স্বদেশি ভাষা বিনা আশা পুরে না, গাহিয়া গিয়াছেন কবি। ভারত নামক বিরাট বহুভাষাভাষী রাষ্ট্রে স্বদেশি ভাষা বলিতে নিঃসন্দেহে মাতৃভাষাকেই বুঝায়। বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা। একই সঙ্গে ইহাও ঠিক যে, পশ্চিমবঙ্গে কেবল বাঙালিরই বাস নহে, বহু অবাঙালি এই রাজ্যের মাটিকে নিজের বলিয়া জানেন বহু কাল ধরিয়া। কিন্তু যে হেতু এই দ্বিতীয় বাক্যটি প্রথমটিকে ভুল প্রতিপন্ন করে না, তাই, বাংলার স্থান পশ্চিমবঙ্গে যে অগ্রগণ্য অর্থাৎ প্রথমেই ‘গণ্য’ হইবার যোগ্য, তাহাতেও সংশয় থাকিতে পারে না। জীবনচর্যার দৈনন্দিন অভ্যাসগুলিতে বাংলার প্রয়োগ দেখিতে পাওয়া স্বাভাবিক, ইহা লইয়াও সন্দেহ তুলিবার কথা ছিল না। অথচ বাস্তবচিত্রটি ভিন্ন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে অফিস-আদালতের কাগজপত্র হইতে বিবিধ বিপণির নামফলক, সর্বত্র বাংলার ব্যবহার চোখ ও হৃদয় জুড়ায়, কিন্তু এই রাজ্যে সেই অনুভূতি নাই। কলিকাতায় পথ চলিতে ইংরাজি বিজ্ঞাপনের সর্বগ্রাস দেখিয়া আক্ষেপ করিয়াছিলেন প্রখ্যাত এক বাঙালি সাহিত্যিক। সেই হাহুতাশ আজও যায় নাই। ইতিমধ্যে জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়ায় অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির উপর হিন্দি চাপাইবার চেষ্টা লইয়া দেশের বহু স্থানে বহু প্রতিবাদ হইল, সরবতা দেখা গেল বাঙালি সমাজের একাংশেও। এই সব গোলযোগের মধ্যে অতি সম্প্রতি শোনা গেল, কলিকাতা পুরসভার সিদ্ধান্ত, রাস্তার নামের ফলকে বাধ্যতামূলক থাকিবে প্রথমে বাংলা ভাষা, তাহার নীচে ইংরাজি।
ঘটনা হইল, শহরেই কিছু রাস্তার নামফলকে প্রথমে ইংরাজি ও তাহার নীচে উর্দুর ব্যবহার দেখিয়া পুরসভার টনক নড়িয়াছে। সেই অঞ্চলগুলি মুসলমানপ্রধান বলিয়াই হয়তো বাংলার হাত ছাড়িয়া উর্দুর শরণ। কিন্তু যে কথাটি এ ক্ষেত্রে ভুলিয়া যাওয়া হইয়াছে তাহা হইল, বাহিরের রাজ্যের অধিবাসীর কথা ভাবিয়া সাইনবোর্ড লিখিবার দরকার নাই, আর এ রাজ্যের বাঙালি মুসলমানের ভাষা কিন্তু বাংলা-ই, উর্দু নহে। বিশেষ ইতিহাসবোধসম্পন্ন না হইলেও মানুষের মনে থাকিতে পারে, বাংলার উপরে উর্দু চাপাইয়া দিবার অপচেষ্টার প্রতিরোধেই কিন্তু বাঙালি মুসলিম নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন হইয়াছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে। রাজপথে প্রাণ দিয়াছিলেন সালাম-বরকত-জব্বার-রফিকেরা, যাঁহাদের মাতৃভাষা বংশপরম্পরায় বাংলা।
সুতরাং বাঙালি মুসলমানের সহিত উর্দুকে জুড়িয়া দিবার কার্যটি অতীব ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত। সমাজের একটি অংশ কখনও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, কখনও অন্য ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির মতলবে এই ধারণাকে কেবল লালনই করে নাই, অঞ্চলবিশেষে দস্তুরমতো প্রচারও করিয়াছে। বিভিন্ন সময়ে তাহার মাসুল গুনিয়াছে দুই বঙ্গভূমি। ধর্ম-পরিচয় ও ভাষার এই সংঘাত যে আজও মিটে নাই, সাক্ষ্য দিতেছে একুশ শতকের কলিকাতার রাস্তায় উর্দু বা হিন্দি নামফলক।
পুরসভা বাংলাকে প্রাধান্য দিবার ঘোষণা করিয়া সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়াছে। এই দায়িত্ব সমাজেরও। হিন্দুর সহিত সংস্কৃতেরই গলাগলি, মুসলমান মানেই উর্দু বা আরবির আশনাই, এই রূপ বিভাজন কাজের কথা নহে। এই রাজ্যের নাম ‘বঙ্গ’ শব্দটি ধারণ করিয়া রহিয়াছে, তাই ধর্ম-নির্বিশেষে বাঙালি পরিচয় ও বাংলা ভাষার ভূমিকাটিকে ছোট করিয়া দেখা চলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy