানীর ঠান্ডা ওয়াররুমে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে রাজি নন, দেশ তাঁর ওপর যে দায়িত্ব দিয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে তিনি যে বদ্ধপরিকর, দেশবাসীর প্রতি সেই বার্তাটিও অত্যন্ত দৃশ্যময় ছিল। তাঁর তৃতীয় বার্তাটি ছিল চিন এবং পাকিস্তানের প্রতি। এবং সেই দেশগুলির নাম না করেই তিনি সুকৌশলে বার্তাটি দিলেন, অর্থাৎ যাকে ‘অনারেবেল এক্সিট’ বলে অর্থাৎ সম্মানজনক পশ্চাদপদ, তাদের জন্য সেই রাস্তাও খোলা রাখলেন।
গালওয়ান সংঘর্ষে নিহতদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন প্রধানমন্ত্রীর। ছবি: পিটিআই
কিছু কথা প্রধানমন্ত্রী মুখে বলেছেন আর কিছু কথা তাঁর শরীরী ভাষায় ফুটে উঠেছে। ইংরেজিতে স্ট্র্যাটেজিক অপটিক্স বলে একটি কথা আছে, অর্থাৎ সুকৌশলী দৃশ্যময়তা। উনি যখন আকসাই চিনের সীমান্তে দাঁড়িয়ে বিস্তারবাদ এবং বিকাশবাদের কথা বলেন, দিল্লিস্থিত চিনা দূতাবাসের আত্মরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় আঘাতটি ঠিক কোথায় এবং কতটা লেগেছে। আবার যখন মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে ‘ভারত মাতা কি জয়’ আর ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি দেন, যখন লেহ্তে সেনা হাসপাতালে বীর সন্তানের জন্মদাত্রীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন অথবা ১৪ কোরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দাঁড়িয়ে বলেন যে শত্রুপক্ষ ভারতীয় সেনার ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি’ অর্থাৎ শক্তি এবং প্রকোপ দুটোরই সাক্ষী, তখন চিন বা পাকিস্তান কারওরই বুঝতে বাকি থাকে না, কাদের উদ্দেশে উনি বার্তা দিচ্ছেন।
তাঁর এই সফরে সারা পৃথিবীর জন্য আরও একটি না বলা বার্তা অন্তর্নিহিত ছিল। ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে দেশের মানুষ ভোট দিয়ে নির্বাচন করেন। অন্য দিকে চিন বা পাকিস্তানে মানুষের ভোটে জিতে নয়, আইএসআই বা কমিউনিস্ট পার্টির মতন একটি তৃতীয় শক্তি মিথ্যা নির্বাচনের মাধ্যমে এক জন পুতুল শাসক নিযুক্ত করে বকলমে তাদের দিয়ে স্বৈরাচারী শাসন চালায়। এক দিকে প্রতিবেশী দেশে জমি দখলকারী, দুর্নীতিগ্রস্ত, বিবাদকামী নেতৃত্ব আর অন্য দিকে ভারতে শান্তিপ্রিয়, স্বচ্ছ, উন্নয়নকামী জননেতা— দু’পক্ষের নেতৃত্বের পার্থক্যটিও নেতৃত্বের আচরণের মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে যায়। ভারত শ্রীকৃষ্ণের ভূমি, ভারত সম্বাদে বিশ্বাসী, বিবাদে নয়। কিন্তু ভারত ন্যায়ের ভূমিও বটে এবং ক্ষমার অযোগ্য অন্যায় সহ্য করা ভারতের রাষ্ট্রধর্ম নয়। ভারত তার ভূমিকা স্থির করে নিয়েছে এবং গত কাল সারা বিশ্বকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেখিয়েও দিয়েছেন। এ বার সারা বিশ্বকে তাদের নিজেদের অবস্থান স্থির করতে হবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চিন্তাবিদ এবং সমাজকর্মী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy