করোনার বাড়বাড়ন্ত, গালওয়ান অঞ্চলে ভারতীয় জওয়ানদের হত্যা, লাদাখে সৈন্য-সমাবেশ প্রভৃতি ঘটনার সঙ্গে চিনের যোগসূত্র থাকায় ভারতবাসীর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে যে, চিন ভারতের শত্রু দেশ। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। প্রাচীন কালে যখন রেশম পথ ধরে বণিকদের সঙ্গে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা চিন দেশে বুদ্ধের বাণী সংবলিত পাণ্ডুলিপি নিয়ে পৌঁছেছিলেন, তখন থেকেই চিন ও ভারতের সম্পর্কের বুনিয়াদ তৈরি হয়েছিল।
প্রথম দিকে অবশ্য এই সম্পর্ক সহজ হয়নি। প্রচলিত কনফুশীয় ও তাও ধর্মে অভ্যস্ত চিনবাসীর কাছে হিমালয়ের অন্য দিকে থাকা দেশটি ‘বর্বর’, জাদুবিদ্যায় পারদর্শী রূপে পরিচিত হওয়ায়, কেউই ভারত থেকে আসা ভিক্ষুদের সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেননি, সঙ্গে আনা পাণ্ডুলিপিগুলিও তখন গুরুত্ব পায়নি। সংস্কৃতে লেখা পাণ্ডুলিপিগুলি গুটিকয়েক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত ছাড়া কেউই পড়তে জানতেন না। ফলে ছোট ছোট ব্যক্তিগত সংগ্রহ ভিন্ন কোনও রাজকীয় স্থানে সেগুলির জায়গা হয়নি। ৬৪ খ্রিস্টাব্দে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, যখন হান সাম্রাজ্যের সম্রাট মিংতি মাথা থেকে জ্যোতি বেরোনো এক জন দৈবপুরুষের স্বপ্ন দেখেন। পরের দিন কাশ্যপ-মাতঙ্গ ও ধর্মরত্ন নামে দু’জন বৌদ্ধ ভিক্ষু রাজদরবারে উপস্থিত হয়ে রাজাকে একটি বুদ্ধমূর্তি প্রদান করেন। কিংবদন্তি যে, প্রতি দিন তিনি তাও ধর্মের উপাসনার সঙ্গে বৌদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণ করতেন, রাজকর্মচারীদের সাহায্যে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দানসামগ্রী পাঠাতেন।
রাজানুগ্রহের ফলে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকেই চিন দেশে বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা ঘটে। ধীরে ধীরে বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থগুলি চিনা ভাষায় অনূদিত হতে শুরু করে। এই ব্যাপারে যে গ্রন্থটির প্রথম পরিচয় পাওয়া যায়, সেটি ছিল প্রচলিত বুদ্ধের অনুশাসনের সংক্ষিপ্ত রূপ। ক্রমে রেশম পথ ধরে চিনে এসে পৌঁছতে থাকে অধিকাংশই সংস্কৃতে লেখা সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি বা পাণ্ডুলিপির আংশিক পাতা। সংস্কৃত ও চিনা ভাষায় দক্ষ ভিক্ষুরা পাণ্ডুলিপিগুলির পাঠোদ্ধার করে, বৌদ্ধ দর্শনের মূল তত্ত্বগুলি তুলে ধরতে অতি দ্রুততার সঙ্গে সেগুলির অনুবাদের কাজে নিযুক্ত হন। এঁদের সঙ্গে হাত মেলান সেই ভাষায় অভিজ্ঞ চিনের বহুভাষাবিদ পণ্ডিতরা, যাঁরা ওই পাণ্ডুলিপিগুলির নিহিত বাণী উপলব্ধি করে দেশবাসীকে সেই বিষয়ে অবহিত করার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
তবে একটা সমস্যাও দেখা যায়। অনুবাদক দলের অধিকাংশই চিনা ভাষার সঙ্গে অভ্যস্ত, অথবা বৌদ্ধ ধর্মের পারিভাষিক শব্দগুলির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না, নির্ভর করতেন দোভাষীর উপর। কিন্তু এই প্রচেষ্টায় বৌদ্ধ দর্শনের মূল তত্ত্বগুলি স্পষ্ট ভাবে কিছুতেই উপলব্ধি করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই প্রাথমিক স্তরে চিনে তাও ধর্মের একটি শাখা রূপে পরিগণিত হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্ম। এই ধারণা দীর্ঘ দিন প্রচলিত থাকায়, এর থেকে গড়ে ওঠে বৌদ্ধ ও তাও ধর্মের একত্ব প্রতিপাদনের জন্য নানা তত্ত্ব। বৌদ্ধ ধর্মের স্বাতন্ত্র্যের তত্ত্ব প্রথম উপস্থাপন করেন চিনা পণ্ডিত তাও-অন। তাঁরই উত্তরসূরি হয়ে চিনে আসেন বৌদ্ধাচার্য কুমারজীব, যাঁর হাত ধরে যথাযথ ভাবে বৌদ্ধ দর্শন চর্চা সূচিত হয়। পঞ্চম খ্রিস্টাব্দের সূচনা কাল থেকে নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে চিনে বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি সুদৃঢ় করে, গড়ে ওঠে নানা সম্প্রদায়। স্বাভাবিক নিয়মেই বৌদ্ধ ধর্ম লোক ধর্মের সঙ্গে সংযুক্ত হতে থাকে। বৌদ্ধ দর্শনকে আরও গভীর ভাবে জানার আগ্রহের ফলে এক দিকে যেমন ভারত থেকে পণ্ডিতদের আহ্বান করা হতে থাকে, তেমনই চিন থেকেও ভারতে আসতে থাকে ছাত্রের দল, যাঁদের মধ্যে হিউয়েন সাং এবং ফা হিয়েনের নাম সুবিদিত।
পরবর্তী কালে কমিউনিজ়ম চিনের জাতীয় বিশ্বাস হিসেবে গৃহীত হলে বৌদ্ধ ধর্ম পালনও নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়। মাও জে দং-এর জমানার প্রথম দিকে কিছু বৌদ্ধ মন্দির ও সঙ্ঘ ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্দেশ্যে রূপান্তরিত হলেও অন্য মন্দিরগুলি সরকার-নিয়ন্ত্রিত সংস্থায় পর্যবসিত হয়। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মাওয়ের লাল ফৌজ বৌদ্ধ মন্দির ও সঙ্ঘগুলির অপূরণীয় ক্ষতি করে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মাওয়ের মৃত্যুর পর সরকারের ধর্ম-দমননীতি শিথিল হলে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন চর্চার নতুন করে সূচনা ঘটে। সরকার-নিয়ন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ দর্শন চর্চা গত পঞ্চাশ বছর ধরে জোর কদমেই চলছে। আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ দর্শন চর্চার ক্ষেত্রে চিনে নতুন এক প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থগুলির চিনা অনুবাদ থেকে মূল সংস্কৃতে পুনরায় অনুবাদের কাজে চিনা পণ্ডিতরা নিয়োজিত হয়েছেন। এই ভাবে আমরা ভারত থেকে হারিয়ে যাওয়া দিঙ্নাগ, নাগার্জুন প্রমুখের মূল গ্রন্থগুলি ফিরে পেয়েছি। অনুবাদচর্চার পাশাপাশি বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী সঙ্ঘগুলিতে বৌদ্ধ ধর্ম পালন ও শাস্ত্র চর্চাও করা হয়। এই শিক্ষাকেন্দ্রগুলির উদ্যোগে আয়োজিত আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রে নিয়মিত ভাবে জ্ঞানের আদানপ্রদান ঘটে।
বুদ্ধদেবের দেশ ভারত ও সেই দেশের মানুষের প্রতি চিনা জনসাধারণের একটা শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম কাজ করে। ছোট্ট শহর হাংঝাও ও নিম্বুর ভিক্ষুণীদের দর্শন পড়ানো উপলক্ষে সেখানে দিন সাতেক কাটানোর সুযোগে লক্ষ করি, শাস্ত্র পাঠ ও ভারতকে জানার কী আগ্রহ! এই আগ্রহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও দেখেছি। ভারতীয় পোশাক পরা আমাকে দেখে এক জন বৃদ্ধা এগিয়ে এসে নিজের ভাষায় অনেক কিছু বলেছিলেন। যার মর্মার্থ, অনেক পুণ্যের ফলে আজ আমি বুদ্ধের দেশের লোকের দেখা পেলাম। রাজনীতি দুই দেশের মধ্যে যতই যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করুক, আজও দুই দেশের মানুষ একটি বন্ধনসূত্রে আবদ্ধ, সেই সূত্র বুদ্ধ-প্রদর্শিত পথের। সেই পথ ধরে অগ্রসর হলে বোধ হয় আমরা আবার বন্ধু প্রতিবেশীকে ফিরে পেতে পারি।
দর্শন বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy